পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
মন্ত্রীরা সকলেই মাননীয়। সুতরাং মাননীয়রা আমাদের মতো আম জনতার সুরে কথা বলবেন না, সভ্য, উন্নত ও গণতান্ত্রিক বিশে^র মানুষ সেটিই আশা করে। বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ে কোনো পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রী অর্থাৎ ক্যাবিনেট মিনিস্টার নাই। আছেন একজন প্রতিমন্ত্রী। নাম নসরুল হামিদ বিপু। অনেকে বলেন, যেহেতু এখানে কোনো ফুল মিনিস্টার নাই তাই প্রতিমন্ত্রীই ফুল মিনিস্টারের দায়িত্ব পালন করেন এবং ক্ষমতা প্রয়োগ করেন। আবার অন্যরা বলেন, যেহেতু এখানে কোনো ফুল মিনিস্টার নাই তাই প্রধানমন্ত্রীই এই মন্ত্রণালয়ের ফুল মিনিস্টার। যেমন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের তিনিই ফুল মিনিস্টার। তবে যেসব মন্ত্রণালয়ের ডিফ্যাক্টো ফুল মিনিস্টার হলেন প্রধানমন্ত্রী সেখানে প্রধানমন্ত্রীর এত সময় নাই যে, তিনি মন্ত্রণালয়ের প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয় দেখবেন। এই দৃষ্টিকোণ থেকে আমার মনে হয় যে, বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ে নসরুল হামিদ বিপুই সর্বেসর্বা। সুতরাং এটা আশা করা যায় যে, এই মন্ত্রণালয়ের প্রধান হওয়ার সুবাদে তিনি দায়িত্বশীল কথা বলবেন। কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে যে, তিনি দায়িত্বশীল কথা বলেন না। আজ যেটা বলেন, কাল সেটা উল্টে দেন। আমি এর কতগুলো ডকুমেন্টারি এভিডেন্স দেবো। তার আগে বিদ্যুৎ নিয়ে ভোগান্তি যে কত চরমে উঠেছে, সেটি নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে সরকারকে বোঝাতে চাই।
আমার লেখা যারা নিয়মিত পড়েন তারা সম্ভবত জানেন যে, আমি ধানমন্ডির কলাবাগানে থাকি। আমি আমার তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বলছি। গত শনিবার দিবাগত রাত ৩টার সময় কারেন্ট যায়। আসে রাত ৪টায়। আবার পরদিন অর্থাৎ রবিবার সকাল সাড়ে ৭টায় কারেন্ট যায়। আসে সকাল সাড়ে ৮টায়। আবার রবিবার বেলা ১১টায় কারেন্ট যায়। আসে দুপুর ১২টায়। ফের একই দিন অর্থাৎ রবিবার কারেন্ট যায় দুপুর ২টায়। আসে বিকাল ৩টায়। এখন বিকাল ৫টায় এই লেখা শুরু করেছি। জানি না, বাঁকি বিকালটায় এবং রাতে ফের কারেন্ট যাবে কিনা। সম্মানিত পাঠক ভাইয়েরা, আপনারা সকলেই জানেন যে, ধানমন্ডি কলাবাগানকে মোটামুটি একটি ভালো এলাকা বলা যায়। এখানেই যখন ১০ ঘণ্টার মধ্যে ৪ ঘণ্টা কারেন্ট যায়, তখন যেসব এলাকা কম উন্নত বলে পরিচিত, অথবা মফস্বল এলাকায় ২৪ ঘণ্টায় কতবার কারেন্ট যেতে পারে।
প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু তো অন্যরকম আশ^াস দিয়েছিলেন। গত জুলাই মাসে তিনি বলেছিলেন যে, এই লোডশেডিং বেশিদিন চলবে না। তার ভেরিফায়েড ফেসবুকে তখন তিনি লিখেছিলেন, ‘আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দ্বিতীয় ইউনিটে উৎপাদন শুরু হবে। এছাড়া ভারতের শীর্ষ ধনকুবের এবং এই মুহূর্তে পৃথিবীর দ্বিতীয় শীর্ষ ধনাঢ্য ব্যক্তি গৌতম আদানির বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হবে। আদানির ১ হাজার ৬০০ এবং পায়রা ও রামপালের দুটি ইউনিটের বিদ্যুৎ মিলে মোট ৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে।’ এখন নাকি আমাদের ঘাটতি আড়াই থেকে তিন হাজার মেগাওয়াট। সেজন্যই এত লোডশেডিং। কিন্তু এই ৪ হাজার মেগাওয়াট পাওয়া গেলে আর কোনো লোডশেডিং থাকবে না। সেজন্যই সম্ভবত তিনি জোর গলায় বলেছিলেন যে সেপ্টেম্বরের পরে আর কোনো লোডশেডিং থাকবে না। সেপ্টেম্বর গেলো। আজ অক্টোবরের ২৫ তারিখ। অক্টোবরও শেষ হতে চলল। লোডশেডিং দূর হওয়া তো দূরের কথা, সেই লোডশেডিং আরো বেড়েই চলেছে।
সম্ভবত ঐ ধরনের তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই পূর্ণ মন্ত্রীর মর্যাদাসম্পন্ন প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ উপদেষ্টা প্রাক্তন আমলা তৌফিক এলাহী চৌধুরীও বলেছিলেন যে, সেপ্টেম্বর মাসে মানুষকে ঐ লোডশেডিং থেকে আংশিকভাবে হলেও কিছুটা রিলিফ দেওয়া যাবে। কিন্তু সেই রিলিফ আর আসেনি।
॥দুই॥
গত আগস্ট মাসে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী আবার বলেন, ‘বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নতি হবে আগামী সেপ্টেম্বর মাসে।’ পত্রিকান্তরের রিপোর্ট মোতাবেক বিগত সেপ্টেম্বর মাসে তিনটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু একটিও যায়নি। গত ৭ অক্টোবর নসরুল হামিদ বিপু ঘোষণা করেন যে, বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। এখন দৈনিক বিদ্যুতের ঘাটতি ৭০০ থেকে ৮০০ মেগাওয়াট। কোথা থেকে এই তথ্য তিনি পেলেন সেটি জানা যায়নি। কিন্তু বাংলাদেশ পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি (পিজিসিবি) থেকে জানা যায় যে, মন্ত্রীর ঐ হিসাব সঠিক নয়। যেদিন তিনি এই ঘোষণা দেন, সেদিনই অর্থাৎ ৭ অক্টোবর বিদ্যুৎ ঘাটতি ছিল ৯৬৪ মেগাওয়াট।
বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুকে ধন্যবাদ জানাতে হয়। কারণ, তার ৩ দিন পর অর্থাৎ ১০ অক্টোবর তিনি স্বীকার করেন যে, বিদ্যুৎ পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। তিনি আরো বলেন, আমরা আশা করেছিলাম যে, অক্টোবর মাস থেকে সংকটের সমাধান হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, গ্যাসের স্বল্পতার জন্য আমাদের আশাবাদ পূরণ হয়নি। তিনি ফের বলেছেন যে, তিনি আশা করেন যে, আগামী মাস থেকে, অর্থাৎ আগামী নভেম্বর থেকে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে।
আগামী মাস থেকে যে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে সেটা তিনি কোন হিসাব থেকে বলেছেন? আজ ২৫ অক্টোবর। আর ৬ দিন পর হবে ১ নভেম্বর। তখন তো শীত না পড়লেও গরম আর থাকবে না। এসি চালানোর প্রয়োজন হবে না। এমনকি বৈদ্যুতিক পাখাও তেমন একটা চালানোর প্রয়োজন হবে না। এর ফলে তো এমনিতেই বিদ্যুতের সাশ্রয় হবে। এর ফলে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ বাঁচবে সেই পরিমাণ বিদ্যুৎ পাওয়ার গ্রিডে দেওয়া যাবে। ফলে সেই অনুপাতে লোডশেডিং কমবে।
এখন প্রশ্ন হলো, যারা এতদিন ধরে গলাবাজি করেছেন যে, আওয়ামী লীগ সরকারের বিদ্যুৎনীতি সব রকম ত্রুটি বিচ্যুতির ঊর্ধ্বে, তারা এখন কি জবাব দেবেন? গত মার্চ মাসে সরকার খুব ঘটা করে বিদ্যুৎ সপ্তাহ উদযাপন করে। সেখানে সরকার এবং জ¦ালানি মন্ত্রণালয় এবং তার অধীনস্থ সংস্থার উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাবৃন্দ উচ্চ কণ্ঠে ঘোষণা করেন যে, লোডশেডিংয়ের দিন শেষ হয়ে গেছে। ঐ অনুষ্ঠানে বিএনপি আমলের বিদ্যুৎনীতিকে খাম্বা স্থাপনের নীতি বলে পরিহাস করা হয়। মার্চের পর মাত্র ৩ মাস। এই ৩ মাস পর অর্থাৎ জুলাই মাসেই লোডশেডিংয়ের দানব ফিরে এলো কেন? এ যেমন তেমন লোডশেডিং নয়। শুরুতে আমি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছি। দিনে তো বটেই, রাত ১টা ২টা বা ৩টা এই লোডশেডিং মানে না।
॥তিন॥
এখন স্বাভাবিকভাবেই পিছু ফিরে তাকাতে হবে। শুধু আমাদের মতো ভোক্তাদের নয়, সরকারকেও পিছু ফিরে তাকাতে হবে। সরকারই বলছে যে, দেশের সর্বত্র সারাক্ষণ বিদ্যুৎ রাখতে হলে সাড়ে ১৪ থেকে ১৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়। তাহলে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা, অর্থাৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৫ হাজার মেগাওয়াট করা হলো কেন? এই অতিরিক্ত ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের তো কোনো প্রয়োজনই ছিল না। যদি সক্ষমতা বাড়ানো হলো বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য যে ইনপুট, অর্থাৎ গ্যাস, কয়লা, তেল সহ নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন ইত্যাদির ব্যবস্থা এবং সংগ্রহ করা হলো না কেন? দেশের মাটির নিচে এবং পানির নিচে, অর্থাৎ সমুদ্রের গভীর তলদেশে অনেক গ্যাস মজুদ রয়েছে। এটি আমাদের কথা নয়। পৃথিবী বিখ্যাত গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানীগুলো বাংলাদেশে এসেছিল। তারা অনুসন্ধান করে বলেছে যে, আমাদের সাগরের তলায় এবং মাটির নিচে অনেক গ্যাস মজুদ আছে। সেগুলো উত্তোলনের ব্যবস্থা না করে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন এবং এলএনজি (লিকুফায়েড ন্যাচারাল গ্যাস) আমদানীর পেছনে ছোটা হলো কেন? কেন এতগুলো কুইক রেন্টাল স্থাপনের পারমিশন দেয়া হলো? তাদের যে ক্যাপাসিটি সেই সর্বোচ্চ ক্যাপাসিটি মোতাবেক উৎপাদন করা হলো না কেন?
এই সবগুলো কেন’র জবাব আছে। গত জুলাই থেকে অক্টোবরÑ এই ৪ মাসে এসম্পর্কে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে। এমনকি সরকারপন্থী বা আধা সরকারপন্থী বলে যে সমস্ত গণমাধ্যমের পরিচিতি রয়েছে তারাও এই কেন’র উত্তরে অনেক কিছুই লিখেছে। এক কথায় শত শত কোটি নয়, হাজার হাজার কোটি টাকা, এমনকি লক্ষ কোটি টাকা এই বিদ্যুৎ খাতে বিগত ১৫ বছরে ব্যয় করা হয়েছে। শুধুমাত্র রেন্টাল এবং কুইক রেন্টালকেই তো এ পর্যন্ত ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ দেওয়া হয়েছে ৯০ হাজার কোটি টাকা। সবচেয়ে তাজ্জব হতে হয় এই ভেবে যে, যেসব রেন্টাল কেন্দ্রকে পূর্ণ ক্যাপাসিটির উৎপাদন করতে না দিয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে তাদেরকেও ক্যাপাসিটি চার্জের টাকা দিতে হয়েছে। এই হাজার হাজার কোটি টাকা কার? এই বিশালঅংকের টাকা এদেশের ভুখানাঙ্গা জনগণের। বিদ্যুৎ তথা জ¦ালানির ওপর লুটপাট এবং বেপরোয়া দুর্নীতির খবর যেসব পত্র পত্রিকার রিপোর্ট, সম্পাদকীয় এবং উপসম্পাদকীয় কলামে এসেছে সেসমস্ত কাটিং অনেক গবেষক এবং লেখক মেইনটেন করছেন। তাই এব্যাপারে আর বিস্তারিত বর্ণনায় গেলাম না।
গত লেখায় যেমন বলেছি, তেমনি আজও বলছি, সময় দ্রুত বয়ে যাচ্ছে। এই ভুল নীতি এবং একগুয়েমি পরিহার করতে হবে। প্রথমে চট্টগ্রামে বিএনপির জনসভা থেকে সারাদেশের মানুষ নতুন করে বার্তা পেতে শুরু করেছেন। ময়মনসিংহে এক দিন সরকারি হরতাল করেও লক্ষ মানুষের সমাবেশকে ঠেকানো যায়নি। খুলনায় আরো চরম ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। সরকারি হরতাল হয় দুই দিন। বাস, লঞ্চ, ট্রলার, এমনকি খেয়াঘাটেও সরকারি হরতাল পালন করা হয়, অর্থাৎ ঐ সব সার্ভিস বন্ধ করে দেওয়া হয়। তারপরেও জনজোয়ার থামানো যায়নি। এই সব কথা আমি দুইটি ইংরেজি সংবাদপত্রের দুইটি হেডিং দিয়ে অতি সংক্ষেপে বর্ণনা করবো। ২৩ অক্টোবর ডেইলি স্টারের প্রথম পৃষ্ঠার হেডলাইন, Transport strike / Rally over, demands gone.. অর্থাৎ বিএনপির জনসভা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই পরিবহন ও অন্যান্য ধর্মঘট কর্পুরের মতো উবে গেছে। ডেইলি নিউ এজের প্রথম পৃষ্ঠার প্রধান সংবাদের ৫ কলামব্যাপী শিরোনাম, BNP holds huge rally amid strikes, attacks, arrests / Bus, Launch services resume immediately after rally. অর্থাৎ ধর্মঘট, হামলা এবং গ্রেফতারের মধ্যদিয়ে বিএনপির বিশাল সমাবেশ / র্যালি শেষ হওয়ার সাথে সাথেই বাস এবং লঞ্চ এবং স্টিমার সার্ভিস চালু।
মানুষ এখন অনেক চালু এবং চালাক চতুর হয়েছে। শাক দিয়ে আর মাছ ঢাকা যাবে না। তাই এখন জাতীয় কবি, কাজী নজরুলের কবিতার দুই লাইন মনে পড়ছে।
এই যৌবনজলতরঙ্গ রোধিবি
কি দিয়া বালির বাঁধ?
কে রোধিবি এই জোয়ারের টান
গগনে যখন উঠেছে চাঁদ?
Email: [email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।