চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
তোমাদের কী হলো? আল্লাহর রাহে লড়াই করছ না! অথচ অসহায় পুরুষ-নারী ও শিশু ফরিয়াদ করছে, হে রব! এ জালিম জনপদ থেকে আমাদেরকে বের করে নাও, আমাদেরকে ওলী (অভিভাবক) দাও, দাও হে খোদা সাহায্যকারী। [সূরা নিসা-আয়াত নং-৭৫]
এ মুসলমান তো সেই জাতি যারা অন্যায় করে না, অন্যায় সহে না, অন্যায়কারী জালিমের বিরুদ্ধে প্রাণান্তকর সংগ্রাম করে। মুসলমান তো সেই জাতি যারা পারস্য উপসাগরের পানির ওপর দিয়ে ৩০ হাজার ঘোড়া চালিয়ে মজলুমের ফরিয়াদে সাড়া দিয়েছে। শক্তিধর পরাশক্তি ইরানের অগ্নি উপাসকদের রাজপ্রাসাদে কালেমার ঝা-া উড়িয়েছে। মুসলমান তো সেই জাতি যারা আফ্রিকার গহিন জঙ্গলে গিয়ে ঘোষণা দিয়েছে হে জঙ্গলের বাঘ-সিংহ-হিং¯্র প্রাণী, আমরা যে সীমানা দিয়েছি এ এলাকা থেকে মাগরিবের পূর্বেই বের হয়ে যাও। আমরা প্রিয় নবীর সাহাবা, এ জঙ্গলে আমরা রাত কাটাব। দেখা গেল মাগরিবের পূর্বেই সিংহ-বাঘ-ভাল্লুক তো বের হয়ে গেছে এমনকি পিপীলিকা-পোকা-মাকড় পর্যন্ত বের হয়ে মুসলিম সৈনিকের জন্য জায়গা করে দিয়েছে। মুসলিম তো সেই জাতি যারা সাগর পাড়ি দিয়ে স্পেনে উঠে নৌকাগুলো জ্বালিয়ে দিয়ে মজলুমানের ফরিয়াদ শুনেছে। উড়িয়েছে কালিমার জয় নিশান। এই মুসলমানরাই তো বিশাল আনা সাগরের পানি এক লোটায় ভরেছে। তারাই তো কুমিরের পিঠে, মাছের পিঠে সওয়ার হয়ে, মুসল্লা বিছিয়ে সুরমা নদী পার হয়ে কালেমার বিজয় কেতন উড়িয়েছে। এই মুসলমানরাই তো শান্তির বাণী প্রচার করতে গিয়ে অমুসলিমদের অত্যাচারে শাহাদাতের শরবত পান করেছে।
এ মুসলিম জাতি সারা দুনিয়ায় প্রমাণ করেছে ইসলাম মানে শান্তি, জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাস নয়। প্রমাণ করেছে একই লোকালয়ে মুসলিম-অমুসলিম সবাই নিজ নিজ অধিকার নিয়ে বাস করতে পারে। মুনষ্যত্বের বিকাশ সাধন করেই সুলতান গাজী সালাহউদ্দিন আইউবী রহ. ডাক্তার সেজে খ্রিস্টান সেনাপতির সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছে। এ মুসলিম জাতিই তো জ্ঞান-বিজ্ঞান-আবিষ্কারে সমগ্র বিশ্বের নেতৃত্ব দিয়েছে। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা করেছেন “মুমিন যেন একটি দেহ, যদি কোথাও আঘাত লাগে গোটা দেহ আহত হয়।” সাম্য-মৈত্রীর বন্ধন হারে মুসলিম জাতি ঐক্যবদ্ধ। ভ্রাতৃত্ববোধের নজির সৃষ্টি করে ইতিহাসের সোনালি পাতায় নাম লিখিয়েছে। এরা তো সেই জাতি, যারা ইয়ারমুকের ময়দানে আহত ভাই পানি দাও পানি দাও বলে কাতরাচ্ছে। পানি নিয়ে তার কাছে গেলে সে বলেছে, ভাই আমাকে পরে দাও, আরেক ভাই আরো বেশি কষ্ট পাচ্ছে। পানি নিয়ে দ্বিতীয় জনের কাছে যাওয়ার পর তিনি বললেন, ভাই পাশেই আরেকজন আরো বেশী তৃষ্ণার্ত তাকে দাও, আমাকে পরে দিও। পানি নিয়ে তৃতীয় জনের কাছে যাওয়ার পর তিনি বললেন, ভাই আরেক ভাই কাতরাচ্ছে তাকে আগে দাও। পানি নিয়ে চতুর্থ জনের কাছে গিয়ে দেখতে পেলেন তিনি শহীদ হয়ে গেছেন। ফিরে এলেন তৃতীয় জনের কাছে, গিয়ে দেখলেন তিনিও শহীদ হয়ে গেছেন। ফিরে এলেন দ্বিতীয় জনের কাছে, দেখলেন তিনিও শহীদ হয়ে গেছেন, আবার দৌড়িয়ে প্রথম জনের কাছে এসে দেখলেন তিনিও শাহাদাতের শরবত পান করেছেন। এ কী দৃশ্য! পানি নিয়ে ওই সাহাবা আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ছেড়ে কাঁদলেন, আর বললেন, মাওলা আমার কি হলো? আমি কেন শহীদ হলাম না। চৌদ্দ তালির জামা নিয়ে খালেদ বিন ওলীদ রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু রোমান স¤্রাটের রাজপ্রাসাদের গেটে গিয়ে দেখলেন রাজপ্রাসাদে ঢুকতে সাতটি গেটেই মাথানত করতে হবে। দেড় লাখ সশস্ত্র সৈন্যের সামনে হুংকার দিয়ে বললেন, মুসলিম জাতি আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে মাথানত করে না, গেট ভাঙ্গো, খালেদ মাথা উঁচু করে ঢুকবে। খ্রিস্টান সেনাপতি স¤্রাটের কাছে গিয়ে বিষয়টি জানালে স¤্রাটের কোনো প্রতিবাদের ভাষা ছিল না। নির্দেশ দিলেন সব গেট ভাঙ্গো। সেনাপতি বললেন, খালেদ একা আর আমরা দেড় লাখ। স¤্রাট বললেন, তুমি মুসলিম জাতিকে চিন না। এক খালেদকে তুমি মারতে পারবে কিন্তু লাখো খালেদ তোমার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাবে। খালেদ স¤্রাটের কাছে গিয়েই বললেন, স¤্রাট দ্রুত সন্ধি চুক্তি করতে হবে। বাইরে আমার ভাইয়েরা অপেক্ষা করছে জামাতে আসরের নামাজ আদায় করতে হবে। স¤্রাটের চার পাশে তরবারিতে বিষ মেখে ষোলজন সাহসী প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত জল্লাদ দাঁড়িয়ে আছে। স¤্রাট বললেন, যদি আমি চুক্তি না করি তাহলে তুমি কী করবে? শোনামাত্রই খালেদ রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তরবারি বের করে আল্লাহু আকবর ধ্বনি দিয়ে গর্জে উঠে বললেন, এই তরবারি দিয়ে জাহান্নামে পাঠিয়ে দেব। খালিদের এক গর্জনে জল্লাদরা পালিয়ে গেল। স¤্রাট কাঁপতে কাঁপতে চেয়ারের নিচে লুকালো। খালেদ গর্জে উঠে বলল এক আঘাতে শেষ করে দিতে পারি কিন্তু ইসলাম অসহায়দের এভাবে আঘাত করতে বলেনি। ওঠো চুক্তিতে সই কর। স¤্রাট চুক্তিতে সই করলেন।
খালিদ দৌড়ে এসে জামাতে সালাতুল আসর পড়লেন। আর আজকে মুসলমানের রক্তে দুনিয়া লালে লাল হচ্ছে। টেলিভিশন-ফেসবুক-টুইটার-পেপার-পত্রিকাসহ বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে দেখাচ্ছে মিয়ানমারের মুসলিমদের মাথাবিহীন লাশ, শত শত মুসলমানের লাশ পানিতে ভাসছে, আগুন দিয়ে মুসলমানদের জীবন্ত পুড়িয়ে দিচ্ছে। তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে ছাই করছে। রাতের বেলায় হাজার হাজার মুসলিম মা-বোনদের ওপর হায়েনার দল ঝাঁপিয়ে পড়ছে। অত্যাচার করে হত্যা করছে। পালাবার কোনো জায়গা নেই। মায়ের কোল থেকে শিশুকে নিয়ে