শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
রজব আলী’র আজ ছুটি। শীতের সকালটায় আরেকটু গড়িয়ে নেয়া যেত। অথচ আজই ঘুম ভেঙে গেছে মাঝরাতে। খুব আনন্দের একটা দিন আজ। এমন দিনে ঘুমিয়ে থাকা যায় না।
রাতের বেঁচে যাওয়া কিছু ভাত লবণ আর বাসি ডাল দিয়ে চটকে পেটে চালান করে দেয় বুড়ো-বুড়ি। পেয়াজ, মরিচের দামে আগুন লেগেছে। ছোঁয়া যায় না। আটটা বাজতেই ভীরু পায়ে রজব চলে আসে স্কুল মাঠে। আজ বিজয় দিবস। চারদিক ছোট ছোট পতাকা দিয়ে সাজানো। বড় একটা মঞ্চও বানানো হয়েছে। জেলার সবচেয়ে বড় নেতা আসবেন। ‘অনেক দামি’ কিছু কথা বলবেন। রজব’কে সংবর্ধনা দেওয়া হবে। বুক উত্তেজনায় কাঁপছে তার।
‘রজব চাচা, কেমন আছেন? এত সকালে আইসা পড়ছেন পুরস্কার নিতে? নেতা আইবো দুপুরের পর। আমি গোসল কইরা আবার আসব দুপুরে। আমিও পুরস্কার নিমু’।
‘তুই কীসের পুরস্কার নিবি, নাসির’?
‘মুক্তিযোদ্ধা সংবর্ধনার পুরস্কার। আমিও সার্টিফিকেট পাইছি তো’।
রজব হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। একাত্তরের ডিসেম্বরে যেদিন ছোট এই গ্রামটার জনা দশেক মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধজয় করে ফেরত আসলেন, আরও পনেরো জনকে চিরবিদায় জানিয়ে, সেদিন নাসির সাত বছরের শিশু। খালি গায়ে একটা লুঙ্গি পরে স্বাধীন দেশের পতাকা নিয়ে খেলছে। এখনও সব চোখে ভাসছে।
মাঠের এক কোনায় রজব বসে থাকে। কেও তাকে কিছু জিজ্ঞেসও করছে না। স্কুলের ছেলে মেয়েরা সারি বেঁধে কসরত করছে। ‘ছেলেরা, নেতা এখনই চলে আসবেন। বাঁশি বাজালেই তোমরা সালাম দিবে। স্লোগান দিবে। তোমার ভাই, আমার ভাই, রাজা ভাই, রাজা ভাই। একটু ভুল হলে পিটিয়ে চামড়া তুলে নিব’।
দুপুর হয়ে যায়, নেতার আসার নাম নেই। রজব অবাক হয়ে দেখে পুরস্কার নিতে আরও আট-নয় জন গেছে। সবার হাতে সার্টিফিকেট আছে। তারতো সার্টিফিকেট নেই। তাহলে কি, তাকে পুরস্কার দেওয়া হবে না? একাত্তরে ফেরত আসা বাকি নয় মুক্তিযোদ্ধা আজ আর বেঁচে নেই। মধুপুর গ্রামের শেষ জীবিত মুক্তিযোদ্ধা রজব অনিশ্চয়তার সাগরে ডুবতে থাকে।
আজ আর যারা এসেছে পুরস্কার নিতে, সবাইকে চিনেও না রজব আলী। যাদের চিনে, একাত্তরে কারও বয়স দশের বেশি ছিল না। একজনের তো জন্মই হয়েছে যুদ্ধের পরে। কিন্তু সার্টিফিকেটের জোর অনেক বেশি। বিকেল পাঁচটার দিকে খবর আসে, নেতা আজ আসবেন না। অনেক জরুরী কাজে তিনি ঢাকা গিয়েছেন। নাসিরই হাতে একটা তেহারি’র প্যাকেট ধরিয়ে বলে, ‘চাচা, যান গিয়া। নেতা আইজ আসবে না’।
বাসায় ফিরতেই বউ জিজ্ঞেস করে, ‘সারাদিন লাগলো তোমার? কী পুরস্কার দিল তোমারে’?
শুকনো মুখে বউয়ের হাতে তেহারি’র প্যাকেট তুলে দেয় রজব। আবার রাত আসে। সন্তানহীন বুড়ো-বুড়ি বিছানায় চলে যায়। ঘুম আসে না রজবের। আবার সকাল আসে। প্রতিদিনের মত রিকশাটা নিয়ে রাজপথে নেমে যায় রজব আলী। কেও একজন ডাক দেয়, ‘এই খালি, যাবা’?
পুরস্কারের চেয়ে পারিশ্রমিক এখন বেশি মূল্যবান রজব আলী’র কাছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।