শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
গ্রাম ছাড়া ওই রাঙ্গামাটির পথই (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) শুধু নয় পৃথিবীর অনেক দৃশ্য এবং অনেক বস্তুই অহরহ আমাদের মন ভুলায়। তার মধ্যে বিশেষ আকর্ষণ হচ্ছে একটি বিজ্ঞাপন।
বিজ্ঞাপন প্রচারের সবচেয়ে প্রাচীন মাধ্যম বোধকরি সংবাদপত্র। তারপর এসেছে বেতার এবং সবশেষে টেলিভিশন। কিন্তু লক্ষ্য করা গেছে প্রাচীন বা আদিযুগের সংবাদ পত্রের অন্যতম আকর্ষণ ছিলো বিজ্ঞাপন। তাই, সেকালে অনেক নামি-দামি সংবাদপত্রের প্রথম পৃষ্ঠার প্রায় পুরোটাই জুড়ে থাকতো বিজ্ঞাপন। বাংলার প্রাচীন পত্রিকার ক্ষেত্রেও দেখা যায় ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্ত সম্পাদিত দৈনিক বাংলা সংবাদ পত্র “সংবাদ প্রভাকরের” (১৮৪০ খ্রি.) প্রথম পৃষ্ঠায় বিজ্ঞাপন শিরোনাম যুক্ত দুটি বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছিল। পূর্ব বাংলার প্রথম যুগের সাময়িক পত্র রংপুর দিক প্রকাশ (১৮৬০ খ্রি.) পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় প্রায় পুরোটাই জুড়ে ছিল বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপন যেহেতু আয়ের অন্যতম উৎস সে কারণে সংবাদপত্রের পরবর্তী সময়ে বেতার বা টেলিভিশনেও বিজ্ঞাপনের অনুপ্রবেশ ঘটে। সে কালের নামি-দামি কবি- সাহিত্যিকরাও বিজ্ঞাপন প্রচারের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বয়ং একদা এক বিশিষ্ট কালো কালির প্রশংসা করে লিখেছিলেন এর কালিমা বিদেশি কালির চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। রবীন্দ্রনাথের হস্তলিখিত প্রশংসাপত্রটি ব্লক করে বিজ্ঞাপন করে রুপে বহুল প্রচারিত হয়।
রবীন্দ্রনাথ জীবিতকালে বিজ্ঞাপনে নানা ভাবে হাজির হয়েছিলেন। শুধু তাই নয় মৃত্যুর পরও তাঁর ভাষ্য, বাণী, প্রতিকৃতি, হস্তাক্ষর, স্বাক্ষর ব্যবহার হয়েছে নানা পণ্যের বিজ্ঞাপনে। এসব বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছিলো আনন্দ বাজার, বসুমতী, শনিবারের চিঠি, বিশ্ব ভারতীসহ নানা সংবাদ পত্র ও সাময়িক পত্রে। বলা হয় তিনি বিজ্ঞাপনের মডেল হতে রাজি হয়েছিলেন মূলত স্বদেশী আন্দোলনের যুগে স্বদেশী পণ্য বস্তু প্রসারের জন্য।
