শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
মানুষ মানুষকে উত্তমপুরুষে রূপান্তর করতে পারে, এটা বিশ্বাসযোগ্য। মহাপুরুষ না হতে পারলেও মহাপুরুষ হওয়ার ইচ্ছেটা মানুষের মাঝে আজীবন বেঁচে থাকে প্রত্যেক মানুষের উচিত, সে নিজেকে মহান করে গড়ে তোলা।
আকাশের মতো বিশাল হবার ইচ্ছা নিয়ে নিলু পূর্ণযাত্রার অর্ধপথে অক্লান্ত শরীরে বসে আছে । চেয়ে আছে ব্যাপ্তিময় মহাকাশ। মহাকাশের মতোই তাকে বিশাল হতে হয়। স্বপ্নের বিলাসিতা নিয়ে উত্তমপুরুষ হয়ে ওঠা নয় , কেবলই পৃথিবীর আত্মমর্যাদা প্রকৃষ্ট করার দৃঢ় সংকল্প নিয়েই এই যাত্রা। উত্তমপুরুষ হয়ে ওঠার তেমন কোনো কারখানা নেই , যার মাধ্যমে সে নিজেকে মহাপুরুষে পরিণত করবে। প্রচেষ্টা, আত্মবিশ্বাস, আত্মনির্ভরশীলতা, দৃঢ় সংকল্প, কর্মনিষ্ঠা, মহানুভবতা, দক্ষতা,সততা ও সৎচরিত্রের প্রয়োগযাত্রার মাধ্যমে একজন উত্তমপুরুষ ষ হয়ে ওঠা সম্ভব নিলু বুক ভরা আশা নিয়ে ঘুরে এ পথপ্রান্তরে। নিশীথরজনী গভীরে কিংবা উত্তপ্ত দুপুরের অগ্নিতপ্ত ধূলায় হেঁটে বেড়ায় মনের উৎকৃষ্ট ভাবনার তৃপ্তি মিটাতে। সে বিশ্বাস করে, পৃথিবীতে ভালোমানব বারবার জন্ম নেয় না ,
পৃথিবীর এ রঙ্গশালায় নিলু কেবল একজন উত্তমপুরুষ হতে চেয়েছে, সে আত্মবিশ্বাস’টা তার মধ্যে জাগ্রত করে দিয়েছে তাদের স্কুলের বাংলা শিক্ষক ‘আজমল স্যার’। ক্লাসে একদিন স্যার ক্লাস নেওয়ার সময় সবাইকে মানুষ হয়ে গড়ে ওঠার উৎসাহ দিয়েছেন।
চিঠির একটা খাম নিলুর হাতে , ঘামে ভিজে অক্ষরগুলো ঝাপসা হয়ে আছে । নোটবুকের মধ্যে কে যেনো রেখেছে , তা ঠিক তার জানা নেই । জানার কথাও না , নিলু কেবল ব্যস্ত থাকে নিজের ইচ্ছেগুলোকে আলোক শিখায় জ্বালানোর ভাবনায় । এবং ভাবতে ভাবতে অনায়াসে পার করে দিয়ে যায় কতদিন , কত মাস । নিলুর যখন বুদ্ধি হয়নি তখন সে মানুষ হতে চেয়েছিলো , আর যখন বুদ্ধি হয়েছে তখন মহাপুরুষ হতে চেয়েছে নিত্য ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো দ্রুত ভুলে যাওয়ার অভ্যাসটা নিলুর আছে । সে পৃথিবীর ঘন-কালো কোলাহল কিংবা মানবসম্প্রদায়ের সমাগম থেকে একেবারেই নিভৃত স্থানে আশ্রয় নেওয়ার ইচ্ছেটা লালন করে আছে , কেবল সেখানেই সে নিজেকে নিজের মতো করে রূপান্তর করতে পারবে বাকারা পৃথিবীর রূপ বদলাতে চায় , আর বুদ্ধিমান নিজেকে। নিলু কেবল নিজকে শুদ্ধ করতে প্রায় পৃথিবীর সব আনন্দ উল্লাস ভুলে থাকে । প্রেম ভালোবাসা এগুলো সহজে বুদ্ধিমান ব্যক্তির সঙ্গ ধরতে জানে না। তবে নিলুর সঙ্গ ধরতে চায় । সে ভাবে -আমি প্রায় বোকাদেরই দলে কঠিন মানুষের রূপ থাকে , সহজ মানুষের রূপ থাকে’না যা থাকে তা ব্যক্তিত্বেরই পরিচয়।
