Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বইমেলার কথকতা

হোসেইন আহমদ চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১২:০৭ এএম

 অমর একুশে গ্রন্থমেলা। গ্রন্থমেলা বা বইমেলা নামে ব্যাপক পরিচিত। স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী এই মেলা প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে হয়ে থাকে। বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউজ প্রাঙ্গণ ও বর্ধমান হাউজকে ঘিরে চলে প্রাণের এই গ্রন্থমালা।

জানা যায়, ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি শ্রী চিত্তরঞ্জন সাহা বাংলা একাডেমির সামনে বটতলায় একটুকরো চটের ওপর ৩২টি বই সাজিয়ে বসেন। বইগুলো ছিলো চিত্তরঞ্জন সাহা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ থেকে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ভারতে অবস্থানকারী বাংলাদেশি শরনার্থী লেখকদের লেখা বই। স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ বর্তমানে মুক্তধারা প্রকাশনী।
১৯৭৩ সালে বাংলা একাডেমি মেলা উপলক্ষে ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত হ্রাসকৃত মূল্যে একাডেমির বই বিক্রির ব্যবস্থা করে। এর পাশাপাশি মুক্তধারা, স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্স এবং আরো কিছু প্রকাশনী বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে তাদের বই বিক্রির ব্যবস্থা করে।
১৯৭৪ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমি জাতীয় সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐ সম্মেলনের উদ্বোধন করেন। এ উপলক্ষে বাংলা একাডেমি তাদের প্রকাশিত বই প্রদর্শন ও ম্যুরাল প্রদর্শনীর আয়োজন করে। বই প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন অধ্যাপক আবু মোহাম্মেদ হবীবুল্লাহ। ঐ সম্মেলনকে সামনে রেখে বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমির পূর্বদিকের দেয়াল বরাবর যে যার মতো কিছু স্টল নির্মাণ করে বই বিক্রির ব্যবস্থা নেয়। এ বিষয়ে বাংলা একাডেমির কোনো ভূমিকা ছিলো না শুধুমাত্র জায়গা দেওয়া ছাড়া।
১৯৭৫ সালে বাংলা একাডেমি মাঠের কিছু জায়গা চুনের দাগ দিয়ে প্রকাশকদের নির্দিষ্ট করে দেয়। প্রকাশকেরা নিজেদের ইচ্ছে মতো স্টল তৈরি করে বই বিক্রির ব্যবস্থা করেন। এই ব্যবস্থা চলতে থাকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত। তখন পর্যন্ত এই আয়োজনের কোনো স্বীকৃতি ছিলো না এবং কোনো নামও ছিলো না। ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত বাংলা একাডেমির অনুষ্ঠানসূচিতেও এই কার্যক্রমের কোনো উল্লেখ করা হয়নি।
১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ছিলেন ড. আশরাফ সিদ্দিকী। তিনি একাডেমিকে মেলার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত করেন। ১৯৭৯ সালে মেলার সঙ্গে যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি। এ সমিতিরও প্রতিষ্ঠাতা শ্রী চিত্তরঞ্জন সাহা। তখন অমর একুশে উপলক্ষে ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বইমেলা অনুষ্ঠিত হতো। মেলার তখনকার নাম ছিলো একুশে গ্রন্থমেলা।
১৯৮১ সালে একুশে গ্রন্থমেলার মেয়াদ কমিয়ে ২১ দিনের পরিবর্তে ১৪ দিন করা হয়। প্রকাশকদের দাবির মুখে ১৯৮২ সালে আবার মেলার মেয়াদ ২১ দিন করা হয়। বাংলা একাডেমি মেলার উদ্যোক্তা আর সহযোগিতায় ছিলো জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র ও বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি। ১৯৮৩ সালে মেলার সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রকে বাদ দেওয়া হয়। ১৯৮৪ সালে মেলার নামকরণ করা হয় ‹অমর একুশে গ্রন্থমেলা›।
বাড়তে থাকে প্রকাশকদের সংখ্যা, বাড়াতে হয় মেলার পরিসর। ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারির শ্রী চিত্তরঞ্জন সাহার চটের ওপরের সেই ৩২ খানা বইয়ের মেলা আজ হয়ে উঠেছে বাঙালির প্রাণের মেলা। পরিনত হয়েছে লেখক, প্রকাশক ও পাঠকদের মিলন তীর্থ। ১৯৮৪ সাল থেকে নিয়মিতভাবে পুরো ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা।

