Inqilab Logo

বুধবার ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ২১ কার্তিক ১৪৩১, ০৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পাঞ্জাবে আবারো খালিস্তানি ঝড় তুলছেন ‘ভিন্দ্রানওয়ালে ২.০’

অনলাইন ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ২ মার্চ, ২০২৩, ৯:৩৮ এএম

বয়স আনুমানিক ২৯। বছরখানেক আগেও যাকে ইনস্টাগ্রামে ‘কুল’ সেলফি পোস্ট করতে দেখা যেত, এখন তাকে গাঢ় নেভি ব্লু রঙের পাগড়ি আর শিখ ধর্মগুরুদের মতো লম্বা সাদা চোলা আর তরবারির সাইজের কিরপান ছাড়া প্রকাশ্যে দেখাই যায় না।

অমৃতপাল সিং সান্ধু নামের এই শিখ যুবকই এখন ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যে ও কেন্দ্রীয় সরকারের নতুন মাথা ব্যথার নাম।

গত বৃহস্পতিবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) এই অমৃতপাল সিংয়ের বেশ কয়েক শ’ সশস্ত্র অনুগামী অমৃতসরের কাছে আজনালাতে এক সহকর্মীকে ছাড়িয়ে আনতে থানায় আক্রমণ চালায়। হামলার সময় তাদের মুখে ছিল খালিস্তানের স্লোগান।

আগ্নেয়াস্ত্র ও কিরপান নিয়ে চালানো সেই হামলায় বহু পুলিশ সদস্য ও কর্মকর্তা আহত হন। ভীতসন্ত্রস্ত পুলিশ কর্মকর্তারা ওই অভিযুক্তকে নির্দোষ বলে জানানোর পরদিন আদালতে তিনি ছাড়াও পেয়ে যান।

শিখ শাসনের দাবি
পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে কিভাবে এই খালিস্তান সমর্থকরা বন্দুক ও কিরপান নিয়ে ধেয়ে যাচ্ছেন, আজনালার সেই ভিডিও নিমেষে সারাদেশে ভাইরাল হয়ে ওঠে।

ও দিকে অমৃতপাল সিং প্রকাশ্যেই ঘোষণা করেন, ‘খালিস্তান’ ও ‘শিখ শাসনে’র দাবিতে তাদের আন্দোলন আরো তীব্রতর হবে। শুধু পাঞ্জাব নয়, ভারতের আরো বিভিন্ন রাজ্যের নানা অংশ নিয়ে বৃহত্তর খালিস্তান গঠনের জন্য গণভোটের দাবিকেও সমর্থন জানান তিনি।

খালিস্তানের দাবি 'স্বাভাবিক'
বার্তা সংস্থা এএনআইকে সাক্ষাৎকার দিয়ে তিনি আরো বলেন, ‘বাকি ভারতে যেমন হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি ওঠে, তেমনি পাঞ্জাবে খালিস্তানের দাবিও খুব স্বাভাবিক একটি চর্চার বিষয়।’

থানায় শুধু আক্রমণ চালানোই নয়, এর আগে গত বছরের মে ও ডিসেম্বর মাসে মোহালি ও তরনতারনে পাঞ্জাবের অন্তত দু’টি থানায় রকেট প্রোপেলড গ্রেনেড দিয়েও হামলা চালানো হয়েছিল।

সেই ঘটনায় অমৃতপাল সিংয়ের অনুগামীরা সরাসরি জড়িত না থাকলেও পুলিশ যে সন্দেহভাজনদের আটক করেছিল, তাদের আইনি ও আর্থিক সহায়তা দেয়ার কথা ঘোষণা করে খালিস্তানপন্থী সংগঠন ‘শিখস ফর জাস্টিস’ (এসএফজে)।

গত বছরের জুন মাসে রাজ্যের সাংরুর আসনের উপ-নির্বাচনে আড়াই লাখেরও বেশি ভোট পেয়ে পার্লামেন্টে যান অকালি দল (মান গোষ্ঠীর) প্রবীণ নেতা সিমরনজিৎ সিং মান, পৃথক খালিস্তান গঠনের দাবিতে যার সমর্থনের কথা সুবিদিত।

সব মিলিয়ে ভারতের পাঞ্জাবে যে খালিস্তান আন্দোলনের প্রতি নতুন করে জনসমর্থন দেখা যাচ্ছে, সেই ইঙ্গিত নানা ঘটনাতেই স্পষ্ট।

কে এই অমৃতপাল সিং?
মাত্র মাসকয়েক আগেও বাকি ভারতে কেন, এমন কী পাঞ্জাবেও কেউ অমৃতপাল সিংয়ের নাম শোনেননি।

অমৃতসরের কাছে জাল্লুপুর খেড়া গ্রামের এই যুবক স্কুলের গণ্ডি পেরিয়েই বছর দশেক আগে পরিবারের ট্রান্সপোর্ট ব্যবসা দেখতে দুবাই পাড়ি দিয়েছিলেন। ভারতের পাসপোর্টধারী হলেও তিনি কানাডারও পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট।

দীপ সিধুর এনজিও ভারতে কৃষক আন্দোলনের সূত্র ধরে যিনি ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছিলেন, পাঞ্জাবের সেই গায়ক অ্যাক্টিভিস্ট দীপ সিধু ইতোমধ্যে ২০২১-এর শেষ দিকে ‘ওয়ারিস পাঞ্জাব দি’ নামে একটি সামাজিক সংগঠন বা এনজিও তৈরি করেছিলেন।

গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে একটি গাড়ি দুর্ঘটনায় দীপ সিধুর মৃত্যু হলে ‘ওয়ারিস পাঞ্জাব দি’র নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়, সংগঠনটি ভেঙে একাধিক টুকরোও হয়ে যায়।

গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর ‘ওয়ারিস পাঞ্জাব দি’-র একটি গোষ্ঠী তাদের নতুন নেতা হিসেবে বেছে নেয় অমৃতপাল সিং-কে, যিনি মাত্র কিছুদিন আগেই ভারতে ফিরে এসেছিলেন।

অমৃতপাল সিংয়ের সেই ‘দস্তরবন্দী’ (নেতৃত্বের পাগড়ি বাঁধার অনুষ্ঠান) আয়োজন করা হয়েছিল মোগা জেলার রোড গ্রামে, যেটি খালিস্তানি আন্দোলনের নায়ক সন্ত জার্নেল সিং ভিন্দ্রানওয়ালের জন্মস্থান।

ভিন্দ্রানওয়ালের 'উত্তরসূরি'
ভিন্দ্রানওয়ালের নামাঙ্কিত গুরদোয়ারাতেই সেদিন ব্যবস্থা হয়েছিল লঙ্গরের, যেখানে হাজার হাজার লোক ‘সেবা’ পেয়েছিলেন।

ওই দিনের পর থেকেই অমৃতপালের অনুগামীরা তাকে ভিন্দ্রানওয়ালের সার্থক উত্তরসূরী হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করে আসছেন, মিডিয়াতেও তাকে ভিন্দ্রানওয়ালে ২.০ বলে বর্ণনা করা হচ্ছে।

সংগঠনের দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে একাধিক সাক্ষাৎকারে ও বক্তৃতায় এই তরুণ নেতা স্পষ্ট করে দিয়েছেন, তিনি গুরু ভিন্দ্রানওয়ালের মতোই খালিস্তানের পক্ষে লড়ে যাবেন। তার ধর্মীয় বক্তৃতা শুনতে সভায় প্রচুর ভিড়ও হচ্ছে।

সভা-সমিতিতে বা জলসায় অমৃতপাল সিং বারে বারে একটা কথাই বলছেন, ‘শিখদের মধ্যে গত দেড় শ’ বছর ধরে ক্রীতদাসের মনোভাব ঢুকে গেছে। আগে তারা ছিল ব্রিটিশদের দাস, এখন তারা হয়েছে হিন্দুদের দাস – এই অবস্থা পাল্টে দিয়ে শিখ শাসন ফিরিয়ে আনতে হবে।’

সোশ্যাল মিডিয়ার বিভিন্ন সাইটেও সব সময় দেখা যায় তার খুব সরব ও সক্রিয় উপস্থিতি।

সব সময় খুব ঘনিষ্ঠ দশ-পনেরোজন অনুচর পরিবৃত হয়ে ঘোরাফেরা করেন অমৃতপাল সিং, তার কনভয়েও থাকে অন্তত আধাডজন এসইউভি।

আর ভিন্দ্রানওয়ালের মতোই সব সময় তার কোমরে থাকে তরবারির সাইজের পেল্লায় একটি কিরপান। আর তার অনুগামীদের কাছে বন্দুক বা তরবারির মতো অস্ত্র যে ছেলেখেলা, সেটা স্পষ্ট হয়ে গেছে আজনালা থানায় হামলা চালানোর দিনেই।

ভারতের জন্য কতটা দুশ্চিন্তার?
আজনালায় যেদিন পুলিশ থানা আক্রান্ত হয়েছিল, সে দিনই পাঞ্জাবের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও সাবেক সেনা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিং মন্তব্য করেন, ‘এটা শুধু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সম্পূর্ণ ভেঙে পড়াই নয়, পরিস্থিতি তার চেয়েও অনেক বেশি গুরুতর।’

অমৃতপাল সিংয়ের অনুগামীদের এই সশস্ত্র হামলার ঘটনায় গোটা দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতির জন্যও বিপদ সঙ্কেত আছে বলে তিনি সতর্ক করে দেন।

পাঞ্জাবে নতুন অস্থিরতা
তবে সোমবার পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ও আম আদমি পার্টির নেতা ভগওয়ন্ত মান এই হামলাকারীদের দিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, ‘মাত্র হাজারখানেক লোক কী করল, কী ভাবল... তাদের পুরো পাঞ্জাব বলে ভাবাটা ঠিক হবে না।’

তবে একই সাথে তিনি দাবি করেন, ‘আসলে এই ধরনের অল্প কিছু লোককে বিদেশ থেকে, পাকিস্তান থেকে টাকা-পয়সা জোগানো হচ্ছে। তাদের প্রভুদের ইশারায় এরা পাঞ্জাবে অস্থিরতা তৈরি করতে চাচ্ছে।’

আজকের পাঞ্জাবে খালিস্তান আন্দোলনের তেমন কোনো জনভিত্তি নেই বলে দাবি করা হলেও পাঞ্জাব সরকারও কিন্তু প্রকারান্তরে মেনে নিয়েছে, তাদের রাজ্যে অস্থিরতা তৈরি করা হচ্ছে এবং এর পেছনে প্রচুর অর্থেরও জোগান আছে।

এর মধ্যে দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকা রিপোর্ট করেছে, গত মাসেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ’র সামনে পেশ করা এক প্রেজেন্টেশনে পাঞ্জাবের পুলিশ প্রধান গৌরব যাদব তাদের রাজ্যে অমৃতপাল সিংয়ের নাটকীয় উত্থানের বিষয়টি ‘রেড ফ্ল্যাগ’ করেছিলেন।

পাঞ্জাব ট্র্যাজেডির পুনরাবৃত্তি?
ফলে বোঝাই যাচ্ছে, এই শিখ নেতা বেশ কিছুদিন ধরেই পুলিশ-প্রশাসনের ‘রাডারে’ আছেন। কিন্তু তার মোকাবিলার জন্য সরকারের কাছে কোনো নির্দিষ্ট পরিকল্পনা আছে বলে এখনো বোঝা যাচ্ছে না।

চন্ডিগড়ের থিঙ্কট্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কমিউনিকেশনের কর্মকর্তা প্রমোদ কুমার মনে করেন, ‘১৯৮০-র দশকে পাঞ্জাব যে ধরনের রাজনীতি দেখেছিল, এখনো ঠিক সেই ধরনের রাজনীতি আবার দেখা যাচ্ছে এবং এর পরিণতিতেই অমৃতপাল সিংয়ের উত্থান।’

কুমার মনে করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘সে সময়ও উগ্রপন্থী শক্তিগুলোকে নানাভাবে মদত দেয়া হয়েছিল এবং সেটা ছিল পাঞ্জাবের জন্য এক করুণ ট্র্যাজেডি।’

শিখ সেমিনারি ‘দমদমি তকসালে’র সাবেক মুখপাত্র ও অধ্যাপক সরচাঁদ সিং আবার মনে করেন, ‘অমৃতপাল সিং যতই দমদমি তকসালের মতো বেশভূষা পরুন বা সন্তজিকে (ভিন্দ্রানওয়ালে) নকল করুন, তিনি কখনোই দ্বিতীয় ভিন্দ্রানওয়ালে হয়ে উঠতে পারবেন না।’

ইন্দিরা গান্ধীর পরিণতি'
কিন্তু সরকার যদি এই ধরনের নেতাদের কর্মকাণ্ডে এখনই রাশ টানতে না পারে, তাহলে পাকিস্তান সীমান্তবর্তী ভারতের এ রাজ্যটি আবার যেকোনো সময় চরম অশান্ত হয়ে উঠতে পারে, তা নিয়ে পর্যবেক্ষকদের কোনো সংশয় নেই।

ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সম্প্রতি ঘোষণা করেছেন খালিস্তানি আন্দোলনকে তাদের সরকার সমূলে বিনাশ করবে।

যে ঘোষণার পর অমৃতপাল সিং পাল্টা হুঙ্কার দেন, ‘খালিস্তানিদের দমন করতে এলে অমিত শাহ’র পরিণতিও ইন্দিরা গান্ধীর মতোই হবে।’

উল্লেখ্য, ১৯৮৪তে স্বর্ণমন্দিরে অপারেশন ব্লু স্টারের কয়েক মাস পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তার শিখ দেহরক্ষীদের হাতে প্রাণ হারিয়েছিলেন। সূত্র : বিবিসি



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভারত


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