পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
সরকারের কর্তা ব্যক্তিরা প্রায়ই বলেন, আমরা সিঙ্গাপুরের মতো উন্নত হতে চলেছি। অমুক ক্ষেত্রে, তমুক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের মডেল। দেশ খাদ্যে স্বয়ম্ভর হয়েছে, মাথা পিছু আয় বেড়েছে। ৯৭% মানুষের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছেছে, দেশ ডিজিটাল দেশে পরিণত হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে দারিদ্রমুক্ত ও উচ্চ মধ্য আয়ের, ২০৩৫ সালের মধ্যে বিশ্বের ২৫তম বৃহত্তম অর্থনৈতিক দেশ এবং ২০৪০ সালের মধ্যে ধনী দেশ হবে ইত্যাদি। কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে দেশের অবস্থা তেমন নয়। তবে ক্রমান্বয়ে উন্নতি হতে হতে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে নি¤œমধ্য আয়ের দেশ হয়েছে। ২০২৪ সাল থেকে মধ্য আয়ের দেশ হতে পারে। বর্তমানে দেশের জিডিপির আকার হয়েছে ৪৬৫ বিলিয়ন ডলার। তবে এ ক্ষেত্রে একটু কিন্তু আছে। সেটা হচ্ছে: বিবিএস ২০০৫-০৬ অর্থবছরকে ভিত্তি ধরে ও ১৪টি খাতকে যুক্ত করে ২০১৩ সালে থেকে জিডিপি নির্ণয় শুরু করেছে। কিন্তু ২০২১ সাল থেকে ২০১৫-১৬ অর্থবছরকে ভিত্তি ও ২৫টি খাতকে যুক্ত করে জিডিপি নির্ণয় করছে। উপরন্তু মোট লোকসংখ্যা ১৬ কোটি ধরে মাথাপিছু গড় আয় নির্ণয় করছে। কিন্তু প্রকৃত লোক সংখ্যা আরো বেশি। সেটা ধরে হিসাব করলে মাথা পিছু আয় কমবে। যা’হোক, দেশে যেটুকু উন্নতি হয়েছে, তার ভাগ সাধারণ মানুষ পায়নি। তাই তারা যে তিমিরে ছিল সেখানেই রয়েছে। ভূমিহীন ও গৃহহীনের সংখ্যাও অনেক। তাদের অধিকাংশই মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। বিশ্ব ক্ষুধা সূচক-২০২১ মতে, ১১৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ৭৬তম। বিভিন্ন তথ্য মতে, করোনা মহামারির কারণে দেশে দারিদ্র্য বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে ৪২% হয়েছে। উপরন্তু স¤প্রতি পণ্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে নতুন করে ৫০ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়েছে। জাতিসংঘের এফএও প্রণীত ‘দ্য স্টেট অফ ফুড সিকিউরিটি অ্যান্ড নিউট্রিশন ইন দ্য ওয়ার্ল্ড-২০২২’ শীর্ষক প্রতিবেদন মতে, ২০২০ সালে পুষ্টিকর খাবার থেকে বঞ্চিত মানুষের হার বাংলাদেশে ৭৩.৫%, আর বৈশ্বিক গড় ৪২%। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে পণ্যমূল্য আকাশচুম্বী হওয়ায় এই হার আরো বেড়েছে। কারণ, এই সময়ে মানুষের উপার্জন বাড়েনি। বরং অনেকের কমেছে। তাই সঞ্চয়ের হার কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০২২ অনুযায়ী, মোট জিডিপির তুলনায় দেশজ সঞ্চয় ২০১৯-২০ অর্থবছরে ছিল ২৭.০৮% আর ২০২১-২২ অর্থবছরে তা কমে হয়েছে ২১.৫৬%। প্যারিস স্কুল অব ইকোনমিকসের ওয়ার্ল্ড ইন ইকুয়ালিটি ল্যাবের বৈশ্বিক অসমতা প্রতিবেদন-২০২২ মতে, বাংলাদেশে ২০২১ সালে শীর্ষ ১০% ধনীর আয় মোট জাতীয় আয়ের ৪৪% ও শীর্ষ ১% ধনীর আয় ১৬.৩% এবং পিছিয়ে থাকা ৫০% মানুষের আয় মাত্র ১৭.১%। দেশে গত ৩১ মার্চ পর্যন্ত দেশে ব্যাংকগুলোয় কোটি টাকার ওপরে হিসাবধারীর সংখ্যা ছিল ১,০৩,৫৭৯টি। এসব ধনীর সম্পদের অধিকাংশই হয়েছে অবৈধ পথে ও ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ না করে। তাই দ্রæত অতি ধনী হওয়ার ক্ষেত্রে দেশ কয়েকবার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছে। এদের অনেকেই বছরে প্রায় পৌনে এক লাখ কোটি টাকা পাচার করছে দীর্ঘদিন যাবত। এদের অনেকেই কানাডায় বেগম পাড়া ও মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে সেকেন্ড হোম করেছেন। হাইকোর্ট গত ২৬ জুলাই বলেছেন, সবচেয়ে সাংঘাতিক ক্রাইম হচ্ছে ব্যাংকে। ব্যাংক খাতে বড় বড় অপরাধ হচ্ছে। দেশটাকে পঙ্গু করে দিচ্ছে।
দেশে আয় বৈষম্য, বেকারত্ব ও বাল্য বিবাহ সর্বাধিক হয়েছে। নিপোর্ট’র ২০১৭-১৮ সালের জরিপ মতে, নারীদের বিয়ে হয়েছে বয়স ১৫ বছর হওয়ার আগে ৩১% আর বয়স ১৮ বছর হওয়ার আগে ৫৯%। বর্তমানে এ হার আরো বেড়েছে। যোগাযোগ, পরিবহন, আবাসন, দূষণ, শিক্ষা, চিকিৎসা, অন্ন, বস্ত্র, জ্বালানি, বিনিয়োগ, ব্যাংকের খেলাপি ঋণ, জেন্ডার বৈষম্য ইত্যাদিতে ভয়াবহ সংকট চলছে। মানুষের শহরমুখিতা ব্যাপক হওয়ায় শহরের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে। আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতিতে রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। দেশে প্রকৃত গণতন্ত্র ও সুশাসন নেই। নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গেছে। ‘ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্ট’র আইনের শাসন সূচক-২০২২ মতে, বিশ্বের ১৩৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১২৪তম। মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগে র্যাব এবং তার প্রাক্তন ও বর্তমান ৭ কর্মকর্তার উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে আমেরিকা। জাতিসংঘেও গুম নিয়ে তদন্ত চলছে। দেশের মোবাইল ইন্টারনেটের গতি উগান্ডারও নিচে।
দেশের প্রায় ৬০% মানুষ এখনো কৃষির সাথে সংশ্লিষ্ট। কিন্তু শিল্পায়ন, গৃহায়ন, রাস্তা ইত্যাদি নির্মাণ ও নদী ভাঙ্গনের কারণে ক্রমান্বয়ে কৃষি জমি কমছে। অন্যদিকে, মানুষ বাড়ছে। এছাড়া, জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপক ক্ষতিও রয়েছে। ফলে যেভাবে মানুষ বাড়ছে সেভাবে খাদ্য উৎপাদন বাড়ছে না। ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্য মতে, ২০১৭-২০২২ সাল পাঁচ বছরে বাংলাদেশের জনসংখ্যা বেড়েছে ৫.২৯% হারে। কিন্তু এই সময়ে চাল ও গমের মোট উৎপাদন বেড়েছে ৪.১৪% হারে। তাই প্রতি বছরই ৫০ লাখ মে.টনের মতো চাল ও গম আমদানি করতে হচ্ছে। এছাড়া, খাদ্যপণ্যের বাকিগুলোর অধিকাংশই আমদানিনির্ভর। সর্বোপরি খাদ্যবহির্ভূত পণ্যেরও বেশিরভাগই আমদানি করতে হয়। দেশ কার্যত বিদেশি পণ্যের বাজারে পরিণত হয়েছে।
গত সাত বছর ধরে দেশে বেসরকারি বিনিয়োগ জিডিপির ২২-২৩% এর মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। এছাড়া, আঙ্কটাড’র ওয়ার্ল্ড ইনভেস্টমেন্ট রিপোর্ট-২০২২ মতে, বাংলাদেশে গত ছয় বছরে এফডিআই’র অন্তঃপ্রবাহ বেড়েছে ২৪% আর বহিঃপ্রবাহ বেড়েছে ১২৪%। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০২২ অনুযায়ী, মোট জিডিপির তুলনায় দেশজ সঞ্চয় ২০১৯-২০ অর্থবছরে ছিল ২৭.০৮% আর ২০২১-২২ অর্থবছরে তা কমে হয়েছে ২১.৫৬%। ওদিকে ব্যাংকের আমানতও ক্রমান্বয়ে কমছে।
