চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
মাও. এইচএম গোলাম কিবরিয়া রাকিব
॥ এক ॥
“নিশ্চই আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে আলেমরাই তাঁকে ভয় করে” (সূরা ফাতির : ২৮)।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান বর্তমান বাংলাদেশে অনেক আগ থেকেই ইলমে দ্বীনের প্রচার ও প্রসার ছিল। আরব, ইরাক ও ইরান থেকে আগত পীর আউলিয়া ও ইসলামী চিন্তাবিদগণের মাধ্যমে এ দেশে ইলমে দ্বীনের অনুপ্রবেশ ঘটে এবং তাদের প্রচার ও প্রসারের মাধ্যমে ইলমে হাদিসের চর্চা ব্যাপকতা লাভ করে, এ দেশে অনেক বড় বড় মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে প্রতি বছর অসংখ্য লোক ইলমে দ্বীনের শিক্ষালাভ করে দ্বীন ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তির সাথে সাথে পরিচিত হয়। এ ধারাবাহিকতা অদ্যাবধি অব্যাহত রয়েছে।
যুগ যুগ ধরে মহান আল্লাহ প্রদত্ত জীবন বিধান ইসলামের প্রচার-প্রসার এবং কোরআন-হাদিসেরচর্চা নবী-রাসূল, সাহাবায়ে কিরাম, তাবেয়ীন, তাবে-তাবেয়ীন, আইম্মায়ে মুজতাহিদীন, আওলিয়ায়ে কিরাম এবং হক্কানী পীর-মাশায়েখ ও ওলামায়ে কিরামের মাধ্যমে হয়ে আসছে। আমাদের এই উপমহাদেশে ইসলামের প্রচার-প্রসারে হক্কানী পীর-মাশায়েখ ও ওলামায়ে কিরামের বিশেষ অবদান রয়েছে। মূলত আলেমরাই হচ্ছেন ইসলামের ধারক-বাহক। তাঁদের উপরই ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেয়ার মহান জিম্মাদারি। হাদিস শরিফে এসেছেÑ
“আলেমরাই হচ্ছে নবীগণের উত্তরসূরী” (তিরমিযী, আবু দাঊদ, ইবনে মাজা)।
ওলামায়ে কিরামের মর্যাদা
হজরত হাসান বসরী (রা.) বলেন, “আলেম বলা হয়, যে ব্যক্তি মহান আল্লাহ্কে না দেখে ভয় করে এবং আল্লাহ যা পছন্দ করেন তা সে পছন্দ করে ও আল্লাহ যা অপছন্দ করে তা সে বর্জন করে।” তারপর তিনি প্রথমোক্ত আয়াতখানা তিলাওয়াত করেন।
আবদুল্লাহ ইবনে মাসুদ (রা.) বলেন : “অনেক হাদিস মুখস্থ করে নেয়া ইলম নয়, বরং ইলম হচ্ছে আল্লাহকে অধিক ভয় করা।”
হজরত রবী ইবনে আনাস (রা.) বলেন : “যে ব্যক্তির মধ্যে আল্লাহর ভয় নেই, সে আলেম নয়”।
মুজাহিদ (রা.) বলেন : “কেবল সেই আলেম যে আল্লাহকে ভয় করে।”
সত্যপন্থী হক্কানী আলেমগণ হচ্ছেন একটি জাতির, একটি দেশের, বিশেষত মুসলিম উম্মাহ্র শ্রেষ্ঠ সন্তান, সর্বোপরি এক একজন পথপ্রদর্শক। একজন শিক্ষিত লোক, ধনী লোক, প্রভাবশালী ও ক্ষমতাসীন ব্যক্তি, যদি তার মধ্যে আল্লাহ ভীতি না থাকে, তাহলে আল্লাহ্র নিকট তার কোনো মূল্য নেই। যেমন হাদিস শরিফে এসেছেÑ
“নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের চেহারা-স্বাস্থ্য ও ধন-সম্পদের দিকে তাকান না, বরং তিনি তোমাদের অন্তর ও আমলের দিকে তাকান”।
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আলেমদের মর্যাদার বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন :
“যারা জানে ও যারা জানে না, তারা কি এক সমান হতে পারে ? (সূরা জুমার : ৯)
“যদি তোমরা না জান তাহলে জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞেস কর” (সূরা নাহল : ৪৩)
আলেমদের মর্যাদা সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেন : “তোমাদের উপর আমার মর্যাদা যেমন, একজন ইবাদতকারীর উপর আলেমের মর্যাদা তেমন। তারপর রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেন, যাঁরা জনগণকে দ্বীনি ইলম শেখায় তাদের জন্য আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতাগণ, আসমান ও জমিনের অধিবাসীগণ, এমনকি গর্তের পিঁপড়া ও মাছ পর্যন্ত কল্যাণ কামনা করতে থাকে”(তিরমিযী)।
“আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বণিত। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন, একজন বিজ্ঞ আলেম শয়তানের নিকট এক হাজার আবেদের চেয়ে ভয়াবহ” (তিরমিযী, ইবনে মাজাহ)।
বর্ণিত হাদিস দুটি থেকে উপলব্ধি করা যায় যে, আলেমদের মর্যাদা কত বেশি!
হক্কানী ওলামায়ে কেরাম ও পীর-মাশায়েখদের কারণে দ্বীন ইসলাম এবং কোরআন-হাদিসের চর্চা কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। এমন একসময় আসবে যখন হক্কানী আলেমগণ ব্যতীত বেআলেম, সাধারণ মুসলমান নিজের খেয়াল-খুশিমত শরীয়াতের বিভিন্ন বিষয়ে ফাতওয়া দেওয়া শুরু করবে। যেমন রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন,
নিশ্চয়ই আল্লাহ ‘ইলম’ বা জ্ঞানকে তাঁর বান্দাদের মন থেকে টেনে-হেঁচড়ে উঠিয়ে নিয়ে যাবেন না, বরং আলেমদেরকে দুনিয়া থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে ইলমকে উঠিয়ে নেবেন। এরপর যখন কোনো আলেম অবশিষ্ট থাকবে না, মানুষ অজ্ঞ জাহেল লোকদেরকে নেতা বানাবে, তারপর তাদের নিকট ফাতওয়া জিজ্ঞেস করবে। তখন তারা বিনা ইল্মেই ‘ফাতওয়া’ দিবে। ফলে তারা নিজেরাও পথভ্রষ্ট হবে, অন্যদেরকেও পথভ্রষ্ট করবে” (বুখারি ও মুসলিম)।
ওলামায়ে কিরামের দায়িত্ব ও কর্তব্য
ওলামায়ে কিরামের মর্যাদার পাশাপাশি তাঁদের অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। আল্লাহ প্রদত্ত ‘ইল্ম’ যদি তার আল্লাহ ও তার রাসূল (সা.)-এর নির্দেশিত পথে কাজে না লাগায়, তাহলে তাদেরকেও আল্লাহ্র কাঠগড়ায় বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। দ্বীন ইসলামের প্রচার ও প্রসারে একজন আলেমের প্রধান ভূমিকা থাকা উচিত। কারণ এই দাওয়াতী কাজ আমাদের প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-সহ সকল নবী-রাসূল (আ.) করে গেছেন। তাঁদের উত্তরসূরী হিসেবে আলেমদেরকেও এই দাওয়াতী কার্যক্রম চালু রাখতে হবে। এই বিষয়ে আল্লাহর হুকুম হচ্ছেÑ
“তুমি তোমার প্রভুর পথে (মানুষকে) হেকমত (প্রজ্ঞা) ও উত্তম উপদেশের মাধ্যমে ডাকো।” (সূরা নাহল : ১২৫)
“তোমরাই উত্তম জাতি, তোমাদেরকে বের করা হয়েছে মানুষদেরকে সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করার জন্য” (সূরা আলে ইমরান : ১১০)।
“তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল অবশ্যই থাকতে হবে যারা মানুষকে কল্যাণের দিকে ডাকবে, সৎ কাজের আদেশ দিবে এবং অসৎ কাজে নিষেধ করবে”(আলে ইমরান : ১০৪)।
এই আয়াতগুলো দ্বারা আল্লাহ তাআলা দাওয়াতের গুরুত্ব বুঝিয়েছেন। একজন দা‘ঈ আল্লাহ তালার নিকট অনেক সম্মানের অধিকারী। আল্লাহ বলেনÑ
“তার কথার চেয়ে আর কার কথা অধিক উত্তম হতে পারে, যে মানুষকে আল্লাহ্র দিকে ডাকে, সৎকাজ করে এবং বলে, আমি একজন মুসলমান” (সূরা হা-মীম-সাজদা : ৩৩)
বাংলাদেশে ইলমে দ্বীনের অনুপ্রবেশ ও প্রচার প্রসারের ইতিহাস :
বাংলাদেশে ইলমে দ্বীনের চর্চা, প্রচার ও প্রসারের ইতিহাসে মধ্যপ্রাচ্য ও ভারতীয় উপমহাদেশের প্রখ্যাত কয়েকজন পীর আউলিয়া ও মুহাদ্দিসের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। নি¤েœ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে এব্যাপারে দ্বীনের দায়ীদের মধ্য থেকে উল্লেখযোগ্য কয়েকজনের পরিচয় তুলে ধরা হলো।
আলাউদ্দীন হোসাইন শাহ : আলাউদ্দীন হোসাইন শাহ ইবনে সাইয়েদ আশরাফ মক্কী হিজরী ৯০০ সন থেকে ৯২৪ সন পর্যন্ত বঙ্গদেশে রাজত্ব করেন। তাঁর শাসনামলে কোরআন ও হাদিস শিক্ষার ব্যাপক প্রচলন করার ব্যাপারে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তিনি ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানে পারদর্শী লোকদেরকে তাঁর রাজ্যে আসার ও বসবাস করার আহ্বান জানান। তিনি হিজরী ৯০৭ সনে তৎকালীন গৌড়স্থ গুরবাযে শহীদ নামক স্থানে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইলমে দ্বীনের শিক্ষা দান করা হতো। তারই শাসনামলে মুহাম্মদ ইবনে ইয়জদান বখশ সহীহ বুখারিকে তিন খন্ডে ভাগ করেন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।