চিঠি পড়বে পড়বে ভেবে কয়েক ঘণ্টা কেটে গেলো, পড়া আর হয়নি। পড়ার সময় চেয়ে দেখে চিঠির দুরাবস্থা নেমে এসেছে । নিচের অংশে ডিজাইন করে লেখা - তোমাকে ভালোবাসি । নাম উল্লেখ নেই । নিলুর কেবল অবাকই হবার কথা। তবে এইসব প্রায় পড়তে হয় , দেখতে হয় । আকর্ষণীয় মায়া মানুষ আকর্ষণ না করা পর্যন্ত ভালোবাসা পূর্ণতা পায় না এটা মহাজাগতিক মহা একটা নিয়ম। নিলুর মধ্যে কারো জন্য মায়া জন্মায় না , জন্মানোর কথাও না । যারা নির্লিপ্ত, তাদের কাছে নির্লিপ্ততায় মহান। নিজেকে সংশোধন করতে হলে সর্বপ্রথম নির্লিপ্ত হওয়াটা প্রয়োজন , মানবসম্প্রদায় নির্লিপ্ত হতে পারেনি বলেই তারা অপদার্থতার পরিচয়ে বেড়ে ওঠছে। নিত্যদিনেই তাদের বিরুদ্ধে তাদের সমাবেশ , মিছিল , সংবাদপত্রে খুন হওয়ার শিরোনাম লোভ-লালসা, অর্থের মায়া, প্রিয়জনের মায়া সবকিছুই তাদেরকে ক্রমান্বয়ে পিশাচ করে তোলে। সকল লোভের চেয়েও ভালোবাসার লোভ মানুষকে বেশী ক্ষতিগ্র করে । তাই কেবলই নির্লিপ্ত হওয়া প্রয়োজন। নির্লিপ্ততাকে সম্মান দিতে গিয়ে নিলুর আর হয়ে ওঠেনি ভালোবাসার ছায়া গায়ে মাখা। প্রায় চিঠি আসে, তবে তা একজনের।
হাতে যে চিঠিটা, তাও পূর্বের ঠিকানা হতে আসা ।
লখার ছন্দ-তাল’ও বেশ পরিচিত ;
প্রিয় ভালোপুরুষ ,
পত্রের শুরুতে আপনার জন্য কোমল সৌরভের ভালোবাসা । আপনার চিত্তে ভালোবাসার উৎকৃষ্টতা কবে প্রকাশ পাবে, তাহা আমার অগোচরে । আমি বরাবরই মতোই জানি আপনি নির্লিপ্ত , নির্লিপ্ততাকে ভালোবাসেন। আর এ-ও জানি, ভালোপুরুষ-রা প্রণয়ের ছায়াতলে বন্দি হতে চায়-না। যদি কোনোদিন আপনার ভালোবাসার পরশ রেখা উজ্জীবিত হয় , তবে আমার ঠিকানায় একখানা চিঠি পাঠিয়েন। তবে না হয় এ জীবন ধন্য এ নিখিল ধরিত্রীতে।
ইতি
অস্পষ্ট এক দুলালী
নিলু হাঁটা শুরু করলো আপন গন্তব্যের দিকে। উদ্দেশ্য হলো স্কুলের বাংলা স্যারের কাছে যাবে। তিনি তাকে স্বপ্ন দেখাতে সাহায্য করে, বদলাতে সাহায্য করে। সারারাত স্যারের সাথে কথা বলতে বলতে কেটে যায় , তবুও শেষ হয়না কথা স্যারের কথার মাঝে নিলু কেবল নিজের উৎকৃষ্ট দিক খুঁজে পায়, খুঁজে পায় অনুপ্রেরণা । আজও এসেছে খানিকটা অনুপ্রেরণা নিতে। আজমল স্যারের কাছে নিলু একজন মহাপুরুষ, এবং তিনি বিশ্বাস করেন নিলু একদিন সত্যিকারের মহাপুরুষ হয়ে ওঠবে। আজমল স্যার নিলুর রহস্যপ্রভার কথা তেমন কাউকে বলে’নি, নিলু-যে একজন বিস্ময়কর ছেলে এটা তিনি অনুভব করেছেন। রাতের নক্ষত্রের তলে নতুন একটি সম্ভাবনাকে সামনে রেখে একটি অস্পষ্ট অপদবিওয়ালা ক্ষুদে মহাপুরুষ এবং তার স্বপ্নের কারিগর বসে আছে চন্দ্রপ্রভার ছায়া মেখে । আজমল স্যার নিলুর গায়ে হাত রেখে বলতে লাগলো , - তুই যদি ভালোপুরুষ হয়ে যাস, তাহলে’ তুই কি করে বুঝবি ?