দি ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল গেজেটের ১৯৪১ সালের অমল হোম সম্পাদিত “ঞবমড়ৎব সবসড়ৎরধষ” সংখ্যায় ডোয়ার্কিন কোম্পানী বিজ্ঞাপনে রবীন্দ্রনাথের ১২৯৫ বঙ্গাব্দের ৭ই আশ্বিন সংখ্যার প্রতিষ্ঠাতা দ্বারকানাথ ঘোষকে একটি চিঠি ছাপে “মহাশয়েষু/আপনাদের ডোয়ার্কিন ফ্লুট পরীক্ষা করিয়া বিশেষ সন্তুষ লাভ করিয়াছি, ইহার ছাপার অতি সহজেই চালান যায়- ইহার সুর প্রবল ও সুমষ্টি। ইহাতে অল্পের মধ্যে সকল প্রকার সুবিধাই আছে। দেশীয় সঙ্গীতের পক্ষে আপনাদের এই যন্ত্র যে বিশেষ উপযোগী তাহাতে সন্দেহ নাই। আমি এই যন্ত্র ক্রয় করিতে ইচ্ছা করি। আমাকে ইহার মূল্য লিখিয়া পাঠাইবেন (শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)”। বিজ্ঞাপনটি রবীন্দ্র্রনাথের মৃত্যুর ৫৩ বছর পরে চিঠিসহ প্রকাশিত হয়।
হেমেন্দ্রনাথ বসু বিখ্যাত কুন্তলীন কেশ তেলে রবীন্দ্র প্রতিকৃতির নিচে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বাক্ষরসহ লেখা থাকতো- “কুন্তলীন তৈল আমরা ২ মাস কাল পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছি। আমার কোন আত্মীয়ের বহুদিন হইতে চুর উঠিয়া যাইতেছিলো “কুন্তলীন” ব্যবহার করিয়া ১ মাসের মধ্যে তাঁহার নতুন কেশোদাম হইয়াছে। এই তৈল সুবাসিত এবং ব্যবহার করিলে ইহার গন্ধ ক্রমে দুগন্ধে পরিণত হয় না। স্বাক্ষরঃ শ্রী রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর, আশ্বিণ ১৩৩৪ বঙ্গাব্দ।
আরও কত বিচিত্রভাবে যে, রবীন্দ্রনাথকে আমরা চিনতে পারি। সেকালে বেশ কিছু বিজ্ঞাপন চিত্রে তিনি মডেল হয়েছেন। যেমন- দীপালী পত্রিকার ১ম বর্ষ ২৪ সংখ্যায় (১৯ জুন ১৯৩৭ খ্রি.), বোর্নভিটা কোম্পানীর পূর্ণ পৃষ্ঠার বিজ্ঞাপনে রবীন্দ্রনাথের ছবিসহ রবীন্দ্রনাথের স্বহস্তে “বোর্নভিটা সেবনে উপকার পাইয়াছি” লেখা বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়। এছাড়া কেশ তেল, সুরভী ক্রিম, কাজল কালি, উন্মাদ রোগের ঔষধ, লিপটন চা, ফিলিপস্ রেডিও, মার্টিন বান, রেল দপ্তর প্রভৃতি বিজ্ঞাপনেও রবীন্দ্রনাথকে সংশ্লিষ্ট করা হয়েছে।
প্রথম দিকে চায়ের বিজ্ঞাপনে তিনি যে রচনাটি ব্যবহার করতে দিয়েছিলেন সেটি হলো-
হায় হায় হায় দিন চলে যায়।.
চা-স্পৃহ চঞ্চল চাতল দল চল,
টগবগ উচ্ছল কাথলি তল-জল
এল চীন গগণ হতে পূর্ব পবন স্রোতে
শ্যামল রস ধর পুঞ্জ॥.
শ্রাবণ বাসরে রস ঝর’ ঝর’ ঝরে
পূর্ব পবন স্রোতে
ভূঞ্জ হে ভূঞ্জ দলবলহে।.
চল’ চল’ হে ॥
কল’ কল’ হে।.
বিখ্যাত একজন কবি সে’কালে চাতক তুল্য চা-রসিক সবাইকে চা-পানে আহ্বান জানিয়ে বিজ্ঞাপনে লিখেছিলেন-“চায়ের পেয়ালা যদি সাগর হতো, সাতার কাটিতাম আমি মনের মতো।” বিদ্রোহী কবি নজরুলও সেকালেও বিজ্ঞাপনমূলক কিছু কিছু কবিতা লিখেছিলেন। “ডোয়ার কিন এ্যান্ড সন্স” কোম্পানির হারমোনিয়ামের বিজ্ঞাপনে তিনি লিখেছিলেন
“কি চান? ভাল হারমোনি?