মেলায় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সারিবদ্ধ স্টলের মধ্যে একপাশে থাকে শিশু কর্ণার। আরেক পাশে থাকে সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের স্টল। মেলা চত্বরকে ভাগ করা হয় ভাষা-শহীদদের নামে অথবা বাংলা সাহিত্যের দিকপালদের নামে। বহেড়া তলাকে রাখা হয় লিটল ম্যাগাজিন চত্বর হিসেবে। মেলায় থাকে মিডিয়া সেন্টার, লেখক কর্ণার ও তথ্য কেন্দ্র। মেলা প্রাঙ্গণ থাকে ধূমপানমুক্ত, হকারমুক্ত এবং পলিথিনমুক্ত। কড়া নিরাপত্তা বাহিনীর পাশাপাশি রাখা হয় বিশেষ টাস্ক ফোর্স।
এবারের বইমেলায় আমার চেনাজানা অনেকের বই বেরিয়েছে। কবি গল্পকার মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ লিখেছেন ্র বিধ্বস্ত জীবন এবং একটি নোলক ্র নামে একটি গল্পগ্রন্থ, প্রকাশ করেছে প্রিয় বাংলা প্রকাশন, পাওয়া যাবে ৫৯৭ ও ৫৯৮ নম্বর স্টলে। কবি শাহ মুজতবা রশীদ আল কামাল লিখেছেন ্র নীলিমায় নকশিকাঁথার রঙ ্র নামে একটি কাব্যগ্রন্থ। গ্রন্থ খানা প্রকাশ করেছে এবং মানুষ প্রকাশনী, পাওয়া যাবে ১৮৩ নম্বর স্টলে। কবি এম এল আর বিপ্লব লিখেছেন ্র প্রজন্মকাল ্র নামে একটি কাব্যগ্রন্থ। গ্রন্থ খানা প্রকাশ করেছে প্রিয়জন প্রকাশনী, পাওয়া যাবে ২৪১ ও ২৪২ নম্বর স্টলে। কবি সামছুদ্দোহা ফজল সিদ্দিকী লিখেছেন “ রক্তে লেখা নাম ্র নামে একটি কাব্যগ্রন্থ। গ্রন্থ খানা প্রকাশ করেছে পূর্ব সিলেট প্রকাশনী, পাওয়া যাবে ৫০০ নম্বর স্টলে। তরুণ কবি এইচ মাহমুদ চারুতরু ও আইনাল হক সম্পাদনা করেছেন দশজন কবির একটি যৌথ কাব্যগ্রন্থ ্র শব্দসোপানে অবারিত রোদ ্র। প্রকাশ করেছে পূর্ব সিলেট প্রকাশনী, পাওয়া যাবে ৫০০ নম্বর স্টলে।
মেলা চলাকালীন প্রতিদিনই বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা সভা হয়, কবিতা পাঠের আসর বসে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় থাকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। তথ্য কেন্দ্র থেকে প্রকাশ করা হয় মোড়ক উন্মোচনের খবর, লেখক ও প্রকাশকের নাম। বিভিন্ন রেডিও এবং টিভি চ্যানেল প্রচার করতে থাকে মেলার তাৎক্ষণিক সংবাদ। এবারের ‹অমর একুশে গ্রন্থমেলা›ও এর ব্যতিক্রম নয়। তাই দেরি নয়, চলে আসুন প্রাণের মেলায় অমর একুশে গ্রন্থমেলায়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন