শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
ঋতুচক্রের পরিক্রমায় ষড় ঋতুর মধ্যে শরৎ তৃতীয়।বর্ষার পরেই শরতের আগমন।ঋতুচক্রের অন্য পাঁচটি ঋতু থেকে শরৎ একেবারে আলাদা,এবং এর স্বরূপ, বৈশিষ্ট্য অন্য ঋতুগুলোর চেয়ে অনেক বেশি সুস্পষ্ট।শরৎ বাংলাদেশের কোমল, স্নিগ্ধ এক ঋতু। বর্ষাকন্যা অশ্রæসজল চোখে বিদায় নেয় শ্রাবণে।ভাদ্রের ভোরের সূর্য মিষ্টি আলোর স্পর্শ দিয়ে প্রকৃতির কানে কানে ঘোষণা করে শরতের আগমন বার্তা। ভাদ্র-আশ্বিন দুই মাস শরৎকাল। ঝকঝকে নীল আকাশে শুভ্র মেঘ,ফুলের শোভা আর শস্যের শ্যামলতায় উচ্ছ¡সিত হয়ে ওঠে শরৎ।তাই তো প্রকৃতির সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে কবি গেয়ে
ওঠেন ---
“আজি ধানের খেতে রৌদ্র ছায়ায়
লুকোচুরির খেলা,
নীল আকাশে কে ভাসালে
সাদা মেঘের ভেলা।”
শরতের সৌন্দর্য বাংলার প্রকৃতিকে করে তোলে রূপময়।আকাশে উজ্জ্বল নীলিমার প্রান্ত ছুঁয়ে মালার মতো উড়ে যায় পাখির ঝাঁক। শিমুল তুলোর মতো ভেসে বেড়ায় সাদা মেঘের খেয়া।চারদিকে সজীব গাছপালার ওপর বয়ে যায় শেফালিফুলের মদির গন্ধভরা ফুরফুরে মিষ্টি হাওয়া।কবি, সাহিত্যিকের মনে জাগে শিহরণ,তাই প্রাচীন কাল থেকে বর্তমান তরুণ কবি, সাহিত্যিক শরতের প্রকৃতি থেকে উপকরণ সংগ্রহ করে লিখেন অসংখ্য কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ।বাংলাসাহিত্যের প্রাচীন কবি কালিদাসের ‘ঋতুসংহার’ কাব্যে লিখেছেন-- কাশফুলের মতো যার পরিধান, প্রফুল্ল পদ্মের মতো যার মুখ, উন্মত্ত হাঁসের ডাকের মতো রমণীয় যার নূপুরের শব্দ, পাকা শালিধানের মতো সুন্দর যার ক্ষীণ দেহলতা, অপরূপ যার আকৃতি— সেই নববধূর মতো শরৎকাল আসে। কি অসাধারণ শরৎ-পরিবেশনা! শরতের সাথে প্রকৃতি ও নারীর কত সুন্দর উপমা, বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না।কালিদাস ‘মেঘদূত’ কাব্যের জন্য বাংলা সাহিত্যে বিখ্যাত একটি নাম। এ কাব্যে তিনি শুধু মেঘের খামে পুরে প্রিয়ার কাছে চিঠি পাঠান নি, উচ্চারণ করেছেন যক্ষের যন্ত্রণাদগ্ধ কথামালা।শুধু মেঘ-ই নয়,শরৎ বন্দনায়ও তিনি ছিলেন অগ্রবর্তী।কালিদাস বলেন- প্রিয়তম আমার, ঐ চেয়ে দেখ, নববধূর ন্যায় সুসজ্জিত শরৎকাল সমাগত। মধ্যযুগের কবি,চÐীদাস তাঁর কবিতায় লিখেছেন--
‘ভাদর মাঁসে অহোনিশি আন্ধকারে
শিখি ভেক ডাহুক করে কোলাহল।
তাত না দেখিবোঁ যঁবে কাহ্নাঁঞির মুখ
চিনিতে মোর ফুট জায়িবে বুক।’
আধুনিকযুগের অসংখ্য কবি, সাহিত্যিক শরতের রূপে মুগ্ধ হয়ে লিখেছেন কত কথা কত গান।বাংলা সাহিত্যের বটবৃক্ষ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শরতের রূপবৈচিত্র তুলে ধরেছেন হৃদয়ের গভীর মাধুরি মিশিয়ে বিভিন্ন কবিতায়,গানে। তা থেকে কিছু পঙক্তি এখানে উল্লেখ করছি--
আজি কী তোমার মধুর মুরতি
হেরিনু শারদ প্রভাতে।শরৎ, তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি...।
ওগো শেফালি বনের মনের কামনা’, ‘সকল বন আকুল করে শুভ্র শেফালিকাগ্ধ
আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ’, ‘শিউলি সুরভিত রাতে বিকশিত জ্যোৎস্নাতে শরৎ প্রাতের প্রথম শিশির প্রথম শিউলি ফুলে’, ‘হৃদয় কুঞ্জবনে মঞ্জুরিল মধুর শেফালিকা।গ্ধ বলা হয়ে থাকে- রবীন্দ্রনাথের হাতেই শরৎকালের প্রকৃতির অপুর্ব রূপ কাব্য-সাহিত্যে অ¤øান হয়ে আছে তা উপর্যুক্ত পঙ্ক্তিগুলো অনুধাবন করলেই বুঝা যায়। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর অসংখ্য কবিতা,গানে শরতের নিখুঁত রূপ এঁকেছেন --গ্ধশিউলি ফুলের মালা দোলে শারদ রাতের বুকে ঐ’, ‘এসো শারদ প্রাতের পথিক›
‘এসো শারদ প্রাতের পথিক এসো শিউলি বিছানো পথে
এসো ধুইয়া চরণ শিশিরে এসো অরুণ-কিরণ রথে।
দলি শাপলা শালুক শতদল এসো রাঙায়ে তোমার পদতল
নীল লাল ঝরায়ে ঢল ঢল এসো অরণ্য পর্বতে। এসব গানসহ অনেক গানেই শরতের অপরূপ সৌন্দর্য তুলে এনেছেন।পল্লি কবি জসীমউদ্দীন শরতকে ‘বিরহী নারী’ দেখেছেন তাঁর অনুভূতি দিয়ে। তিনি লিখেছেন--
গণিতে গণিতে শ্রাবণ কাটিল, আসিল ভাদ্র মাস,
বিরহী নারীর নয়নের জলে ভিজিল বুকের বাস।
আজকে আসিবে কালকে আসিবে, হায় নিদারুণ আশা,
ভোরের পাখির মতন শুধুই ভোরে ছেয়ে যায় বাসা।
ত্রিশ শতকের কবি জীবনানন্দ দাশকে বলা হয় প্রকৃতির কবি,রূপসী বাংলার কবি,নির্জনতার কবি। তাঁর কবিতার প্রতিটি পঙ্ক্তিতে বাংলার প্রকৃতি,শরতের সার্থক চিত্র তুলে ধরেছেন। তিনি ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যের ‘এখানে আকাশ নীল’ কবিতায় বলেন-
‘এখানে আকাশ নীল-নীলাভ আকাশ জুড়ে সজিনার ফুল
ফুটে থাকে হিম শাদা-রং তার আশ্বিনের আলোর মতন;
আকন্দফুলের কালো ভীমরুল এইখানে করে গুঞ্জরণ...
নাগরিক কবি শামসুর রাহমানের শরতের পেঁজা মেঘের মতোই নরম।তাঁর কবিতার শব্দমালায় তিনি গেঁথেছেন শিউলি ফুলের মালা। —›কোথায় শিউলিতলা, সেই কবেকার ভোরবেলা—/যখন কুড়িয়ে ফুল, পেরিয়ে শিশিরভেজা পথ/বসতে পুকুরঘাটে, দৃষ্টি মেলে দিতে তুমি দূর/বহুদূর বনানীর দিকে অথবা সাঁতার কেটে/কাটত তোমার বেলা কারো কথা ভেবে নিরালায়?›
সৈয়দ শামসুল হক শরতের বিস্ময়ের কথা লিখেছেন --গ্ধসে কী বিস্ময়! কী যে বিস্ময়! কী করে ভুলি!আকাশের নীল ঘন শাদা মেঘ, কবেকার গ্রামপথে ডুলি!গ্ধ আসাদ চৌধুরী আশ্রয় খুঁজেছেন কাশফুল আর জ্যোৎস্নায়- ্রশাদা কাগজের ওপর রেগে যাই,সাড়ে চুয়াত্তরে এসে, বাক্যালাপে মেতে ওঠে,অসমাপ্ত পদ্যগুলো,স্মৃতিরাশি শাদা মেঘমালার চেয়েও,অধিক এলোমেলো।
শরতে উৎসবে সেজে ওঠে শস্যময়ী এই দেশ।মাঠভরা সবুজ ধান কৃষাণ- কৃষাণীর প্রাণে নব্বানের স্বপ্ন জাগায়।বাঙালি হিন্দু স¤প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা শরতেই উদযাপিত হয়।জলে-স্থলে ফুটে নানা রঙের ফুল শেফালী, মালতী, জুঁই, টগর, কামিনী ইত্যাদি শারদীয় ফুল।শরৎ বাংলাদেশের হৃদয়ের ঋতু,আনন্দের অগ্রদূত। তাই তো ইংরেজ কবি ফ্রামারজ বেঘারির কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে চাই-- তোমার শরৎ ঠোঁট, শরৎ চুল, শরৎ চোখ, শরৎ হাসি, শরৎ গ্রীবা— আমি শরৎকালে স্রষ্টাকে চুম্বন করি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।