বর্তমানে দেশের প্রতিটি নাগরিকের মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ ৯৫,৬০০ টাকা। আগামী এক বছরে এটা আরও প্রায় ১৫ হাজার টাকা বেড়ে দাঁড়াবে ১ লাখ ১১ হাজার টাকা। কারণ, বর্তমানে দেশের মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে মোট জিডিপির প্রায় অর্ধেক। তন্মধ্যে গত মার্চ পর্যন্ত মোট বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৩.২৩ বিলিয়ন ডলার, যা জিডিপি প্রায় ২১%। এই ঋণের ৭৩% সরকারি ও ২৭% বেসরকারি। তাই অনেকের অভিমত হচ্ছে: বাংলাদেশ বিদেশি ঋণের ফাঁদে পড়েছে! এ বিদেশি ঋণের ৩৬%-বিশ্বব্যাংক, ২৩%-এডিবি, ১৮-জাপান, ৮%-চীন, ১% দক্ষিণ কোরিয়া, ১২%-আইডিবি ও অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগী থেকে। বর্তমানে দেশি-বিদেশি ঋণের কিস্তি ও সুদ পরিশোধে বছরে প্রায় পৌনে এক লাখ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে। মেগা প্রকল্পগুলোর বিদেশি ঋণের কিস্তি ও সুদ পরিশোধ শুরু হবে আগামী অর্থবছর থেকে। এ ব্যাপারে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য গত ২১ জুলাই বলেন, দেশে বর্তমানে ২০টি মেগা প্রকল্প চালু আছে। যার মোট ব্যয় ৭০.০৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে ৪৩ বিলিয়ন ডলার বিদেশি ঋণ। এই ২০টি মেগা প্রকল্পের ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে ২০২৪-২০২৬ সালের মধ্যে অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা আসছে। বর্তমানে জিডিপির অনুপাতে বিদেশি দায়-দেনা পরিশোধ করা হয় প্রায় ১.১%। ২০২৬ সাল নাগাদ তা দ্বিগুণ হতে পারে। এই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব রয়েছে। কিন্তু মেগাপ্রকল্পের ঋণ ছাড়াও দেশ-বিদেশের আরো বিপুল ঋণ রয়েছে। তারও কিস্তি ও সুদ পরিশোধ করতে হবে একই সময়ে। সব মিলে বিপুল অর্থ লাগবে, সে অর্থের যোগান কীভাবে হবে তা নিয়ে আশংকা দেখা দিয়েছে। এদিকে, দিনদিন টাকার মান, রেমিটেন্স ও গার্মেন্টের অর্ডার কমছে! বাণিজ্য ঘাটতিও রেকর্ড পরিমাণে বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, ২০২১-২২ অর্থবছর শেষে বাণিজ্য ঘাটতি ৩৩২৫ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। একই সময় বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যের ঘাটতিও ১৮.৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রা মজুদ ক্রমান্বয়ে কমছে। রিজার্ভ থেকে যে ঋণ দেওয়া হয়েছে, বিপিএম-৬ ম্যানুয়াল অনুযায়ী সেটা বাদ দিয়ে রিজার্ভের হিসাব করার জন্য আইএমএফ তাগিদ দিয়েছে। সেটা হলে রিজার্ভের পরিমাণ ৩৯ বিলিয়ন ডলার থেকে কমে দাঁড়াবে ৩১ বিলিয়ন ডলার (বর্তমানে রিজার্ভের অর্থে মার্কিন ডলারে ইডিএফে ৭০০ কোটি, জিটিএফে ২০ কোটি, এলটিএফএফে ৩.৮৫ কোটি, পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষকে ৬৪ কোটি, বাংলাদেশ বিমানকে ৪.৮০ কোটি ও শ্রীলঙ্কাকে ২০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়া হয়েছে, যার মোট পরিমাণ ৮১২.৬৫ কোটি ডলার)। সর্বোপরি প্রায় ৮-৯ বিলিয়ন ডলারের সোনা আছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এটাও রিজার্ভের চলতি হিসাবায়ন থেকে বাদ দিতে হবে। তাহলে শুধু ব্যবহার করা যাবে ২২ বিলিয়ন ডলারের মতো। স¤প্রতি দেশের মাসিক আমদানি ব্যয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭.৫-৮ বিলিয়ন ডলার। তিন মাসের আমদানি ব্যয় মিটানোর রিজার্ভ না থাকলে পণ্য আমদানির এলসি খুলতে সমস্যা হয়। তাই এখন মজুদ ঠিক রাখার লক্ষ্যে এলসি খুলতে ব্যাপক কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। উপরন্তু টেলিটকের ৫জি প্রকল্প বাতিল করা হয়েছে।
দেশের বর্ণিত ঋণ পরিস্থিতিতে বিবিসির তালিকায় শ্রীলঙ্কার মতো অর্থনৈতিক সংকটের ঝুঁকিতে থাকা দেশের তালিকার মধ্যে বাংলাদেশকেও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। অবশ্য বিবিসিকে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেছেন, রিজার্ভ নিয়ে আমরা কিছু চাপে আছি, তবে আশঙ্কাজনক নয়। আন্তর্জাতিক কিছু সংস্থাও বলেছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি ভালই চলছে। অপরদিকে, আইএমএফ স¤প্রতি কর জিডিপির হার ১০.৩% থেকে ১৫% উন্নীত, ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমানো ও সুদহার উন্মুক্ত এবং কৃষি ও জ্বালানিতে ভর্তুকী কমানোর তাগিদ দিয়েছে। সরকার আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, জাইকা, এডিবি, এআইআইবি ও ইইউ থেকে মোটি ৭৭৪.৯ কোটি ডলার ঋণ নেয়ার চেষ্টা করছে। এর মধ্যে আইএমএফ’র ৪৫০ কোটি ডলার।
দেশের বর্তমান আর্থিক দুর্গতি অনুধাবন করে সরকার অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ বন্ধ, চাল আমদানির অনুমতি প্রদান ও ব্যাপক ব্যয় সংকোচন নীতি গ্রহণ করেছে। তবে জ্বালানিতে ব্যয় সংকোচনের কারণে ক্ষতি হচ্ছে সর্বাধিক, যা সরকারের অদূরদর্শিতার কারণেই হচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। কারণ, দেশীয় তেল-গ্যাস-কয়লা আহরণ না করে জ্বালানি খাতকে আমদানিনির্ভর করা, বিদ্যুৎ না নিয়েও ৭০ হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি সার্জ প্রদান ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি পরিকল্পনা মাফিক বৃদ্ধি না করার কারণেই দেশের জ্বালানি খাত এখন মরণাপন্ন হয়েছে। যার ব্যাপক প্রভাব পড়ছে কৃষি, শিল্প ও পরিবহন খাতে। এ জন্য সরকার ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধকে দায়ী করছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসজিএস, নরওয়ের জাতীয় তেল ও গ্যাস কোম্পানি এনডিপি, ডেনমার্কের গ্যাস পরামর্শ জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশের এখনো অনাবিষ্কৃত গ্যাস রিজার্ভের পরিমাণ ৩২-৪২ টিসিএফ, যা দেশের ২৫-৩০ বছরের প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম। অথচ, সেদিকে গুরুত্ব না দিয়ে এলএনজি আমদানির পথ বেছে নেয়া হয়েছে। এদিকে, স¤প্রতি বৈশ্বিক জ্বালানি পণ্যের মূল্য ব্যাপক বেড়েছে। ফলে দেশে জ্বালানি খাতে ব্যাপক সংকট সৃষ্টি হয়েছে।
গত ২৭ জুলাই প্রকাশিত ‘জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২’-এর প্রাথমিক প্রতিবেদন মতে, দেশের বর্তমান মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬ জন। জনসংখ্যার গড় বৃদ্ধির হার ১.২২% ও ঘনত্ব ১,১১৯ জন। অন্যদিকে, জাতিসংঘের সা¤প্রতিক রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২২ সালে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১,৩১৫ জন মানুষ বাস করছে বাংলাদেশে। বিশ্ব ব্যাংকের মতে, বাংলাদেশে নারীর গড় ফার্টিলিটি রেট ১.৯৭৯টি। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের মতে, দেশের জনসংখ্যা এখন ১৮ কোটি। আর সাধারণ মানুষের ধারণা, দেশের জনসংখ্যা এখন ১৮ কোটির বেশি। এ অবস্থায় মোট জনসংখ্যার সঙ্গে প্রতিবছর ২৪-২৫ লাখ মানুষ যুক্ত হচ্ছে। এটা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালে মোট লোকসংখ্যা হবে ২২.২৫ কোটি।
২০২৬ সাল থেকে দেশে শুরু হবে এলডিসি উত্তরণের চ্যালেঞ্জ, যা খুবই কঠিন। কারণ, তখন থেকে আন্তর্জাতিক সহায়তা ও বাণিজ্যিক সুবিধা এবং অভ্যন্তরীণ ভর্তুকি বন্ধ হবে। ফলে কঠিন পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। এদিকে, ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ছয় সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল স¤প্রতি বাংলাদেশ সফর করে বলেছে, ২০২৫ সালের মধ্যে শিশুশ্রম নির্মূল, সরকার ঘোষিত শ্রম অধিকার রোডম্যাপ বাস্তবায়ন, শ্রম আইনের সংশোধনী পাস ও ইপিজেডে ট্রেড ইউনিয়নের অধিকারের আইন পাস করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রও শ্রম ও শ্রমিকের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির কথা বলেছে। সরকার যে জিএসপি প্লাস পাওয়ার চেষ্টা করছে, তা পেতে এসব শর্ত পূরণ করতে হবে বলে ইতোপূর্বে জানিয়েছে তারা। কিন্তু এসব শর্ত মানা হলে দেশের কল-করখানা নতুন সংকটে পড়বে। তবুও এসব করতে হবে শিল্প ও শ্রমিকের কল্যাণের জন্য। বিশেষজ্ঞদের অভিমত-২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হতে গেলে ২০৩০ সালের মধ্যে শুধু অবকাঠামো খাতে ৩২০ বিলিয়ন ডলার ও বেসরকারি বিনিয়োগ জিডিপির ৩৬% উন্নীত করতে হবে। সে জন্য বিদেশি বিনিয়োগ ৬ গুণ ও রপ্তানি ৯ গুণ বাড়াতে হবে। কিন্তু বৈশ্বিক মহামন্দাকালে তা কি সম্ভব হবে?
দেশের চলতি ও সম্ভাব্য আর্থিক, প্রাকৃতিক ও সামাজিক সংকট ব্যাপকতর, সর্বোপরি ভয়াবহ বৈশ্বিক সংকট তো রয়েছেই। এসব সংকট দূর না হলে কাক্সিক্ষত সার্বিক উন্নতি হবে না। টেকসই সার্বিক উন্নতির জন্য প্রকৃত গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা, সর্বস্তরে কর্মমুখী শিক্ষা চালু ও শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং দুর্নীতি, অর্থ পাচার, হুন্ডি, অপচয়, মাদক নির্মূলসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিককরণ, ব্যয় সংকোচন নীতি দীর্ঘদিন অব্যাহত রাখা, সামাজিক সুরক্ষার ব্যাপ্তি ও পরিমাণ বৃদ্ধি, কৃষিসহ সব ক্ষেত্রের উৎপাদন বৃদ্ধি ও বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা অর্জন, সব ধরনের দূষণ বন্ধ, সর্বজনীন সুচিকিৎসা নিশ্চিত, রফতানি বহুমুখী করে বাণিজ্যে ভারসাম্য সৃষ্টি, হালাল পণ্য রফতানি বৃদ্ধি, বিনিয়োগের অনুক‚ল পরিবেশ সৃষ্টি, কর জিডিপির হার ১৫%-এ উন্নীত করা, ব্যাংকের সব খেলাপি ঋণ আদায় এবং কয়লা, তেল, গ্যাস ও সামুদ্রিক সম্পদ আহরণে ও প্রবাসী প্রেরণ বৃদ্ধি এবং জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ নীতি বাস্তবায়নে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।