Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মহান বিপ্লবীর জীবনাবসান

সম্পাদকীয়-১ | প্রকাশের সময় : ২৮ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

কিউবার কমিউনিস্ট বিপ্লবের মহানায়ক, ল্যাটিন আমেরিকা ও তৃতীয় বিশ্বের অবিসংবাদিত নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো আর নেই। কিউবার স্থানীয় সময় শুক্রবার রাত সাড়ে ১০টায় তার জীবনাবসান হয়েছে। বিশ্বের কমিউনিস্ট বিপ্লবের সোনালি অতীতের তিনিই ছিলেন শেষ প্রতীক। তার জীবনাবসানের মধ্য দিয়ে একটি যুগের অবসান ঘটল। গত এপ্রিলে হাভানার কনভেনশন প্যালেসে কিউবার কমিউনিস্ট পার্টির সপ্তম কংগ্রেসে দেয়া ভাষণে ফিদেল ক্যাস্ট্রো বলেছিলেন : ‘শিগগিরই নব্বইতে পড়ব.... অন্য সবার কাতারে মিলে যাবো। একে একে আমাদের সবারই পালা আসে।’ নব্বই পার করেই তিনি না ফেরার দেশে চলে গেছেন। তার মৃত্যু পরিণত বয়সের হলেও কিউবার জনগণের কাছে এর চেয়ে বড় শোকের দিন আর নেই। তারা তাদের এমন এক মহান নেতাকে হারিয়েছে যার তুলনা ছিলেন কেবল তিনিই। তার মতো নেতা কেউ ছিলেন না, ভবিষ্যতেও কেউ হবেন বলে মনে হয় না। বিশ্বের মুক্তিকামী, স্বাধীনতাকামী, শোষণহীন-বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠাকামী মানুষের কাছে তিনি ছিলেন অনিঃশেষ অনুপ্রেরণার আশ্রয়স্থল। তার মৃত্যুতে তারাও শোকে ভারাক্রান্ত। ফিদেল কাস্ট্রো তার দেশ কিউবা এবং ল্যাটিন আমেরিকাসহ গোটা বিশ্বের মানুষের স্বাধীনতা, শান্তি ও সাম্যের জন্য আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। বিপ্লবী সহকর্মীদের নিয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের পুতুল বাতিস্তা সরকারের দুর্গে আঘাত হেনেছিলেন। ১৯৫৯ সালে ওই স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। সেই থেকে তিনিই ছিলেন কিউবায়র ক্ষমতার শীর্ষ ব্যক্তি। নিকট প্রতিবেশী যুক্তরাষ্ট্র ফিদেল ক্যাস্টোর গোটা সময়কালে এই দ্বীপরাষ্ট্র ও তার সরকারের প্রতি ছিল ঘোরতর শত্রুভাবাপন্ন। কিউবার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধসহ এমন কোনো পদক্ষেপ নেই যা যুক্তরাষ্ট্র নেয়নি। শুধু তাই নয়, ফিদেল ক্যাস্ট্রোকে সিআইএ বহুবার হত্যার চেষ্টাও করেছে। এত কিছু সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের নাকের ডগায় অর্ধশতাব্দীকাল তিনি কমিউনিস্ট রাষ্ট্র ও শাসন বহাল রাখেন। দেশপ্রেম, আদর্শের প্রতি নিষ্ঠা এবং জনগণের মঙ্গলে আন্তরিক অঙ্গীকার ছাড়া এরকম সাফল্য অর্জন সম্ভব নয়।
শোষণমুক্ত ও বৈষম্যহীন সমাজ এবং রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনগণের সর্বাধিক সেবা, কল্যাণ, প্রতিষ্ঠা ও বিকাশ নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই ফিদেল ক্যাস্ট্রো বৈপ্লবিক মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছিলেন। শেষ দিন পর্যন্ত তিনি তার বিশ্বাস ও অঙ্গীকারে অটল ছিলেন। বিগত শতকের ৯০-এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও বিভাজনের পর অনেকেই মনে করেছিলেন, কিউবায় কমিউনিস্ট শাসনের অবসান অবশ্যম্ভাবী। কারণ ওই সময় কিউবার অর্থনীতি বড় রকমের বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিল। ফিদেল ক্যাস্ট্রো ছিলেন তার