Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

যে কারণে মিশরের ঘনিষ্ঠ হচ্ছে ভারত

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ২৭ জানুয়ারি, ২০২৩, ৩:০২ পিএম

গত বুধবার মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাতা আল-সিসি ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দিল্লিতে একযোগে ঘোষণা করেন, তারা দুই বন্ধু দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে "স্ট্র্যাটেজিক সম্পর্কে"র মাত্রায় উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এরপর বৃহস্পতিবার ভারতে প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজে প্রধান অতিথির আসনে ছিলেন সিসি, যে সামরিক প্যারেডে অংশ নিয়েছিল মিশরের সেনাবাহিনীর একটি দলও।

মিশরই আরব বিশ্বের প্রথম কোনও দেশ, যাদের সঙ্গে ভারত এ ধরনের ঘনিষ্ঠ কৌশলগত সম্পর্কে প্রবেশ করল। বস্তুত প্রতিরক্ষা থেকে অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি – সব খাতেই ব্যাপক সহযোগিতার কথাও ঘোষণা করেছে এই দুই দেশ। নরেন্দ্র মোদীর প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলে প্রেসিডেন্ট সিসি এনিয়ে নিয়ে তিনবার ভারত সফরে এলেন। কোভিড মহামারির জন্য বিশ্বব্যাপী লকডাউন শুরু না-হয়ে গেলে ২০২০ সালের গোড়ায় প্রধানমন্ত্রী মোদীরও মিশর সফর করার কথা ছিল। তখনকার মতো স্থগিত হয়ে যাওয়া সেই সফর অচিরেই অনুষ্ঠিত হবে বলেও ইঙ্গিত মিলেছে।

সার্বিকভাবে গত মাত্র সাত-আট বছরের মধ্যে যে মিশর ও ভারতের সম্পর্কে অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে এবং দুই দেশের নেতাদের মধ্যে যে একটি পারস্পরিক আস্থার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, সেই লক্ষণ স্পষ্ট। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে মূলত ভারত, মিশর ও যুগোশ্লোভিয়ার নেতৃত্বে যখন নির্জোট আন্দোলন (ন্যাম) দানা বাঁধছে, দিল্লি ও কায়রোর সুসম্পর্ক আবার সেরকম উচ্চতায় পৌঁছতে চলেছে বলেও বহু পর্যবেক্ষক ধারণা করছেন – যদিও এখনকার পরিপ্রেক্ষিত সম্পূর্ণ ভিন্ন। একটি হিন্দুত্ববাদী দল যখন ভারতের ক্ষমতায়, তখন আরব দুনিয়ার নেতৃস্থানীয় দেশ মিশরের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের এই ঊর্ধ্বমুখী গ্রাফ আপাতদৃষ্টিতে বিস্ময়কর হলেও এর পেছনে অনেকগুলো ফ্যাক্টর আছে বলেই তারা মনে করছেন।

ভারতের কাছে মিশরের গুরুত্ব কোথায়?

ভৌগোলিকভাবে মিশরের অবস্থান বিশ্বের এমন একটা জায়গায় যেটাকে ইউরোপ, আফ্রিকা আর মধ্যপ্রাচ্যের সংযোগস্থল বলা যেতে পারে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ রুট সুয়েজ ক্যানাল মিশরই নিয়ন্ত্রণ করে। দিল্লিতে নিরাপত্তা বিশ্লেষক সি রাজামোহন মনে করেন, “এই ইউনিক স্ট্র্যাটেজিক লোকেশনের কারণেই বৈশ্বিক রাজনীতি ও কূটনীতির বহু সিদ্ধান্তকে নানাভাবে প্রভাবিত করার একটা ক্ষমতা মিশরের আছে।”কায়রোর আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়কেও বিশ্বে ইসলামী ভাবধারা ও মতাদর্শের একটি দিশারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য করা হয়।

সি রাজামোহনের কথায়, “মডারেট বা মধ্যপন্থী সুন্নি আরব দেশগুলোর সঙ্গে জোট করলে তা মধ্যপ্রাচ্যে যেমন, তেমনি দক্ষিণ এশিয়াতেও শান্তি ও সুস্থিরতার পথ প্রশস্ত করবে এটা ভারত অনেক দিনই উপলব্ধি করেছে। তাদের সেই প্রচেষ্টার একটা খুব বড় অংশ হল মিশর।”একই পটভূমিতে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সউদী আরবের সঙ্গেও সাম্প্রতিককালে ভারতের ঘনিষ্ঠতা অনেক বেড়েছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাও তাদের ‘ডিব্রিফিং’য়ে বলছেন, প্রেসিডেন্ট সিসি-কে দিল্লি খুবই শক্তিশালী একজন নেতা হিসেবে মনে করে – যিনি সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলায় দৃঢ়তা ও সঙ্কল্পের পরিচয় দিয়েছেন।

তারা আরও মনে করিয়ে দিচ্ছেন, অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কান্ট্রিজের (ওআইসি) মঞ্চেও একাধিকবার মিশরের আপত্তিতে ভারত-বিরোধী প্রস্তাব গ্রহণ করা যায়নি, কিংবা কাশ্মীর নিয়ে বিবৃতির সুর নরম করতে হয়েছে। যে তথাকথিত "সীমান্ত-পারের সন্ত্রাসবাদ" বহু বছর ধরে ভারতের উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তার কারণ, প্রেসিডেন্ট সিসি ও প্রধানমন্ত্রী মোদী বুধবার দিল্লিতে একযোগে ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তার নিন্দাও জানিয়েছেন। এই মুহুর্তে ভারতের যোধপুরে দুই দেশের বিশেষ বাহিনী প্রথমবারের মতো যৌথ সামরিক মহড়ায় সামিল, আগামী সেপ্টেম্বরে ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর তিনটি শাখার সদস্যরাই যৌথ অনুশীলনে অংশ নিতে মিশরে যাবেন। মিশর ভারত থেকে যুদ্ধবিমান, ক্ষেপণাস্ত্র ও নানা প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কেনার ব্যাপারেও কথাবার্তা চালাচ্ছে।

প্রতিরক্ষার পাশাপাশি বাণিজ্যিক ক্ষেত্রেও ভারত ও মিশরের সহযোগিতার পরিসর বাড়ছে হু হু করে। ২০২১-২২ অর্থ বছরে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের মোট পরিমাণ সোয়া সাতশো কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে, যা তার আগের বছরের তুলনায় ষাট শতাংশ বেশি। মিশরে নিযুক্ত ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত নাভদীপ সুরি বলছেন, “মিশরের সঙ্গে কিন্তু পৃথিবীর বহু দেশের ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট বা অবাধ বাণিজ্যের চুক্তি আছে। ফলে ভারতীয় কোম্পানিগুলো সে দেশে প্লান্ট স্থাপন করলে তাদের জন্য ইউরোপ, আফ্রিকা বা মধ্যপ্রাচ্যের নতুন নতুন বাজারে ঢোকা অনেক সহজ হবে।”

মিশরের কী লাভ?

ওয়াশিংটন-ভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক মিডল-ইস্ট ইনস্টিটিউটের গবেষক মোহাম্মদ সোলায়মান মিশর-ভারত সম্পর্ক নিয়ে চর্চা করছেন বহুদিন ধরেই। সোলায়মানের কথায়, “আসলে মিশর ও ভারতের মধ্যে আদর্শ স্ট্র্যাটেজিক ও অর্থনৈতিক অংশীদার হয়ে ওঠার সব লক্ষণই আছে।”“মিশর মনে করে ভারত হল এমন একটি দেশ, নিজেদের সার্বভৌমত্ব ও আদর্শের সঙ্গে কোনও আপোষ না-করেই যাদের সঙ্গে সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। অন্য বহু দেশের ক্ষেত্রেই এই কথাটা কিন্তু খাটে না।” তিনি আরও মনে করিয়ে দিচ্ছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মিশর যখন গুরুতর খাদ্য সঙ্কটের সম্মুখীন তখন ভারত তাদের গম রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা থেকেও মিশরকে ছাড় দিয়েছিল।

ফার্মাসিউটিক্যালস বা ওষুধ উৎপাদনের ক্ষেত্রে, ভ্যাকসিন সরবরাহেও দিল্লি ও কায়রো সম্প্রতি পরস্পরকে অনেক সাহায্য করেছে। ফলে ইউক্রেন যুদ্ধ ও কোভিড-১৯ও দুই দেশকে আরও কাছাকাছি এনেছে। তবে এই মুহুর্তে মিশর তাদের "সুয়েজ ক্যানাল ইকোনমিক জোন"কে একটি গ্লোবাল প্রোডাকশন হাব হিসেবে গড়ে তোলার যে উচ্চাকাঙ্ক্ষী পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে, সেখানে তারা ভারতের আরও সক্রিয় ও বৃহত্তর যোগদান আশা করছে। এ অর্থনৈতিক জোনটি হল প্রায় ৪৬০ কিলোমিটার লম্বা একটি চ্যানেল তথা বাণিজ্যিক হাব, যেখানে আফ্রিকা, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের মাঝে অন্তত ছটি বন্দর থাকবে। সাবেক ভারতীয় কূটনীতিক নাভদীপ সুরি জানাচ্ছেন, “এই সুয়েজ ক্যানাল ইকোনমিক জোনে চীন কিন্তু ইতিমধ্যেই বিভিন্ন প্রকল্পে ১০০ কোটি ডলারেও বেশি বিনিয়োগ করে ফেলেছে। এটা তাদের বেল্ট রোড ইনিশিয়েটিভের একটা অংশও বটে।”

এখানে চীনের তুলনায় ভারত এখনও অনেক পিছিয়ে থাকলেও সুয়েজে ভারতের সরকার ও বেসরকারি শিল্পসংস্থাগুলোর বিনিয়োগের খুব বড় অবকাশ ও সুযোগ আছে বলেই সুরি মনে করেন। প্রসঙ্গত চীনের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী চিন গাং দায়িত্ব নেওয়ার পর তার আফ্রিকা সফরের শেষ ধাপে দিনদশেক আগেই কায়রো ঘুরে এসেছেন। প্রেসিডেন্ট সিসি এবং মিশরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন, সুয়েজ ক্যানালে ও মিশরের অন্য অবকাঠামো প্রকল্পগুলোতে তাদের বিনিয়োগের ধারা অব্যাহত থাকবে। চীনা লগ্নির বহরের সঙ্গে ভারতের হয়তো টেক্কা দেওয়া সম্ভব নয়, কিন্তু মিশর মনে করছে তাদের দেশের শিল্প ও ইনফ্রা খাতে ভারতও খুব বড় একটা ভূমিকা পালন করতে পারে। সূত্র: বিবিসি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভারত


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