Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বাঘ সংরক্ষণের দায়িত্ব আমাদেরই

মো. আরাফাত রহমান | প্রকাশের সময় : ২৯ জুলাই, ২০২২, ১২:০৭ এএম

বাংলাদেশের সুন্দরবন এলাকায় যে সুদর্শন বাঘ দেখা যায় তা পৃথিবীব্যাপী রয়েল বেঙ্গল টাইগার নামে পরিচিত। রয়েল বেঙ্গল টাইগার বাঘের একটি বিশেষ উপপ্রজাতি। বেঙ্গল টাইগার বাংলাদেশের জাতীয় পশু। এছাড়াও নেপাল, ভুটান, মায়ানমার ও দক্ষিণ তিব্বতের কোনো কোনো অঞ্চলে এই প্রজাতির বাঘ দেখতে পাওয়া যায়। বাঘের উপপ্রজাতিগুলির মধ্যে বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যাই সর্বাধিক। সমগ্র বিশ্বে বাঘের সংরক্ষণের জন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে প্রতি বছর ২৯ জুলাই পালন করা হয় বিশ্ব বাঘ দিবস। মুখ্য উদ্দেশ্য হল বাঘের প্রাকৃতিক আবাস রক্ষা করা এবং বাঘ সংরক্ষণের জন্য সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করে এর সম্পর্কে থাকা ভুল ধারণা ও ভয় দূর করা।

প্রথাগতভাবে মনে করা হয়, সাইবেরীয় বাঘের পর বেঙ্গল টাইগার দ্বিতীয় বৃহত্তম উপপ্রজাতি। বাংলাদেশের ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইনের তফসিল-১ অনুযায়ী এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত। কয়েক দশক আগেও বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের বিচরণ ছিল। পঞ্চাশের দশকেও মধুপুর এবং ঢাকার গাজীপুর এলাকায় এই বাঘ দেখা যেতো। মধুপুরে সর্বশেষ দেখা গেছে ১৯৬২ এবং গাজীপুরে ১৯৬৬ সালে। বর্তমানে সারা পৃথিবীতে ৩০০০-এর মতো বাঘ আছে, এর মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি আছে ভারতে। তবে বাংলাদেশে সুন্দরবনই রয়েল বেঙ্গল টাইগারের শেষ আশ্রয়স্থল। কিন্তু এই প্রাণী খুব সুন্দর এবং এর চামড়া খুবই মূল্যবান। তাই চোরা শিকারিদের কারণে এই প্রাণী প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া বনাঞ্চল উজাড় হয়ে যাওয়া, খাবারের অভাব এবং পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে এই প্রাণী প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

বাঘের ৮টি উপপ্রজাতির মধ্যে ৫টি এখনও জীবিত। গত পঞ্চাশ বছরে বাঘের যে ৩টি প্রজাতি লোপ পেয়েছে তা হলো জাভার বাঘ, বালির বাঘ ও কাস্পিয়ান বাঘ। বাঘ সাধারণত নিঃসঙ্গ, কখনও জোড়ায় থাকে। প্রধানত নিশাচর, মাঝারি ও বড় আকারের স্তন্যপায়ী মহিষ, হরিণ, বুনো শূকর ও সজারু ইত্যাদি শিকার করে খায়। একসঙ্গে ২-৫টি বাচ্চা প্রসব করে। গর্ভকাল আনুমানিক ১৪-১৫ সপ্তাহ। অধিকাংশ বাচ্চাই ফেব্রæয়ারি-মে মাসের মধ্যে জন্মায়। মায়ের যতেœই ৪-৫ মাস লালিত-পালিত হয়। বাচ্চারা এক বছর বা আরও বেশি সময় মায়ের সঙ্গে থাকে। বাঘিনী ও বাঘ প্রজননক্ষম হয় যথাক্রমে ৩ ও ৪ বছর বয়সে। বড় আকারের বাঘের দৈনিক মাংস চাহিদা গড়পড়তা ৮-৯ কেজি। নিজের চেয়ে দ্বিগুণ বড় জন্তু শিকার করতে পারে। লভ্য শিকারের সংখ্যার ওপরই একটি এলাকায় বাঘের সংখ্যা নির্ভর করে। বাঘ অত্যন্ত অভিযোজিত দক্ষ জন্তু; উষ্ণমন্ডলীয় অরণ্য, ম্যানগ্রোভ জলাভূমি, পত্রমোচী বন সর্বত্রই বসবাস করতে পারে। নানা জলবায়ুতে উপমহাদেশের অত্যুষ্ণ বনাঞ্চল থেকে রাশিয়ায় তুষারঢাকা হিমশীতল দূরপ্রাচ্যেও বাঘেরা বসবাস করে।

সুন্দরবনে প্রথমবারের মতো বাঘ শুমারি হয় ১৯৭৫ সালে। একটি বেসরকারি গবেষণায় জার্মান গবেষক হেন রিডসে জানান, সুন্দরবনে ৩৫০টি বাঘ রয়েছে। ১৯৮৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগ পরিচালিত এক জরিপে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ৩০০টি উল্লেখ করা হয়। ১৯৯৮ সালে নেপালি বংশদ্ভূত এক আমেরিকান গবেষক সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য নিয়ে চালিত একটি প্রকল্প শেষে বাঘের সংখ্যা ৩৫০টি বলে উল্লেখ করেন।

২০০৪ সালে একটি জরিপ শেষে বন বিভাগ জানায়, সুন্দরবনে বাঘ আছে ৪৪০টি। ২০১০ সালে বন বিভাগ এবং ওয়াইল্ড ট্রাস্ট অব বাংলাদেশ যৌথভাবে চালিত বাঘ শুমারির পর জানায়, বনে বাঘের সংখ্যা ৪০০ থেকে ৪৫০টি। ২০১৫ সালে বন বিভাগ অপর একটি জরিপ শেষে ঘোষণা দেয়, সুন্দরবনে বাঘ রয়েছে ১০৬টি। তবে ২০১৫ সালের জরিপটিতে অত্যাধুনিক ক্যামেরা ট্র্যাপিং পদ্ধতি ব্যবহার করা হলেও আগের জরিপগুলো করা হয়েছিল পাগমার্ক বা পায়ের ছাপ পদ্ধতিতে। বাঘ গণনার ক্ষেত্রে যেসব পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় সেগুলোর মধ্যে ক্যামেরা ট্র্যাপিং পদ্ধতিই বিজ্ঞানভিত্তিক। সর্বশেষ ২০১৮ সালের জরিপ অনুযায়ী এ বনে বাঘের সংখ্যা ১১৪টি।

বাঘ নিধন ও হরিণ শিকার বন্ধের জন্য অধিকতর শাস্তির বিধান রেখে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন ২০১২ জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে। এ আইনের ৩৬ ধারায় বাঘ শিকারি বা হত্যাকারী জামিন-অযোগ্য হবেন এবং সর্বোচ্চ ৭ বছর ও সর্বনিম্ন ২ বছর কারাদন্ড এবং জরিমানা এক লাখ থেকে ১০ দশ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ডে দন্ডিত হবেন। বন বিভাগ ইতোমধ্যে বাংলাদেশ টাইগার একশন প্ল্যান (২০১৮-২০২৭) প্রণয়ন করেছে। বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে সুন্দরবনসহ সারা দেশে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য সমাপ্তকৃত প্রকল্পের ৫০ জন দক্ষ কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। বন বিভাগের ওয়াইল্ডলাইফ ক্রাইম কন্ট্রোল ইউনিট যৌথ উদ্যোগে নিয়মিতভাবে মাঠপর্যায়ে অবৈধভাবে বন্যপ্রাণী পাচার, বিক্রি ও প্রদর্শন রোধপ্রকল্পে কাজ করে যাচ্ছে। এ পর্যন্ত অনেক বন্যপ্রাণী পাচারকারীর কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে এবং পাচারকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় অসুস্থ বাঘকে সেবাদানের জন্য খুলনায় একটি ওয়াইল্ডলাইফ রেসকিউ সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে।

সুন্দরবনের চারপাশের গ্রামগুলিতে বন বিভাগ ও স্থানীয় জনসাধারণের সমন্বয়ে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলায় একটি টাইগার রেসপন্স টিম এবং সুন্দরবন সংলগ্ন গ্রাম এলাকায় ৪৯টি ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিম গঠন করা হয়েছে। এর ফলে লোকালয়ে বাঘ আসা মাত্র খবরাখবর আদানপ্রদান ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। এই উদ্যোগটি অধিকাংশ ক্ষেত্রে সফল হয়েছে। সা¤প্রতিককালে লোকালয়ে চলে আসা বাঘ মারার প্রবণতা হ্রাস পেয়েছে। স্থানীয় জনসাধারণকে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনায় সম্পৃক্ত করার জন্য সুন্দরবনের আশেপাশের উপজেলায় ৪টি কমিটি গঠন করা হয়েছে। জনসাধারণের জীবনমান উন্নয়নের জন্য আয়বর্ধক কর্মকান্ড এবং সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। বন্যপ্রাণী দ্বারা নিহত বা আহত মানুষের ক্ষতিপূরণ নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে এবং এর আলোকে ২০১১ সাল থেকে নিয়মিতভাবে ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে উভয় সুন্দরবনের বাঘ সংরক্ষণ, বাঘ ও শিকারি প্রাণী পাচার বন্ধ, দক্ষতা বৃদ্ধি, মনিটরিং ইত্যাদির জন্য একটি প্রটোকল ও একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করা হয়েছে। বাংলাদেশ-ভারত কর্তৃক স্বাক্ষরিত প্রটোকল ও সমঝোতা স্মারকের আওতায় বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন পর্যায়ের বন কর্মকর্তাদের ভারতের ওয়াইল্ডলাইফ ইনস্টিটিউটে প্রেরণ করা হয়েছে। লোকালয়ে আসা বাঘ চেতনানাশক ওষুধ প্রদান করে অন্যত্র স্থানান্তরকরণ ও সংরক্ষণের উপর বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে এবং উভয় দেশের কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে নিয়মিত বৈঠক ও তথ্যাদি আদানপ্রদান হচ্ছে। বাঘ সংরক্ষণে করণীয় কাজের মধ্যে বাঘ ও হরিণ শিকারি এবং ডাকাতের উপদ্রব বন্ধের জন্য র‌্যাব, পুলিশ, কোস্টগার্ড ও বন বিভাগ সমন্বয়ে সমগ্র সুন্দরবনে নিয়মিতভাবে যৌথ অভিযান পরিচালনা; চিহ্নিত বাঘ ও হরিণ শিকারীদের ধরার জন্য গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি; প্রতিটি এলাকায় বন বিভাগের টহল জোরদার; সুন্দরবনের আশপাশে সব ধরনের ভারী শিল্প ও কলকারখানা নির্মাণ বন্ধ রাখা; সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে নৌযান চলাচল হ্রাস করে বিকল্প পথে নৌযান চলাচলের ব্যবস্থা করা এবং বাঘ-মানুষ দ্ব›দ্ব নিরসন করা উল্লেখযোগ্য।

লেখক: সহকারী কর্মকর্তা, ক্যারিয়ার এন্ড প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস বিভাগ, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রয়েল বেঙ্গল টাইগার
আরও পড়ুন