অবস্থানে অটল। চীন যখন খোলা দরজা নীতি অবলম্বন করে, কমিউনিজমের আদর্শ থেকে সরে যায় তখনও মনে করা হয়েছিল, কিউবাও হয়তো দিক পরিবর্তন করবে। ফিদেল ক্যাস্ট্রো সেদিকে যাননি। আদর্শিক নেতা বলতে যা বোঝায় ফিদেল ক্যাস্টো ছিলেন তাই। নেতা অনেক ছিলেন, এখনো নেতার অভাব নেই। তবে আদর্শিক নেতা আগেও সংখ্যায় কম ছিল; এখন তো প্রায় নেই বললেই চলে। রাজনীতি, বিপ্লব যা-ই কিছু বলা হোক না কেন, আদর্শ ছাড়া হয় না। আবার আদর্শিক নেতা ছাড়াও কোনো রাজনৈতিক বিজয় বা বিপ্লব হয় না। কিউবায় বিপ্লব সংঘটিত করে, বিপ্লবী রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করে, দীর্ঘদিন শাসন পরিচালনা করে ফিদেল ক্যাস্ট্রো যে নজির স্থাপন করে গেছেন, তা থেকে বিশ্ববাসীর বিশেষ করে পরিবর্তনকামী, বিপ্লবÑ প্রত্যাশী রাজনৈতিক নেতাদের অনেক কিছু শেখার আছে।
ফিদেল ক্যাস্ট্রো শুধু বিপ্লবী নেতা ছিলেন না, একই সঙ্গে ছিলেন দৃঢ়চেতা ও আত্মবিশ্বাসী একজন মানুষ। তিনিই সঠিক, এ ব্যাপারে সবসময় তিনি ছিলেন দ্বিধাহীন। বিরুদ্ধ মতের প্রতি তার ছিল প্রবল অসহিষ্ণুতা। আদর্শের ব্যাপারে তিনি ছিলেন আপোষহীন। তার মধ্যে আন্তর্জাতিকতাবোধও ছিল প্রখর। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার পরিচিতি ও প্রভাব ছিল কিংবদন্তিতুল্য। দুইশ’ বছর আগের ল্যাটিন আমেরিকার স্বাধীনতাকামী নেতা ফ্রান্সিসকো মিরান্দা ও সিমোন বলিভারের পর তিনিই ছিলেন সর্বজনমান্য নেতা। ৬০-এর দশকে ল্যাটিন আমেরিকায় তার বিপুল সংখ্যক অনুসারী বা ভাবশিষ্য তৈরি হয়। তারা গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে তাদের দেশের ক্ষমতা দখল করে। ৭০-এর দশকে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে বর্ণবাদবিরোধী সংগ্রামীদের সমর্থনে তিনি সৈন্য প্রেরণ করেন। ৮০-এর দশকে মধ্য আমেরিকার বিপ্লবীদের জন্য অস্ত্র সরবরাহ করেন। তিনি তৃতীয় বিশ্বের স্বার্থ এবং কল্যাণেও ছিলেন সদা সোচ্চার ও তৎপর। বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতি তার ছিল উচ্চ ধারণা। স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। এর স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৩ সালে তাকে ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ প্রদান করা হয়। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার ছিল গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। তিনি বঙ্গবন্ধুকে হিমালয়ের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। বলেছিলেন: ‘আমি হিমালয় দেখিনি, তবে আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি।’ তার জীবনাবসানে বাংলাদেশ তার একজন বিশ্বস্ত বন্ধু ও সুহৃদয়কে হারাল। আসলে সত্যিকারে বিপ্লবীর মৃত্যু হয় না। ফিদেল ক্যাস্ট্রোরও মৃত্যু নেই। তিনি বহু দিন বহু যুগ মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন, আদর্শিক বিপ্লবের অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবেন। আমরা তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করছি। তার পরিবার-পরিজন ও দেশবাসীর প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জ্ঞাপন করছি।








 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন