শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
হে সূর্য!
শীতের সূর্য
হীম শীতল সুদীর্ঘ রাত কাটাই
তোমার প্রতীক্ষায়
কবি সুকান্তের এই উক্তির বিশেষত্ব শীতের শিশির ভেজা সময়কে চোখে ভাসায়। হেমন্তের স্নিগ্ধতা আর প্রাচুর্য নিয়ে বাংলার প্রকৃতি যখন সুখের আমেজে টইটুম্বুর তখনই আসে শীতকাল। শীতের হাওয়া মনে হলেই হৃদয়ে অন্যরকম অনুভূতি কাজ করে। এ সময় গাছপালা শুষ্ক ও বিবর্ণ হয়ে পড়ে। শুরু হয় পাতা ঝরার খেলা। শীতের রুক্ষতা এবং নির্মমতায় সমগ্র প্রকৃতি বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। সরষে হলুদ ফুলছাপ ফ্রক গায়ে মাঠের নয়নকাড়া হাসি নিয়ে ধরিত্রী, পরিযায়ী পাখির মতো কুয়াশার সাদা সাদা ডানা মেলে উড়ে আসে এক পৌষ প্রাতে। উত্তরের হাওয়ায় দোলে হাঁড় কাঁপানো শীত। আর এই হাঁড় কাঁপানো শীত ভুলে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ধরেন গান। ভাটিয়ালি সুরে সুর মিলিয়ে কৃষকেরা ধান কাটে।
পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে, আয়রে চলে আয় আয় আয়
ডালা যে তার ভরেছে আজ পাকা ফসলে মরি হায় হায় হায়।
প্রকৃতি তার রূপসজ্জার অলঙ্কার ছুঁড়ে ফেলে রিক্ত বৈরাগ্যতা বেছে নেয়। বাঙালির শীত মানেই গরম কাপড়, কাঁথা, লেপ ইত্যাদি জড়িয়ে সময় কাটানো। শীতের রোদ যেন সোনার হরিণ। স্নিগ্ধ শীতল শীতের সকাল আর্বিভূত হয় এক ব্যতিক্রমী সৌন্দর্যের ও মাধুর্যের রূপ নিয়ে। কুয়াশা ও শিশির সিক্ত প্রকৃতি সহসা দূর করে স্বল্পকালের মধ্যে শীতের সকাল এক অপরূপ সূর্যের কাঁচা আলোতে ঝলমল।
বিখ্যাত কানাডিয়ান লেখক ও সাংবাদিক ঔঙঐঘ এঊউউঊঝ এর প্রার্থনা ছিল এইরূপ,
ও ঢ়ৎধু ঃযরং রিহঃবৎ নব মবহঃষব ধহফ শরহফ ধ ংবধংড়হ ড়ভ ৎবংঃ ভৎড়স ঃযব যিববষ ড়ভ ঃযব সরহফগ্ধ
শহরের শীত যেন ভিন্ন আমেজ। ব্যস্ত নগরে শীতের অনুভব যেন অনুভূতিহীন। এখানে কুয়াশার ঘ্রাণে উড়ে ট্রাফিক জ্যামের গন্ধ। শীত হুট করে আসে আবার যাওয়াটাও হুটহাট। শহুরে লোকেরা শীতের সকাল কাটায় চা কিংবা কফির কাপে চুমুক দিয়ে দিয়ে খবরের কাগজে মুখ ঢুকিয়ে। শহরের শীতে কুয়াশাঘেরা সকাল আসে কিন্তু তাতে থাকে না কোনো শিশিরভেজা মেঠোপথ, কাঁচা রস, পিঠেপুলি আর ভাটিয়ালি সুর।
কবি সুফিয়া কামাল ছোটবেলার শীতকে স্মরণ করেছেন এভাবে,
পৌষ পার্বণের পিঠা খেতে বসে খুশীতে বিষম খেয়ে আরও উল্লাস পড়িয়াছে মনে মায়ের বকুনি খেয়ে।
কুলের কাঁটার আঘাত সহিয়া কাঁচা পাকা কুল খেয়ে অমৃতের স্বাদ যেন লভিয়াছে গাঁয়ের দুলালি মেয়ে।
সোভিয়েত লেখক চেখভ তো সরাসরিই বলেছেন,
মানুষ সুখী হলে জানতে চায় না এটি শীত না বসন্ত।
তবে এখানে রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ মত ভিন্ন,
আমিও সারারাত মৃত মানুষের শীতে শীতার্দ্র হয়েছিলাম।
হেমন্তের শেষ বিকেলের আলো ফুরিয়ে গেলে, শীতের সজারু কাঁটা ধীরে ধীরে গেঁথে ফেলে উত্তরের জনপদ । আর এই সময়কে যথার্থ মূল্যায়ন করেছেন আমেরিকান ঔপন্যাসিক জর্জ আর আর মার্টিন,
উত্তর থেকে শীতল বাতাস বইছিল এবং গাছগুলি জীবন্ত জিনিসের মতো সশব্দে পরিণত হয়েছিল।
পিঠা, গ্রামের বাড়িতে পিঠা তৈরির হিড়িক লেগে যায়। গরম ভাপা পিঠা খুবই মজা। আরো মজার চিতই, দুধ চিতই, ম্যারাপিঠা, বড়াপিঠা ও পাটিসাপটা। এছাড়াও দুধপুলি, ক্ষীরপুলি, চন্দ্রপুলি মালপোয়া, আন্দেশা, এলাকেশী ও পাকোয়ান পিঠারও বেশ কদর। শীতের হাওয়ায় নকশী পিঠার কথা না বললেই নয়। খেঁজুর কাটা, মন কাটা, আর বাঁশের ছিকলা দিয়ে তৈরি হয় নানা রকম নকশা। গাঁয়ের বধূরা পিঠার গায়ে ছবি আঁকতে ভুল করে না। যেমন; পাতা, কুঁড়েঘর, ঘুড়ি, পাখা ইত্যাদি। পিঠার নামও রয়েছে হরেক রকমের কাজল লতা, শংখলতা, সাজনিবাহার, মেঘডুমুর ইত্যাদি। কোন পিঠা শক্ত কোনোটা নরম আবার ঝাল আর মিষ্টিও আছে।
বাংলার চিরাচরিত প্রবাদ ্রমাঘের শীতে বাঘ পালায়গ্ধ এ যেন এক হুঙ্কার যা অরন্য ছেড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে লোকালয়ে । আবার এই শীতকে কড়া জবাব দেয়া আছে জাপানি প্রবাদে, ্রএ ধরনের শব্দ শীতের গরম করতে পারে।
শীতকে ঘিরে পোশাকের ভিন্নতা যেন বিশেষ আকর্ষণ। চাদর, সোয়েটার, টুপি, মোজা, জ্যাকেট আরো কত কি!
শীত যেন নীরবতা ও অন্ধকারের অনুভূতি। শীত মন ও হৃদয়কে গভীরভাবে স্পর্শ করে। শীতকালকে তাই সম্ভাষণ।
জগৎ খ্যাত সাহিত্যিক্রটেরি গিলিমেটস ও কিন্তু শীতকালকে স্বাগত জানাতে ভুলেননি। লিখেছেন,
স্বাগতম শীতকাল। আপনার দেরি হয়ে গেছে এবং
শীতল নিশ্বাস আমাকে অলস করে দিচ্ছে কিন্তু আমি তবুও আপনাকে ভালোবাসিগ্ধ।
এ ভালোবাসা হলো পালাবদলের ধারা । ধূসর আকাশের আয়নায় কুয়াশাবৃত প্রকৃতির লীলা দেখে দেখে যেন নিজেদের ঢেলে সাজানোর নব উদ্দীপনা।
কবি কাজী নজরুল তাঁর শীত বন্দনায় লিখেছেন,
ওগো মোর লীলা সাথী অতীত বরষার
আজিকে শীতের রাতে নব অভিসার।
তবে এ ভাবনার মূলসুর শেলীর লেখায় দেখা গিয়েছিল
ড়য, রিহফ, রভ রিহঃবৎ পড়সবং, পধহ ংঢ়ৎরহম নব ভধৎ নবযরহফ.
কুয়াশার জরায়ু ছিঁড়ে সূর্য্য প্রসবে সকাল গড়িয়ে যায় দিনে । পৌষ গড়ায় শীতে মগ্ন এক মাঘে । ভেজা খড়ের গন্ধ মেখে শীতের রিক্ত মাঠ শুয়ে থাকে অবসরে।
প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ তো শীতকে নারীর মতোই লালন করেছেন,
এ-সব কবিতা আমি যখন লিখেছি বসে নিজ মনে একা;
চালতার পাতা থেকে টুপ্ টুপ্ জ্যোৎন্সার ঝরেছে শিশির
কুয়াশার স্থির হয়ে ছিল ম্লাম ধানসিঁড়ি নদীটির তীরগ্ধ।
তবে ফুটপাত, টার্মিনাল, রেলওয়ে স্টেশনে ছিন্নমূল, ভাসমান মানুষের কম্পিত দেহ যেন শীতকে তীব্রভাবে কটাক্ষ করে, তিরষ্কার জানায় তার আগমনকে। শীতে আনন্দ নয়, নিরানন্দে খাবি খায় ওসব জীবন। সচেতন মহল এগিয়ে এলে সাহায্যের হাত প্রসারিত করে দিলে শীত হবে সর্বসাধারণের উপভোগীয় বিষয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।