- সেদিনের সেসময়ে আমার মধ্যে নিস্তব্ধতা বয়ে যাবে কলকল ঢেউয়ের সুরের মতো। আমি অনুভব করবো এই জগৎ-মহাজগতের সবকিছু অন্যরকম প্রভায় উজ্জীবিত । মানবসম্প্রদায়ের মধ্যে যেসকল ভেদাভেদ আছে, আমি তাহা আচমকা ভুলে যাবো ।
- মনে রাখিস, মনুষ্যত্বের মানোন্নয়নের যেনো কোনোদিনও অপব্যবহার না হয়। আমি মনে করি , তোর প্রচেষ্টা তোকে একদিন সৎ করে তুলবে। এটাই তোর শ্রেষ্ঠতা। তখনি বুঝতে পারবি, তুই এক অন্যরকম মানুষ । কারণ, সৎ চরিত্র সকলের মাঝে অর্পিত হয়না। যার কাছে হয় আমার চোখে সে এক অন্যরকম মানুষ ।
- স্যার, আমি নিত্যান্ত্বই মানুষ হয়ে ওঠার চেষ্টা করি।
- তবে, তবে তাই হোক নতুন সম্ভাবনার অগ্রযাত্রার আকাঙ্খাসমূহে। অবকাশে অবকাশে পুষ্প ফুটুক। শ্রেষ্ঠতার জন্য নিজের মধ্যে জমে থাকা সকল মায়াকে নির্লিপ্ত করে এগিয়ে যাও বহুদূর।
- শ্রদ্ধা স্যার। নিলু আর আজমল স্যার তাদের নিজেদের সংলাপ সমাপ্ত করলো। অর্ধরাতের হিম শীতলে নিলু গন্তব্য স্থির করেছে আপনালয়ে যাওয়ার জন্য । চাঁদের আলোর হালকা ঝিরঝির অন্ধকার। আজ আর তার বাড়ি যাওয়া হবে’না, সে আকাশ চেয়ে বসে আছে ভরা নদীর তীরে । তার সরল মনে সহজ প্রশ্ন জমে থাকে। - ইচ্ছে করলেই’তো সব মানুষে নিজেকে বদলে ফেলতে পারে, তাহলে পৃথিবীজুড়ে অভিশপ্তের এতো হাহাকার কেনো ? হে জগৎসংসারের স্রষ্টা , আপনি ইচ্ছে করলেই সকলের ভাগ্য রেখা নতুন করে এঁকে দিতে পারেন, পাল্টে দিতে পারেন মানুষের ভাব-ভাবনাকে।
নিলুর সহজপ্রাপ্যতা সহজে তার কাছে ধরা দিতে রাজি নয়, তবুও সে বিশ্বাসী, একদিন সে উত্তম মানুষ হয়ে ওঠবে। অপেক্ষায় তবে তাই হোক । মনে মনে সে হাসলো, যে হাসির কোনো তুলনা নেই। ভালোপুরুষের হাসির মূল্য দিবে কে ?
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।