Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কদুর ফুল

মাহিরা রুবি | প্রকাশের সময় : ৪ নভেম্বর, ২০২২, ১:২২ এএম

ট্রলারের ভটভট, জাহাজের হুইসেল আর মানুষজনের চেঁচামেচিতে হাকিমের ঘুমটা ঠিক জমছেনা। লঞ্চঘাটের পাটাতনে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে ও। এই ঘাটে এর আগেও অনেকবার ঘুমিয়েছে। এই মানুষজন, শব্দ কোন কিছুতেই ঘুমের ব্যাঘাত ঘটেনি। আজ মনে হচ্ছে বাইরের কোলাহলের চেয়ে হাকিমের ভেতরের দাপটই বেশী চলছে। আধো আধো ঘুমের ঘোরে টের পায় ওর মাথায় কেউ মমতা ছিটাচ্ছে। আলতো করে হাকিম হাত দুটো ধরে ফেলে; ছোট আর নরম তুলতুলে। হাকিমের প্রথম কান্না ছিল মাকে হারানো ব্যাথা। শৈশব থেকেই ওর মন খারাপ হলে ঘুমের ভেতর মা আসে, মুখ দেখায়না, শুধু মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। কিন্তু আজ হাত দুটো এতো ছোট কেন?
কে যেন হাকিমকে ধাক্কা দিল- ও হাকিম তুই কি লঞ্চে যাবি? লঞ্চ ছাইড়ে দিচ্চেতো, গেলি জলদি ওট। হাকিম চাদরটা দলাবলা করে উঠে বসে। মাজন বিক্রেতা আবুল হাকিমকে ভাল চেনে, কাঁধে হাত রেখে বলে- ও বাপ যাবি কুহানে?
জাইননে চাচা, তয় এই অঞ্চলে আর ফিরে আসপনা।
ও হাকিম কি কইস? এহন বিয়ে শাদী এরিছিস, শুনিছি বউডা পুয়াতি, তা এহনো এইরাম বাদাইমেপনা এরলি চলে, যা বউডার দারে যা বাপ। হাকিম আবুলের কথা শেষ করতে না দিয়ে লঞ্চের দিকে এগিয়ে যায়।
টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। হাকিম লঞ্চের ছাদে বসে ভিজছে। নদীর জলে পড়া আকাশের ফোঁটা ফোঁটা জল দেখে ও আনমনা হয়ে যায়। বৃষ্টি ওর খুব প্রিয়, ভুলে যায় বৃষ্টিতে ভিজলে খানিক বাদে শুরু হবে ধারাবাহিক হাঁচি। আজ নদীকে ছাড়িয়ে হাকিমের মন কোথায় যেন ছুটে যায়। কি এক অদৃশ্য টানে এতদিনের অভ্যাসের রশিটা বোধ হয় ছিঁড়ে যাচ্ছে।
ফেরীঘাট, লঞ্চঘাট, রেলষ্টেশনই ওর ঠিকানা। এ শহর, সে শহর ঘুরে বেড়ায়। কুলিগিরি বা অন্যান্য কাজ করে যা রোজগার হয় তা দিয়ে হোটেলে ভর্তা, ভাজি আবার কখনোবা মাছ-মাংস খায়। যেদিন ভাত খাওয়ার পয়সা থাকে না, সেদিন একপোয়া আটা কিনে খানিক নুন আর পানি মিশিয়ে ঢকঢক করে গিলে খায়।
ফুলপুর রেলষ্টেশন দিয়ে মাঝে মধ্যে কয়রার ট্রেন চলে। ট্রেন চলে যাওয়ার পর রেল পাটির ফাঁকে ফাঁকে পড়ে থাকা কয়লা অনেকের মত হাকিমও কুড়ায়। স্টেশন থেকে খানিক দূরে আলির চায়ের দোকানে সেগুলো বিক্রি করে। দোকানের পাশেই আলির বাড়ি। হাকিম খুচরা পয়সা গুলো গুনতে গুনতে আলির উঠোনে দাঁড়িয়ে হাক ছাড়ে-
রাবু আচিস নাই, ও রাবু আমারে এট্টু পানি দিতি পারিস?
রাবু আলির বড় মেয়ে। তিন তিনবার মৃত বাচ্চা প্রসব করায় তালাকপ্রাপ্ত হয়ে এখন বুড়ো বাপের ঘাড়ে।
লম্বা বেনিটা দোলাতে দোলাতে রাবু হাকিমের মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়।
- এই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সুমায় কি তোর পানির তিষ্ণে লাগে, না তিষ্ণে লাগলি এদিক আসিস।
হাকিম রাবুর কথার উত্তর না দিয়ে টিনের বাটিতে ঠোঁট ডুবিয়ে পানি খায়। বাটিটা ফেরত দিতে দিতে রাবুর রাঙা হাতটা হাকিমের খসখসে আঙুলগুলো ছুঁয়ে যায়। দুই জোড়া চোখ কয়েক পলকের জন্য স্থির হয়। হাকিম শরীরে অন্য এক পিপাসা অনুভব করে, বুকের ছাতি কাঠ হতে থাকে। রাবুর চোখে-মুখে-ঠোঁটে-বুকে যেন অফুরন্ত ঝর্ণাধারা।
আলির ইচ্ছা করছে কেটলির পানিতে দুধচিনি লিকার না মিশিয়ে নিজের মাথায় ঢেলে দিতে, তাতে অন্তত কানের থেকে মাথাটা কম গরম থাকবে। সুপারি গাছের বাতায় তৈরী বেঞ্চে বসে হেমায়েত পা দুলাতে দুলাতে বলে- কই আলি বাই তোমার চা এহনো ওইনি? বিস্কুট চিবুতে চিবুতে আমির আলি বললো-আলি বাই মাতাডা ঠান্ডা রাহো, যা অয় বালোর ল্যাগে অয়। ঠিক কইরে দোকানদারি এরো, যে কয়ডা গরে আছে তাগে প্যাটের কতা চিন্তা এ্যারোগে। হেমায়েত খানিকটা টেনে টেনে বলে,ও আমির আলি তোর দেহি মাতামুতা সব গেইচে; চিন্তা না এইরে পারে? আমাগে রাবুর আগে বিয়ে থাকলিও ওই ছুয়ালের সাতে মানায়। উঁচো-লাম্বা-চিয়ারা-ছবি কিসি কম আচে, আমরা কি দেহে শুইনে বালো এক জাগায় দিতি পারতামনা, এমনিতো বাপে খেদানোা মায় তাড়ানো, তারপরে আবার রাবুর চেয়ে বয়াসে কতোখানিক ছোটো। গ্রাম সরকার ছলেমানকে দোকানের দিকে আসতে দেখে সবাই চুপ করে যায়।
কড় কড় করে আকাশে মেঘ ডাকে, হাকিমের মনটা আনচান করে ওঠে। বিজলির ঝলকে মনের পর্দায় দুটি ডাগর চোখ স্পষ্ট হয়।
মেঘের ডাককে রাবু খুব ভয পায়, বৃষ্টি দেখলে নাক সিঁটকে খুপড়ির দোহাতি ঝাপটা ফেলে দেয়। হাকিম নিজের হাতটা রাবুর মাথার বালিশ করতে করতে বলে- ও রাবু তুই বিস্টি বালোপাসিসনে ক্যান? রাবু হাকিমের বুকে মুখ গুজে বলে, তাতে কি হইচে, তুমারেতো বালপাসি। রাবুকে ছুঁয়ে থাকা হাকিম ভুলে যায় বৃষ্টির শব্দ। রাবু পারেনা ভালোবাসার শেকলে জড়িয়ে
হাকিমকে ঘর মুখো করতে। রিক্সা চালিয়ে সামান্য কিছু পকেটে জমা হলেই হাকিম ফুটপাতের পাশে সস্তা হোটেলে খেতে খেতে ভুলে যায় ঘরে অভুক্ত রাবু তার পথ চেয়ে আছে। খাবার বিল মিটিয়ে ট্যাকে আরও কিছু থাকলে থার্ড ক্লাসের টিকিট কেটে সিনেমার হলে লোহার চেয়ারে বসে আয়েশী বিড়ি ধরায়। কখনও কখনও কাহিনির ধারায় নায়িকার ক্লিষ্ট মুখ দেখে মনে পড়ে রাবুর কথা,ভাবে, আহারে বেচারি মা বাপ সব ছাইড়ে আইচে, তারাও কেউ খবর নেয়না। রাবুকে নায়িকার চেয়েও বেশী দুখি আর মায়াবী মনে হয়। পকেটের শেষ খুচরা পয়সা কটি দিয়ে কাঁচের চুড়ি,লিপস্টিক কিনতে কিনতে ভাবে,সাপান আর ¯স্নো মাহালি রাবুরে কবরীর চেয়েও বালো দেহাবে।
হাকিমের হাতে কাঁচের চুঁড়ি আর লিপস্টিক দেখে রাবু ভুলে যায় সারাদিন না খেয়ে থাকার কথা। বস্তির সামনের হোটেলে মসলা বাটা আর বাসন ধোয়ার বিনিময়ে পাওয়া খাবার থালাটায় দুইটা ভাগ করে।
হাকিম বাজারের অপরাগতার কথা জানাতে রাবু ভুলে যায় সারারাতের স্মৃতি; ছুড়ে ফেলে লিপস্টিক, কাঁচের চুড়ি। ঝন ঝন শব্দে ভেঙ্গে যায় হাকিমের মন। হাকিমতো নিজেই জানেনা ও কখন কি চায়, তবে যা মন চায় হাকিম তাই করে।