কাজ কি গিয়ে-জার্মানি?
আসুন দেখুন এই খানে
সেই সুরে আর সেই গানে,
গান না কেন, দিব্যি তাই,
মিলবে আসুন এই হেথাই?
কিনবি কিন “ডোয়ার কিন”।
“বাহাদুর কোম্পানি“র সেকালের এক বিজ্ঞাপনে নজরুল লিখেছিলেন-“মিষ্টি “বাহা বাহা ” সুর, চান তো কিনুন বাহাদুর” দু’দিন পরে বলবে না কেউ “দুর দুর”। ১৮৯৬ সালে জনৈক হেমেন্দ্র মোহন বসু তাঁর প্রস্তুত পণ্যদ্রব্য “কুন্তলীন কেশ তেল”-এর নামানুসারে এক সাহিত্য পুরস্কার প্রবর্তন করেন। এটি ছিল ছোট গল্প রচনার প্রতিযোগিত। বার্ষিক এই প্রতিযোগিতায় পুরষ্কার পাবার জন্য রবীন্দ্রনাথ তাঁর “কর্মফল” গল্পটি লিখে পাঠান। ছদ্মনামে পাঠানো শরৎচন্দ্রের প্রথম গল্প “মন্দির” কুন্তলীন সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছিলো। হেমেন্দ্র মোহন বসু প্রতিবছর প্রতিযোগিতার জন্য প্রাপ্ত গল্পগুলো সংকলন কবে সেকালে “কুন্তলীন সাহিত্য পুরস্কার” নামে গ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বিজ্ঞাপন রচনায়ও বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। তাঁর রচিত এমনি একটি বিজ্ঞাপন- “কেশে মাখো কুন্তলীন
অঙ্গবাসে দেলখোস,
পানে খাও তাম্বলীন
ধন্য হোক এইচ বোস।”
পরবর্তীকালে অনেক পুরস্কারের সঙ্গে, সে সাহিত্য পুরস্কারই হোক বা অন্য কোনো বিষয়ই হোক, বিজ্ঞাপন পণ্যের নাম সংযুক্ত হতে দেখা যায়।
আমাদের দেশে সাময়িক পত্রের বিজ্ঞাপনে রমনীর চিত্র ব্যবহারের আদি ইতিহাস আমার জানা নেই। তবে ১৯৩৪ সালের ‘সচিত্র ভারত’ পত্রিকার একটি প্রসাধন দ্রব্যের বিজ্ঞাপনে অভিনেত্রী “সাধনা বসু”র প্রতিকৃতি ব্যবহার করা হয়েছিল। বিজ্ঞাপনটি ছিল “ওয়াটিন ক্রিমের” একটি মুখে মাখা ক্রিম। তখন মডেলিংয়ের বিশেষ প্রচলন না হওয়ায় বিজ্ঞাপনের সাধারণ ঃ অভিনেত্রীদেরই আলোক চিত্র শোভা পেতো।। প্রযুক্তি অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞাপনে ও দেখা গেলো বিরাট পরিবর্তন। শুরু হলো রঙ্গিন চিত্র প্রযুক্তির যুগ। তাই বিজ্ঞাপনের পন্য ছাপিয়ে প্রাধান্য হয়ে উঠলো রঙ্গিন চিত্রের বাহার, আর মডেলিংয়ের বদৌলতে নানা রমনীর সুদৃশ্য চিত্রের জৌলুস। একালে আলোক চিত্র শিল্পী এবং চিত্রকর সম্মিলিতভাবে বিজ্ঞাপনকে সুশোভিত ও আকর্ষণীয় করে তুলেছেন। আবার কোনো কোনো বিজ্ঞাপন আছে যা বাধ্যতামূলক । যেমন পাসপোর্ট বা পরীক্ষার সার্টিফিকেট হারিয়ে গেলে ডুপ্লিকেট ইস্যু করার জন্য খবরের কাগজে অবশ্যই বিজ্ঞাপন প্রকাশ করতে হয়। বিজ্ঞাপনে বলতে হয় আমার অমুক নম্বর পাসপোর্ট অথবা অমুক পরীক্ষার সার্টিফিকেট হারিয়ে গেছে। বিজ্ঞাপন দাতা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে আমাদের যে শুধু আকৃষ্ট করেন তা’ নয়, মাঝে মধ্যে তার পণ্যক্রয়ে প্রলুদ্ধও করে থাকেন এবং ক্রেতাকে “ফাও” কিছু দেয়ার রেওয়াজ প্রয়োগ করে থাকেন। বিজ্ঞাপনের শিল্পরসে অনেক সময় চমক থাকে। অনেক সময় সুকৌশলে সাসপেন্স সৃষ্টি করা হয়। আমাদের দেশে প্রচলিত বিজ্ঞাপনগুলো ৩ শ্রেণির ভাগ করা যায়- (১) দেশীয় (২) সম্পূর্ণ বিদেশি (৩) বিদেশীয়, কিন্তু ভাষান্তরিত। কোনো কোনো বিজ্ঞাপন আমাদের ভাষা জ্ঞান বা বিবেক ও অনুভূতিকে বিপন্ন করে তোলে, বহুদিন আগে কোনো এক বিজ্ঞাপনে দেখা যায় এক কিশোরী বিশেষ পণ্যের কৌটাতে আঙ্গুল ডুবিয়ে তা’ মুখে দিয়ে চুষতে শুরু করলো। আর একটি বিজ্ঞাপনে দেখা যায়, এক প্রণায়াকাঙ্খী তরুণী তাঁর প্রিয়জনকে অভিমানের সুুরে বলে- “আমারে পছন্দ না হলেও আমার চা-রে পছন্দ হবে ।” আরেকটি বিজ্ঞাপনে শুনতে পাই, বিজ্ঞাপনের স্লোগান “চা” তো পছন্দ হবেই, কারণ চা’য়ে রয়েছে ..............বিজ্ঞাপন টি দেখে আমাদের দুঃখ বোধ হয় কারণ একটি রমনী হৃদয়ের আর্তি এখানে ভেসে গেলো স্লোগানের নিষ্ঠুর মন্তব্যে।
তা’ ছাড়া বিজ্ঞাপনে আর একটি বিষয় লক্ষ্য করা যায়, সেরা শ্রেষ্ঠ এবং উৎকৃষ্ট এ জাতীয় বিশেষণ যে হারে সব পন্য দ্রব্যের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে তাতে কোন পণ্যটি সেরা ও কোনটি সেরা নয়, তা’ নির্ণয় করার দূরুহ কঠিন হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে আমরা অবলিলাক্রমে বলতে পারি সব পণ্যই যদি সেরা হয়, তা’হলে যেকোনো একটি পণ্য কিনলেই তো’ আমাদের চলে এ নিয়ে আর কোনো ভাল মন্দ নেই।
তথ্য সূত্র ঃ
বিজ্ঞাপনের প্রকার ভেদ ঃ আব্দুল কাইউম “দৈনিক জনকন্ঠ পাক্ষিক পত্রিকা” ১৯৯৭ খ্রি.।
“ঢাকা প্রকাশ ১০০ বছর আগে”সম্পাদক ঃ কৃষ্ণ চন্দ্র মজুমদার ঃ পবাগ আজিম, দৈনিক প্রথম আলো, ১১ জুলাই, ২০০৩ খ্রি.।
“রঙ্গপুর বার্তাবহ- ১৮৪৭ খ্রি.” সম্পাদক ঃ- গুরুচরণ রায়।
রঙ্গপুর দিক প্রকাশ-১৮৬০ খ্রি.”সম্পাদক ঃ- শম্ভূচরণ রায় চৌধুরী
“সংবাদ প্রভাকর”ঃ- ঈশ্বর গুপ্ত।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।