শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
আমি কান পেতে শুনি।বাতাসে জাম গাছের পাতার সর সর শব্দ হয়।সব মিলিয়ে হৃদয় হা হা করে উঠে।আদিগন্ত বিস্তৃত শূন্যতায় কী বিপুল বিষণ্ণতাই না অনুভব করি।জানালার ওপাশের অন্ধকার থেকে আমার সঙ্গীরা আমায় ডাকে।একদিন যাদের সঙ্গ পেয়ে আজ নিঃসঙ্গতায় ডুবছি।”(শঙখনীল কারাগার)
প্রয়াত ঔপন্যাসিক হুমায়ুন আহমেদ বাংলা কথাসাহিত্যের ভুবনে এক প্রবাদ পুরুষ।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা দিয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়।কিন্তু সাহিত্য -চর্চার জন্য অধ্যাপনা থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহন করেন।তিনি কথা-সাহিত্যিক, নাট্যকার, চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে বিপুল খ্যাতি অর্জন করেন।তিনি প্রায় দুই শতাধিক গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য উপন্যাস: নন্দিত নরকে,নীল অপরাজিতা,প্রিয়তমেষু, জয়জয়ন্তী, অয়োময়,এলেবেলে ইত্যাদি।তাঁর নির্মিত উল্লেখযোগ্য চলচিত্র: শঙখনীল কারাগার, আগুনের পরশমণি,শ্যামল ছায়া,শ্রাবণ মেঘের দিন,ঘেঁটুপুত্র কমলা উল্লেখযোগ্য।
বিংশ শতাব্দীর জনপ্রিয় বাঙালি কথাসাহিত্যিকের মধ্যে তাকে অন্যতম মনে করা হয়।তাকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী একজন শ্রেষ্ঠ লেখক এবং বাংলা কথাসাহিত্যে তাঁকে সংলাপপ্রধান নতুন শৈলীর জনক হিসেবেও ধরা হয়।তাঁর রচনার বৈশিষ্ট্যের অন্যতম দিক হলো গল্প-সমৃদ্ধি।অনায়াসে তিনি বিশ্বাসযোগ্যভাবে অতিবাস্তব ঘটনাবলীর অবতারণা করেন যা একপ্রকার যাদু বাস্তবতা মনে হয়।
তাঁর গল্প,উপন্যাস সংলাপপ্রধান।পরিমিত বর্ণনা,সামান্য কয়েকটি বাক্যের মধ্যে চরিত্র চিত্রণের দক্ষতা রয়েছে।লক্ষণীয় বিষয় হলো তাঁর কোনো রচনার রাজনৈতিক প্রণোদনা নেই।সকল রচনাতেই একটি প্রগাঢ শুভবোধ ক্রিয়াশীল থাকে; ফলে নেতিবাচক চরিত্রও তাঁর লেখনীতে লাভ করে দরদী রূপায়ণ।অসংখ্য রচনায় ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, উপলব্ধি এবং প্রচ্ছাপ অনুধাবন করা যায়।ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে রচিত মধ্যাহ্ন উপন্যাস তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা। এ ছাড়াও জোছনা জননীর গল্প বড় মাপের রচনা যা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ অবলম্বন করে রচিত। সমসাময়িক বিষয় নিয়েও তাঁর প্রচুর লেখা রয়েছে।
হুমায়ুন আহমেদ সহজ-সরল চলতি
ভাষায় উপন্যাস রচনা করেছেন।পাঠক সমালোচক সবাই তাঁর ভাষা জ্ঞানে মুগ্ধ।তাই অতি সহজে তাঁর উপন্যাস দিনদিন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।তাঁর উপন্যাসের ভাষা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গোলাম মুরশিদ বলেছেন, ‘পাঠককে নিজের দিকে টানার এবং ধরে রাখার তাঁর আর একটা কৌশল হলো তাঁর ভাষা। ... অনেক বছর থেকেই হুমায়ূন স্রোতের মতো সহজ গতিতে প্রবাহিত হয়- এরকমের একটা ভাষা আয়ত্ত করেছিলেন। তার ভাষা পড়তে গিয়ে হোঁচট খেতে হয় না।