মাথা কেটে সেই মাথা ফুটবলের মতো মায়ের দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছে। পুরুষ-নারী-শিশুর করুণ ফরিয়াদ, হাহাকার, কান্নার আওয়াজে আকাশ-বাতাস ভারী হচ্ছে। মা-বাবার সামনে নিজ মেয়ের ওপর অত্যাচার চলছে, রামদা, গরুর হাড্ডি কাটার সেই ধারালো অস্ত্র দিয়ে বাবার সামনে ছেলের মাথা কাটা হচ্ছে। উলঙ্গ করে লাথি-কিল-ঘুষি ও বেত দিয়ে আঘাত করছে। রাস্তার ম্যানহোলে জীবন্ত কবর দিচ্ছে। এ করুণ দৃশ্য দেখে আজকের রাজা-বাদশাহদের শরীরের একটি লোমও শিহরে ওঠে না, কোথায় আজকে মানবাধিকারের ধ্বব্জাধারী দেশ ও বুদ্ধিজীবীরা? কোথায় জাতিসংঘ? কোথায় ওআইসি? কোথায় মসজিদের ইমাম, রাজনৈতিক নেতৃত্ব? শান্তির নামে বড় বড় বুলি আউড়িয়ে যারা সমস্ত অশান্তির ধারক-বাহক তারা কোথায়? সারা বিশ্বের মুসলিম শাসকরা যদি জনগণকে নিয়ে মিয়ানমারের কথিত শান্তিতে নোবেল পাওয়া পাষ--নিষ্ঠুর কসাইয়ের বিরুদ্ধে এক বালতি পানি ঢালে এই জালিম মুহূর্তে ডুবে যাবে। সব সম্পর্ক ছিন্ন করে এ অন্যায়-জুলুম ও নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম ঘোষণা করলে এ জালিম শায়েস্তা হতে পারে। এ জন্য প্রয়োজন দলমত ভুলে গিয়ে সকল ইজমকে পদদলিত করে মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ, সম্মিলিত প্রয়াস। ঘোষণা দেয়া- একজন মুসলমানকেও আর নির্যাতন করা যাবে না। তা হলে জালিমের বিরুদ্ধে আমরা রুখে দাঁড়াব। প্রয়োজন মুসলিম বিশ্বে অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্তঃবাহিনী গঠন করা, প্রয়োজন ওআইসির মাধ্যমে মজলুমানের পাশে দাঁড়ানো। তাই আসুন, আর কিছু করতে না পারি একযোগে এ জালিমের বিরুদ্ধে থু থু ফেলি। একসাথে আওয়াজ তুলিÑ এক সাথে একই কণ্ঠে মসজিদ-মাদরাসা-খানকায় এই জুলুমের বিরুদ্ধে সোচ্চার হই। আর দোয়া করি হে আল্লাহ! নির্যাতিত মুসলমানদের ওপর রহম কর! তুমিই তো সকল ক্ষমতার মালিক, হে আল্লাহ! মিয়ানমারে আর কত রক্ত ঝরবে? ফিলিস্তিন, ইরাক, সিরিয়া, ইয়ামেনের মজলুম মুসলমানের আর কত রক্ত দিতে হবে? মা’বুদ মুসলিম জাতির হারানো চেতনা ফিরিয়ে দাও, সরকার ও জনগণকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে এই জুলুমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর শক্তি দাও। আরেকজন সালাহউদ্দীন আইউবি তৈরি করে দাও, দাও সে ওমর, দাও সে খালিদ, দাও শাহজালাল, খানজাহান, মাহি সওয়ার যাদের নেতৃত্বে ধ্বংস হবে সব জালিম। দুনিয়ায় আবার প্রতিষ্ঠিত হবে শান্তি। সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষ পাবে তাদের ন্যায্য অধিকার। হে আল্লাহ! দাও সে ঈমান, দাও সে আমল। দাও সে নেতৃত্ব যারা ঈমান-ইসলাম ও ইহসানের জ্ঞান ও আমলে মুসলিম জাতির আস্থাভাজন হবেন। যারা হবেন ওলী, যারা হবেন নাছির। আমিন!
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।