Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কৃষি খাতে মনোযোগ দিতে হবে

মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ১৯ অক্টোবর, ২০২২, ১২:০০ এএম

কথায় বলে, যায় দিন ভালো, আসে দিন খারাপ। উপর্যুপরি সংকটে বিশ^ ক্রমেই অস্থিরতার দিকে যাচ্ছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, ২০২৩ সালে বৈশি^ক অর্থনীতি মন্দার কবলে পড়বে। আবার কোনো কোনো আর্থিক কোম্পানি একটু আগ বাড়িয়ে যেমন- জাপানের নমুরা হোল্ডিং বলছে, মন্দা দেখা দেবে চলতি ২০২২ সালের শেষের দিকে। তবে বিশে^ অর্থনৈতিক মন্দা যে অবশম্ভাবী, সেটি মোটামুটি নিশ্চিত। প্রশ্ন হচ্ছে, এই মন্দা কি শুধু মন্দার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে, নাকি মহামন্দায় পরিণত হবে? তা এখন চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত দুই বছর কোভিডের আঘাতে অসংখ্য মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। ১৯৭০ সালের মন্দার পর বৈশি^ক অর্থনীতি এখন সবচেয়ে বিপর্যস্ত। এই মন্দায় মারাত্মক পরিণতি ভোগ করবে মূলত স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো। এর মধ্যে বাংলাদেশও রয়ছে। দারিদ্র্যের পরিসংখ্যানে বিবিএস যাই বলুক বা না বলুক, বিভিন্ন গবেষণা সংস্থাÑব্র্যাক, পিআরআই, সিপিডি বা সানেমের বিশ্লেষণ বলছে, দেশে এখন দারিদ্র্যের সংখ্যা ৪০ শতাংশের ওপর। আবহমানকাল ধরে মানুষের প্রবণতা হচ্ছে, একটু ভালো থাকার আশায়, গ্রাম থেকে শহরে আসা। শুধূ কোভিডকালীন ভাটা পড়েছে। অনেক মানুষ কর্মহীন হয়ে গ্রামে ফিরেছে। গত ৫০ বছরে তুলনার বিচারে বিশেষ করে বর্তমান সরকারের ধারাবাহিক আমলে, বাংলাদেশের যে ব্যাপক আর্থসামাজিক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। বিশেষ করে শিল্প খাতের বিকাশ ঘটেছে দ্রুত হারে। ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ তিন মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পোশাক রপ্তানি দিয়ে এ খাতের রপ্তানি যাত্রা শুরু করে। এর পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। গত অর্থবছরে আমাদের রপ্তানির আয় ছিল ৫২ বিলিয়ন ডলার। যার ৮৪ ভাগই ছিল পোশাক রপ্তানি। তবে এর সিংহভাগ কাঁচামালই আমদানিনির্ভর। এর সঙ্গে আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য, জ্বালানি, বিলাসীপণ্য আমদানি করতে হয়, যা ধীরে ধীরে আমাদের আমদানিনির্ভর দেশে পরিণত করছে। সৃষ্টি হচ্ছে, ভয়াবহ রকমের বাণিজ্য ঘাটতি আর অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা। ৭০ দশকে বাংলাদেশের রপ্তানিযোগ্য পণ্য ছিল পাট, পাটজাত পণ্য, চা, চামড়া ও হিমায়িত মাছ। এই পণ্যসমূহ কোনো সময়ই আমদানিনির্ভর ছিল না। দেশের অভ্যন্তরে পণ্যগুলো উৎপাদন করা হতো। বাংলাদেশের এই অর্থনৈতিক উন্নয়ন, মোটা দাগে এর পেছনে ভূমিকা রেখেছে এককভাবে পোশাক খাত, তুলনামূলক সস্তা শ্রমের রেমিট্যান্স ও কৃষি খাতের বিপুল সম্প্রসারণ। এর মধ্যে দুটোই সম্পূর্ণভাবে পরনির্ভর। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, অর্থনৈতিক মন্দার শঙ্কায় বিশ্বজুড়ে খরচ কমিয়ে আনছে ভোক্তারা। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে রপ্তানি বাণিজ্য তথা পোশাকশিল্পে। নতুন অর্ডার কমে যাচ্ছে, পুরনো ক্রয়াদেশ স্থগিত হচ্ছে। সামনের দিনগুলো আরও ভয়াবহ হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকরা। তাদের ভাষ্যমতে, ক্রয়াদেশের এই কমতি ধারা চলতে থাকলে কারখানাগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা হয়তো ৩০ শতাংশের বেশি ব্যবহার করা যাবে না। এই শিল্পের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে শ্রমিক ছাঁটাই হবে একমাত্র রক্ষাকবচ। ফলে লাখ লাখ শ্রমিক চাকরি হারিয়ে জীবন ও জীবিকা নিয়ে এক অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাবে। অন্যদিকে, মন্দা দীর্ঘায়িত হলে, আমাদের ফুলেফেঁপে ওঠা রেমিট্যান্সেও যে ভাটা পড়বে সেটি নিশ্চিত করেই বলা যায়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আমাদের একমাত্র নির্ভরতার জায়গা কৃষি খাত। সাম্প্র্রতিক সময়ে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) সতর্ক করে জানিয়েছে, আগামী বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত বিশ্বে তীব্র খাদ্য সংকট বিরাজ করবে। সংস্থাদ্বয়ের প্রতিবেদনে ৫৩টি দেশের মোট ২২ কোটি ২০ লাখ মানুষের জন্য জরুরি সহায়তার প্রয়োজন হতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের নামও রয়েছে। গত বোরো ও আউশের মৌসুমে ফলন কম হয়েছে। বৃষ্টি না হওয়ায় আমনের ভরা মৌসুমে পানির অভাবে কৃষকরা ধান রোপন করতে পারেনি। বলে রাখা ভালো, ধানের প্রায় ৪২ শতাংশ আসে আমন থেকে। ফলে বছরের শেষের দিকে খাদ্য সংকটের আশঙ্কা রয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার আগেভাগেই বিদেশ থেকে চাল কেনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে।

মানবজাতির আদি পেশা কৃষি। বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৪১ ভাগ কৃষির সাথে জড়িত। ষাটের দশকে কৃষিতে সবুজ বিপ্লব শুরু হলেও স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই বাংলাদেশে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সেচের ওপর অধিক গুরুত্ব দেয় সরকার। এর সুফল ৮০ দশকে পাওয়া যায়। জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধি, আবাদি জমির পরিমাণ হ্রাস, জমির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিভাজন, জমির উর্বরতা হ্রাস, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির অপ্রতুলতা, সঠিক বাজারব্যবস্থার অনুপস্থিতি ইত্যাদি চ্যালেঞ্জ প্রতিনিয়ত মোকাবিলা করে এগিয়ে চলছে কৃষি। কৃষি খাতে এখন উৎপাদন বেড়েছে বহুগুণ। শুধু খাদ্যশস্যের উৎপাদনই নয়, বেড়েছে শাকসবজি, ফলমূল ও কৃষি খাতের উপখাতÑডিম, দুধ, মাছ ও গোশতের উৎপাদন। এর পেছনে প্রধান সহায়ক শক্তি ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কৃষিবান্ধব নীতি, প্রণোদনা ও সহায়তা। রাসায়নিক সারের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছালেও সরকার বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দিয়ে কৃষকের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রেখেছে। গত এক যুগে সরকার শুধু কৃষি খাতেই প্রায় এক লাখ কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে। পানি সেচের জন্য ব্যবহৃত বিদ্যুৎ ও কৃষি যন্ত্রপাতির ওপর ভর্তুকি অব্যাহত রেখেছেন। এবারের বাজেটেরও প্রায় তিন শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে কৃষি ভর্তুকি খাতে। এসব সহায়তার ফলে কৃষিতে নতুন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। পানি সেচের আওতা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে মোট আবাদি জমির প্রায় ৭০ শতাংশ। উচ্চফলনশীল জাতের আওতায় এসেছে ৮৫ শতাংশ ধানি জমি। ফলে বৃদ্ধি পেয়েছে খাদ্যশস্যের উৎপাদন, যা আমাদের খাদ্যঘাটতি থেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছে। ২০০৮-০৯ সালে এ দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদন ছিল ৩ কোটি ৩৩ লাখ টন। ২০২১-২২ সালে বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে ৪ লাখ কোটি টনে। সম্প্রতি চালের উৎপাদন প্রতিবছর গড়ে বৃদ্ধি পেয়েছে ৪ লাখ ৮৫ হাজার টন।

ফসলের ক্ষতিকর জীবাণু এবং কীটপতঙ্গ দমনের জন্য বালাইনাশকের ব্যবহার বেড়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর চাহিদা আরও বাড়বে। কিছু দানাদার পেস্টিসাইড বাদে চাহিদার প্রায় পুরোটাই আমদানি করতে হয়। ফলে কীটনাশকের উচ্চমূল্যের কারণে ফসলের উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। কীটনাশক উৎপাদনে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার মুখে নিজেদের অস্তিত¦ টিকিয়ে রেখেছে। সরকারের সঠিক তদারকির মাধ্যমে বালইনাশক দেশীয়ভাবে উৎপাদন করা গেলে বর্তমানের চেয়ে অনেক সস্তা ও সহজলভ্য হবে। পাশাপাশি কৃষকদের কীটনাশকের নিরাপদ ব্যবহার সম্পর্কে প্রশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে, যা অধিক ফসল উৎপাদনে ভূমিকা রাখবে। বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেলেও কৃষিপণ্য বিপণন এখনো অনুন্নত পর্যায়ে রয়েছে। প্রতিযোগিতামূলক বাজারব্যবস্থা সবার কাম্য হলেও কৃষিপণ্যের বিপণনের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক বাজার ব্যবস্থার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। প্রয়োজনের তুলনায় অধিকসংখ্যক মধ্যস্বত্বভোগীর উপস্থিতি বাংলাদেশের কৃষিপণ্য বিপণনের জোগান বিশৃঙ্খল করে তুলছে, যা কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য প্রাপ্তি থেকে শুধু বঞ্চিতই করছে না, দিন দিন কৃষকদের কৃষিকাজে অনুৎসাহিত করছে। কৃষকদের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় এবং এর সঙ্গে নিজস্ব শ্রম বিবেচনা করলে প্রতিবছর কৃষকদের আয় ও ভোগের ব্যবধান ঋণাত্মক হচ্ছে। ফলে পেশাভিত্তিক দারিদ্র্যের কাঠামোতে সবচেয়ে নিচের স্তরে অবস্থান করছে কৃষকরা। কৃষকের এই নাজুক অবস্থান কৃষি অগ্রযাত্রার সঙ্গে মোটেও সঙ্গতিপূর্ণ নয়। অন্যদিকে, সরকার বলছে, সারের সংকট নেই, কিন্তু মাঠের বাস্তবতা হচ্ছে, কৃষকের সার সংকটে ভোগান্তির শেষ নেই। বাড়তি দামেও মিলছে না সার। সার নিয়ে এক হযবরল পরিস্থিতি। এটা সরকারের ভাবমর্যাদা নষ্ট করছে। ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে কিংবা ধরপাকড়েও কাটছে না সংকট। সংকটের কারণ খোদ কৃষি মন্ত্রণালয়সহ সবারই অজানা। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অসাধু কর্মকর্তা, পরিবহন ঠিকাদার ও ডিলার বা প্রভাবশালীদের সিন্ডিকেটের মধ্যে সার। এ চক্রের লাগাম টেনে ধরতে হবে। নাহলে সংকট আরও গভীর হয়ে কৃষি খাতের অর্জন ম্লান হয়ে যাবে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত কৃষিবান্ধব। প্রতিটি স্তরেই তাঁর তীক্ষè নজর রয়েছে, বিশেষ করে কৃষি খাত তথা কৃষকদের নিয়ে তার ভাবনার অন্ত নেই। ফলে কৃষিতে বেশি বেশি প্রণোদনা দিতে হবে, বাজার নিয়ন্ত্রণে মধ্যস্বত্বভোগী ও বিভিন্ন পর্যায়ের সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম কমিয়ে আনতে হবে, কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে, সার ও কীটনাশকের সহজলভ্যতার মাধ্যমে কৃষিকে লাভজনক পেশায় পরিণত করতে হবে। তা না করতে পারলে, কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ অর্থনীতি রূপান্তরের মাধ্যমে যে টেকসই অর্থনীতি ও বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার কথা বলা হচ্ছে, তা সফল হবে না।

লেখকঃ পুঁজিবাজার বিশ্লেষক।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন