মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় দেউলিয়া হলো যুক্তরাষ্ট্রের ২য় বৃহত্তম ব্যাংক
চলতি সপ্তাহের বুধবারও আর দশটি সাধারণ ব্যাংকের মতো বাণিজ্যিক ও আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক (এসভিপি), যা দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক ব্যাংক
ভূমিকম্পে লন্ডভন্ড তুরস্কের ১০টি প্রদেশের মধ্যে একটি আদিয়ামান। প্রতিটি শহরেই লাশের গন্ধ। ছোটখাটো ভূমিকম্পও ধাক্কা দিচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। ফলে শোকাহত মানুষের পিছু ছাড়ছে না আতঙ্ক। বৈরী আবহাওয়া, তীব্র ঠান্ডার মধ্যে গলিত লাশ উদ্ধার হচ্ছে ধ্বংসস্তূপ থেকে। স্থানীয় সূত্র বলছে ১৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৩৬ হাজারের বেশি লাশ উদ্ধার হয়েছে। সব হারানো মানুষের আর্তনাদ ক্রমেই বাড়ছে। উদ্ধার তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশসহ ৩২টি দেশ থেকে আগত উদ্ধারকারী দল ও চিকিৎসকরা।
আদিয়ামান শহরে ইতোমধ্যে সাড়ে ছয় হাজার লাশ উদ্ধার হয়েছে। স্থানীয়রা বলছেন আরও প্রায় ছাব্বিশ হাজার মানুষ নিখোঁজ। এদিকে ধ্বংসস্তূপ থেকে একের পর এক মৃতদেহ উদ্ধার হচ্ছে। উদ্ধারকৃত দেহগুলো এবড়োখেবড়ো হয়ে গেছে। ধ্বংসস্তূপ ঘিরে শোকাহতদের আর্তনাদ চলছে। চারদিকে মৃত্যুর মিছিল। শুধুই হাহাকার।
শহরের কোনো ভবনেই সাধারণ মানুষ থাকছে না। অক্ষত কিছু ঘর থাকলেও ফাটল ধরার কারণে বাসিন্দাদের অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। যারা স্বজন হারিয়েছেন, তারা ধ্বংসস্তূপ এলাকা ছাড়ছে না। দিনরাত প্রিয়জনের মৃত কিংবা জীবিত দেখবেন, এমন আশায় বুক বেঁধে আছেন। একেকটি লাশ উদ্ধার হলে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন স্বজনেরা। লাশের তীব্র গন্ধ স্বজনদের যেমন জড়ো হওয়া রুখতে পারছে না, ব্যাঘাত ঘটাতে পারছে না উদ্ধারকারীদেরও।
শোকাহতদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কারও কারও পরিবারে শিশুও ছিল। আশা ছেড়ে দিয়েছেন স্বজনদের জীবিত দেখার। উদ্ধারকারীদের পেছনে ছুটছে আর বলছে, ‘সাদেজে বেনিম আকরাবালারিমিন লেশলেরি বুলমাক ইসতিয়োরুম, সাদেজে এনসোন গোরমেক ইসতিয়োরুম (শুধু আত্মীয়স্বজনের লাশ খুঁজে পেতে চাচ্ছি, শুধু শেষবারের মতো দেখতে চাই)। যখনই লাশ বের হচ্ছে, প্রিয় মানুষটিকে জড়িয়ে চুম্বন খাচ্ছে স্বজনরা।
একই সঙ্গে চলছে অঝোরে কান্না। উদ্ধারকৃত লাশগুলো সঙ্গে সঙ্গেই কাপড় দিয়ে বিশেষভাবে মুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। একদিকে লাশের পচন, দুর্গন্ধরোধে বিশেষ প্যাকেট করে গাড়িতে রাখা হচ্ছে। স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, যে পরিমাণ লাশ উদ্ধার হয়েছে, তার দ্বিগুণেরও বেশি নিখোঁজ আছে। শহরের প্রধান সড়ক, শাখা সড়ক ধরে সারি সারি ভবন ধসে পড়ে আছে। ধ্বংসস্তূপ ঘিরে জড়ো হওয়া মানুষের প্রত্যাশা একটিই, দ্রুত আটকে পড়া স্বজনদের দেহ বের করা হোক। এদিকে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ উদ্ধার হওয়া লাশগুলোকে দ্রুত দাফনের ব্যবস্থা করছে। দেশের পতাকা গায়ে জড়িয়ে সর্বোচ্চ সম্মান দেখিয়ে বিভিন্ন স্থানে সমাহিত করা হচ্ছে।
ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে পাশের শহর গাজী আনতেপে। সেখান থেকে ছুটে আসা আকিফ ওযতুর্ক এবং ফাতমা ওযগুল কামালপাশা সড়কের কাছে একটি ধ্বংসস্তূপের পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন। আকিফ ওযতুর্ক নিজ ভাষায় জানালেন তাদের শহরে নিজেরা বেঁচে গেলেও এই শহরে থাকা ভাইবোন ও তাদের দুই সন্তান এখনো নিখোঁজ। এই সড়কের পাশে কোন ভবনটিতে তারা থাকতেন, সেটিও চিহ্নিত করতে পারছে না। সাতদিন ধরে অপেক্ষা করছেন। যেসব দেহ উদ্ধার হচ্ছে সেখানে যদি প্রিয় মানুষের খোঁজ মেলে। বলতেই, কান্না ভেঙে পড়েন এ ভাইবোন।
স্বজন, উদ্ধারকারীরা বলছেন জীবিত নয়, প্রাণহীন দেহটা উদ্ধার হলেও খুশি। শোকাহত, অপেক্ষমাণ লোকদের জন্য খাবার নিয়ে এসেছেন অনেকে। রাস্তার পাশে নিজ উদ্যোগেই রান্না করা খাবার তুলে দিচ্ছেন। উদ্ধারকারী কিংবা স্বজনদের খোঁজে অপেক্ষমাণ কাউকে খাবার কিনে খেতে হচ্ছে না। ধ্বংসস্তূপ এলাকা ছাড়াও বিভিন্ন সড়কের পাশে খাবার নিয়ে বসেছেন সাধারণ মানুষ।
দোয়ান নামের এক ব্যক্তি এই শহরের পাশে খাবার নিয়ে বসেছেন। জানালেন তার একটি তিনতলা ভবন ছিল, ভাড়া দিয়েছিলেন। বাসিন্দারা কেমন আছে জানেন না। সাতদিন ধরে মানুষদের খাবার খাওয়াচ্ছেন। এ রকম দৃশ্য পুরো শহর জুড়ে। কেউ আবার কোলের শিশু নিয়ে ধ্বংসস্তূপের পাশে অপেক্ষা করছেন। উদ্ধারকারীরা ভোর থেকে রাত পর্যন্ত সর্বশক্তি দিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। স্বজনেরাও ধ্বংসস্তূপ ঘিরে আর্তনাদ করে বলছেন, ভেঙে পড়া ভবনগুলোতেই আটকা পড়েছেন তাদের স্বজন।
বাংলাদেশ থেকে আসা ফায়ার ব্রিগেড ও সেনাবাহিনীর একটি টিমে ছত্রিশ জন দিনরাত উদ্ধার কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। টিম লিডার লে. কর্নেল মোহাম্মদ রুহুল আমিন জানান, তার দলের সদস্যদের নিয়ে ভোর থেকে রাত পর্যন্ত উদ্ধার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। সোমবার পর্যন্ত ধ্বংসস্তূপ কেটে ১৩ জনের মৃত দেহ ও ১ জনকে জীবিত উদ্ধার করেছেন।
এখন যেই ধ্বংসস্তূপে আমরাসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আসা উদ্ধার দল কাজ করছেন, সবাই লাশ পচার গন্ধ পাচ্ছেন। ভবনধসের একেক তলা সরাতেই কখনো লাশ, সঙ্গে লাশের তীব্র গন্ধ বেরিয়ে আসছে। অপেক্ষমাণ মানুষের হাতে যখন লাশ তুলে দিতে পারছি, আবেগতাড়িত মানুষগুলো আমাদের জড়িয়ে ধরছেন, কান্না করছেন। বাংলাদেশ তথা আমাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছেন।
বাংলাদেশ থেকে চিকিৎসকেরাও এসেছেন। সেবা দেওয়ার পাশাপাশি আমরা খাদ্যসামগ্রীও দিচ্ছি। শুধু আমরা নই, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা উদ্ধারকারী দল সর্বোচ্চ ইকুইপমেন্ট নিয়ে এলেও প্রত্যাশা অনুযায়ী উদ্ধার কাজ চালাতে পারছে না। অধিকাংশ ভবন মাটি থেকে দুই তিনতলা পর্যন্ত নিচে দেবে গেছে। আবার উপরের তলাগুলো একের পর এক চেপে বসেছে। ফাঁকা অংশ কম থাকায় বাইরে থেকে ভেতরে গিয়ে আটকে পড়া মানুষকে উদ্ধার করতে বেগ পেতে হচ্ছে। উপর থেকে ছাদ রড, কেটে কেটে নিচের দিকে যেতে হচ্ছে।
কাজ করতে গেলে প্রায় ধ্বংসস্তূপ আরও নিচের দিকে দেবে যাচ্ছে। প্রতিটি ভবনের অবস্থা এমন। গভর্নর ভবনের ঠিক পেছনেই চার-চারটি বহুতল ভবন ছিল। সবকটিই দেবে গেছে। ভূমিকম্পের পর থেকে উদ্ধার কাজ শুরু হলেও ধ্বংসস্তূপের চারভাগের একভাগ পর্যন্তও পৌঁছানো যায়নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেক উদ্ধারকারী বলেছেন, উদ্ধার কাজ ও ধ্বংসস্তূপ সরাতে কতদিন লাগবে তা নিশ্চিত নয়।
আদিয়ামান শহরের সবচেয়ে শক্তিশালী ভবন গভর্নর হাউস, যার পুরো দেয়ালে ছোটবড় চিড় ধরেছে। আর পুরো শহরে যেসব ভবন হেলে কিংবা দেবে যায়নি, সেগুলোর সব কয়টিতেই ফাটল ধরেছে।
ফলে পুরো শহরের বাসিন্দাদের অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। তুরস্কের ১০টি প্রদেশে ভূমিকম্প হানা দিয়েছে। আদিয়ামান ছাড়াও কাহরামান মারাশ, হাতাই, আদানা, গাজী আনতেপ, শানলি উরফা, উসমানিয়ে, দিয়ার বাকের, মালাতিয়া, আন্তাকিয়াতেও শত শত মানুষ নিখোঁজ রয়েছে।
কাহরামান মারাশের অন্যতম একটি উপশহরে এলবিস্তানে উদ্ধার কাজ সবচেয়ে বেশি ব্যাহত হচ্ছে। ধ্বংসস্তূগুলো বরফে ঢেকে গিয়েছে। এই শহরটি ইস্তাম্বুল থেকে প্রায় এক হাজার কিলোমিটার দূরে সিরিয়া সীমান্তের কাছাকাছি অবস্থিত।
এই শহরে উদ্ধার অভিযানে কাজ করা বাংলাদেশি শিক্ষার্থী মাকামে মাহমুদ বলেন, ‘আমরা সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করেছি। সারা দিনের ক্লান্তি শেষেও রাতে ঘুমানোর সুযোগ পাইনি। বরফে আগুন জ্বেলে বসে রাত কাটিয়েছি। প্রচণ্ড শীতের মধ্যেও স্বজনেরা লাশের অপেক্ষায় প্রহর গুনেছে। ধ্বংসস্তূপগুলোর পাশে বসে অপেক্ষার চাহনিতে আমাদের দেখেছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।