তিনি আরও বলেন- আমাদের দেশের কথাসাহিত্যের একটা বড় দুর্বলতা হলো আমাদের কথাসাহিত্যের ভাষা-বর্ণনার, তার থেকেও বেশি সংলাপের ভাষা। ... তাদের ভাষাটা স্বচ্ছন্দে পড়া যাচ্ছে কি না, সে সম্পর্কে অনেক ঔপন্যাসিক সচেতন নন। ... চলতি ভাষার মতো হচ্ছে কি না, তাও একবার বিচার করে দেখেন না।’গল্প,উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে ভাষার মাধুর্যতা না থাকলে পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করে না। রসালো ভাষার মাধুর্য পাঠকের আবেগ- অনুভূতিতে নাড়া দেয়।পাঠক মন্ত্রমুগ্ধের ঘোরে নিমজ্জিত হয়ে উপন্যাসের চরিত্রে নিজেকে আবিষ্কার করে।হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাসের চরিত্রে যখন যা প্রয়োজন প্রয়োগ করেছেন।যার ফলে একজন সফল ঔপন্যাসিক হিসেবে তাঁর মর্যাদা উচ্চতায়।
শব্দ প্রয়োগে তাঁর ছিল অগাধ সচেতনতা। লোকজ শব্দ
এমন এমনকি সংস্কৃত শব্দ চলতি ভাষার ভিতর সহজভাবে গেঁথে দিতেন,পাঠকের পড়তে বা বুঝতে কোনো অসুবিধা হতো না।ছোট ছোট বাক্যে চরিত্রের মুল বক্তব্য তুলে ধরার দক্ষতা তাঁর অসাধারণ। তাঁর লেখা প্রথম উপন্যাস নন্দিত নরকে এর কিছু অংশ উদ্বৃত করছিÑ
বেশ একটি লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে আনতে হবে। রূপবতী কিন্তু সাধাসিধা, নাহার মেয়েটির মতো।
মা কল্পনায় সুখের সাগরে ড়ুব দিলেন।
শহরে তুই বাসা করবি?
তা তো করতেই হবে।
বেশ হবে, মাঝে মাঝে তোর কাছে গিয়ে থাকব।
মাঝে মাঝে কেন, সব সময়ে থাকবেন।
না রে বাপু, সংসার ফেলে যাব না।
মা ছেলেমানুষের মতো হাসলেন। আমি বললাম, প্রথম বেতনের টাকায় আপনাকে কী দেব মা?
তোর বাবাকে একটা কোট কিনে দিস, আগেরটা পোকায় নষ্ট করেছে।
বাবারটা তো বাবাকেই দেব, আপনাকে কী?
মা রহস্য করে বললেন, আমায় একটা টুকটুকে বউ এনে দে।
মাস্টার কাকাও খবর শুনে খুশি হলেন। তাঁর খুশি সব সময়ই মৌন। এবার একটু বাড়াবাড়ি ধরনের আনন্দ করলেন। নিজের টাকায় প্রচুর মিষ্টি কিনে আনলেন। অনেক মিষ্টি। যার যত ইচ্ছে খাও। কাকা বললেন, সুখ আসতে শুরু করলে সুখের বান ডেকে যায়, দেখো খোকা, কত সুখ হবে তোমার।
রুনু স্কুল থেকে এসে বলল, দাদা, তোমার নাকি বিয়ে?
কে বলেছে রে?
মা, হি হি।
খুব হি হি, না? তোকে বিয়ে দি যদি?
যাও, খালি ঠাট্টা। কাকে তুমি বিয়ে করবে দাদা?
দেখি ভেবে! উপর্যুক্ত উদ্বৃতি থেকে সহজে অনুমেয়, তাঁর উপন্যাসের ভাষা,শব্দ প্রয়োগ কেমন স্বাভাবিক,সাবলীল।
উপন্যাসের কাহিনী নির্মাণেও তাঁর ক্ষমতা অপরিসীম। মানুষের দৈনন্দিন
জীবনের সুখ-দুঃখ,রোমান্টিকতা, প্রেম-বিরহ উপন্যাসের বিষয়বস্তু।
হুমায়ুন আহমেদ একুশে পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হন।দেশের বাইরে ও তাঁকে নিয়ে প্রবল আগ্রহ।তাঁর বেশ কটি উপন্যাস ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে।একটি উপন্যাস গৌরীপুর জংশন সাতটি ভাষায় অনুবাদ হয়েছে।বাংলা সাহিত্যে হুমায়ুন রচনাবলি এক বিরাট সংযোজন। মিসির আলি এবং হিমু তাঁর সৃষ্ট অন্যতম দুটি জনপ্রিয় চরিত্র।মানুষ হিসেবে তাকে হিমু এবং মিসির আলির মতোই রহস্যময় বলে মনে হয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।