সাংসারিক চাহিদার সাথে সাথে রাবুর খাবারটাও বেড়ে যায়। দিন রাত শুধু খাই খাই। হাকিম ভাবে,প্যাটে রাক্কস গেলো নাই। পাশের ঘরের চাচি বলে, এই সুমায় খাওয়া বালো, তোর দেহিস ছুয়াল অবে। হাকিম অনাগত ছেলের আশায় সারাদিন রিক্সা চালায়, সন্ধ্যায় রাবুর বলে দেওয়া জিনিষপত্র ব্যাগ ভর্তি করতে করতে ভাবে, ছুয়াল লঞ্চের সারেং অবে। কথনও ভাবে, শুকুর গাজির মতন পাটের কারবারি, আবার ভাবে না না একদিন লঞ্চে চশমা-গড়ি পরা এক সায়েবের পাশে বইলাম, ফটাফট ইংলিশ কয়,আমার ছুয়াল ওইরাম অবে।
সকাল থেকে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। ঘরে চাল-ডাল-নুন কিছুই নেই। হাকিমের বাইরে যাওয়ার ইচ্ছাগুলো রাবুর কাতর চোখে থমকে যায়। দুপুর গড়াতেই রাবুর কাতরতা ব্যথায় রূপ নেয়। সাথি চাচি এসে হাকিমকে তাড়া দেয়, ও হাকিম এহেনি বইসে থাকলি অবেনা, সুমায় অইয়ে আইছে; নতুন সাপান, বেলেট ম্যালা কিছু লাগবে আইনে দে।
পলিথিন মাথায় দিয়ে ঝপঝপে বৃষ্টিতে রিক্সা গ্যারেজে ছোটে হাকিম। মালিকের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার নিয়ে প্রয়োজনীয জিনিষপত্র কিনে নিয়ে আসে। ঘরে ঢুকতেই মেয়েরা ওকে বাইরে যেতে বলে। চাদরটা গায়ে জড়িয়ে কাংখিত জনের জন্য বারান্দায় অপেক্ষা করতে থাকে হাকিম।
সন্ধ্যা হয়ে আসে। ঝির ঝির বাতাসে মেঘ কাটতে শুরু করেছে, বৃষ্টিও থেমে গেছে। সাথি চাচি আচমকা পিছন থেকে বলে- ও বাপ মিস্টি নিয়াই, তোর কদুর ফুলির মতোন মাইয়ে অইচে। হাকিমের বুকের ভেতর হাজারটা অমাবশ্যা নেমে এলো, মাথাটা ভোঁ ভোঁ করে উঠলো। ডানে বায়ে না তাকিয়ে হাঁটা শুরু করে। সাথি চাচি পেছন থেকে ডাকে, ও বাপ যাইস কুহানে? বাতাসে শন শন শব্দ ছাড়া হাকিমের কানে আর কিছু পৌছায়না। বৃষ্টি ভেজা মাঝরাত। লঞ্চে ছাদে হাকিম ছাড়া কেউ নেই। খানিক আগে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে, আকাশ পরিস্কার হয়ে যায়; আবার নামে ঝম ঝম করে। আষাঢ়ে আকাশ আর হাকিমের মন একই রকম, নিজেই নিজের রকম-ফের বোঝেনা। শহর পাড়ের ল্যাম্পপোষ্টের আলো এসে নদীর জলে লুটোপুটি করছে; মাথার উপর ধুসর আকাশ। এমন আলো আধাঁরির মিলিত আহŸানে হাকিমের তাবত চিন্তা ভেসে থাকে পুবান বাতাসে। মনের খাতায় চেনা-অচেনা হরেক রংয়ের পেন্সিলে কী সব আঁকি বুকি হতে হতে একটা পুতুল হয়ে যায়।
ডেকে হেলান দিয়ে ভৈরবের জলে চোখ রাখে হাকিম। জল দেখতে দেখতে জলের গভীর থেকে ভেসে আসে মায়াবী একটি সুর। হাকিম তাকিয়ে দেখে নদীর জলে মিষ্টি একটা পরী খিল খিল করে হাসছে। ও চোখ বন্ধ করে চিৎকার দিয়ে ওঠে, না না আমার ছুয়াল লাগবে ছুয়াল। মাথায কারো ¯স্নেহের পরশ পায়; মায়ের হাত, তবে খুব ছোট। হাকিম হাত দুটো ধরে বুকে ছোঁয়ায়। মা বলে কেঁদে ওঠে।
মা আমি তুমারে আর যাতি দেবো না। আমি ঘুমালি তুমি আসো, সজাগ থাকতি কোন সুমায় আসোনা বুইলে তুমারে দরতি পারিনে, আইজকে দরিচি, আর কোনদিন ছাড়বো না। কোনদিন তুমার মুখ দেকতি পারিনি, আইজকে দেকপো।
হাকিম আধবোজা চোখে দেখে, ওর হাতে জলে ভাসা কদুর ফুল। হলুদ ফুলের ভেতর মায়ের চোখ, ঠোঁট আর মমতার একজোড়া হাত। ঝুপঝুপ বৃষ্টি নামে। হাকিম কদুর ফুলটাকে বৃষ্টি থেকে লুকাতে চাদরের নিচে দুহাত দিয়ে বুকের সাথে আকড়ে ধরে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন