Inqilab Logo

শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

ঋণের জালে বন্দি জেলেদের জীবন

জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গভীর সমুদ্রে জেলেরা : আজও গড়ে ওঠেনি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র

ফাহাদ হোসেন, মোরেলগঞ্জ (বাগেরহাট) থেকে | প্রকাশের সময় : ১ নভেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলায় বছরে প্রায় ১ হাজার জেলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যায়, উপক‚লীয় এই উপজেলায় নদী তীরবর্তী গ্রামে বসবাসকারী জেলেরা বরাবরই মহাজন ও দাদন ব্যবসায়ীদের কাছে জিম্মি। এ সকল অসাধু দাদন ব্যবসায়ীদের খপ্পরে পরে তারা হারাচ্ছে তাদের প্রাপ্ত অধিকার। জেলেরা জানায়, জাল ট্রলার কিংবা নৌকা ক্রয় করার মত সামর্থ নেই তাদের, চড়া সুদে মহাজন ও দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আগাম ঋণ নিয়ে মাছ ধরার জন্য নদীতে পারি জমায় তারা, ঝড়, জলোচ্ছ¡াস, নৌকাডুবির মত ঘটনা ঘটলেও ঋনের কিস্তি কোনভাবেই মাফ হয় না জেলেদের। সমুদ্রে দিনরাত হাড়ভাঙা খাটুনি দিয়ে যে মাছ পায় সেটা বিক্রি করে যে টাকা আয় হয় তার ১ ভাগ মহাজনের, ১ ভাগ দাদন ব্যবসায়ীর বাকি যে টুকু থাকে তা নিজের ভাগ্যে জুটে। অনেক সময় দেখা যায় কষ্ট করে মাছ আহরণ করে অর্ধেক মূল্যে মহাজনের গদিতে তুলে দিতে হয়। ফলে মাছের লভ্যাংশ চলে যায় মহাজনের পকেটে, জেলেদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয় না।
গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যায় মোরেলগঞ্জের জেলে আলী আকবর, মাহাজনের কাছ থেকে অগ্রিম ৩ মাসের বেতন নিয়ে পরিবারের সদস্যদের ভরন-পোষনের ব্যাবস্থা করে সমুদ্রে পারি জমান তিনি, কারণ আগামী ৫ মাস পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে যাবে আকবর। গভীর সমুদ্রের জেলে জীবন সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতার কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন ‘মোগো জাল নাই, মহজনের লগে বেতনে যাই, মহজন দাদনে, সুদে টাহা লইয়া আমাগোরে ২/৩ মাসের অগ্রিম বেতন দিয়া সাগরে লইয়া যায়, হেই টাহা দিয়া পোলা, মাইয়ারে বাজার, সদায় কইরা দিয়া যাই, ৫/৬ মাস পোলা-মাইয়ার মুখ দেহি না, বাড়ি দিয়া যাওয়ার সময় দাবি দাওয়া ছাড়াইয়া যাই। কারণ সমুদ্রে মোগো কোন নিরাপত্তা নাই, অভাবের টানে যাইতে হয়, মাহজন সুদের টাহা শোধ দিয়া, দাদন পরিশোধ শেষে মাহজনেরও সমানে সমান থাইকা যায়, মোগো বেতন ছাড়া আর কি দেবে, এভাবে সাগরে মাছ ধরার অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন আলী আকবর।
পুটিখালি ইউনিয়নের জেলে আলাউদ্দিন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘মোরা হারা বচ্ছর মাছ ধইরা কিছুই করতে পারি না, কোনো রহম পোলা-মাইয়া লইয়া বাঁইচ্ছা থাহি, আর মোগো গোনে যারা মাছ কিন্না ব্যাছে, হেরা রাইতের মধ্যে ধনী অইয়া যায়। ‘সাগর মোহনায় মাছ ধরতে যাওয়া এসব জেলেদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন আজও হয়নি।
জেলেদের আহরণ করা মাছ বিদেশে রপ্তানি করে যেসব ব্যবসায়ী কোটিপতি হয়েছেন, তারাও এদের ব্যাপারে উদাসীন। তারা একের পর এক ব্যবসার স¤প্রসারণ ঘটিয়েছেন মোরেলগঞ্জের জেলে পল্লীগুলো রয়ে গেছে আগের মতোই।
জেলেদের দাবি সরকার তাদের যদি ঋণের সুযোগ করে দেয়, মাছ ধরার জন্য বিনামূল্যে জাল বিতরণ করে তাহলে তারা সামুদ্রিক মাছের সঠিক মূল্য পাবে, প্রভাবশালীদের খপ্পরে পড়তে হবে না, দাদন ব্যাবসায়ীদের কাছে জিম্মি হতে হবে না, তাছাড়া মোরেলগঞ্জ-শরনখোলা অঞ্চলে (বিএফডিসি) কোনো মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র আজও গড়ে ওঠেনি। এতে বঙ্গোপসাগরের এ অঞ্চলের জেলেদের আহরিত মৎস্যসম্পদের কোটি কোটি টাকা প্রতি মৌসুমে হাতিয়ে নিচ্ছে দাদন ব্যবসায়ী মধ্যস্বত্বভোগী ও ফড়িয়ারা।
মোরেলগঞ্জ মৎস অফিসের তথ্য অনুযায়ী, বঙ্গোপসাগরে এবার মোরেলগঞ্জের প্রায় ১ হাজার জেলে মাছ ধরার উদ্দেশে রওয়ানা হয়েছেন। সুষ্ঠু বিপনন ব্যবস্থার অভাবে সিংহভাগ চলে যায় মধ্যস্বত্বভোগী দাদন ব্যবসায়ী ও ফড়িয়ার পকেটে, বিএফডিসি কেন্দ্র না হওয়ায় জেলেরা কিনারে না এসে সাগরেই তাদের মাছ পানির দরে মধ্যস্বত্বভোগী দাদন ব্যবসায়ী ও ফড়িয়াদের কাছে বিক্রি করে দেন। এ অঞ্চলে কয়েকশত ফড়িয়া চক্র রয়েছে।
এ বিষয়ে মোরেলগঞ্জ মৎস কর্মকর্তা বিনয় কুমার রায় বলেন, এ বছর মোরেলগঞ্জ উপজেলায় প্রায় ১ হাজার জেলেকে সরকারের পক্ষ থেকে চাল বিতরণ করা হয়েছে, আর্থিক কোন সহযোগিতা আমরা করতে পারি নি, তবে উপক‚লীয় এই উপজেলায় সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়া জেলেরা যদি এ অঞ্চলে বিএফডিসি কেন্দ্রের জন্য বা তাদের কোন দাবি আমাদের কাছে লিখিতভাবে তুলে ধরেন তবে সেটি উর্ধতন কতৃপক্ষের কাছে পাঠানো হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জীবন

২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