Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু এবং বাঙালির সংগ্রাম

আমির হোসেন আমু এমপি | প্রকাশের সময় : ২৪ জুন, ২০২২, ১২:০৯ এএম

[পূর্ব প্রকাশিতের পর]
১৯৬২ সালের ৬ জুন শেখ মুজিব জেল থেকে মুক্তি পান। বলেন আইয়ুবের এই সংবিধান গ্রহণযোগ্য নয়। ১৯৬২ সালের ২৪ জুন ৯ জন বিরোধীদলের নেতা এক যুুক্ত বিবৃতি দান করেন। আইয়ুব খান বিরোধী ঐ বিবৃতিটি ছাপা হলে চারদিকে হৈচৈ পড়ে যায়। বিবৃতিতে যারা স্বাক্ষর করেন তারা হলেন: নুরুল আমিন, আতাউর রহমান খান, হামিদুল হক চৌধুরী, আবু হোসেন সরকার, শেখ মুজিবুর রহমান, ইউসুফ আলী চৌধুরী, মাহমুদ আলী, সৈয়দ আজিজুল হক ও মাওলানা পীর মোহসীন উদ্দিন আহমদ। ১৯৬২ সালের ৮ জুলাই পল্টনে ৯ নেতা সামরিক আইন ও আইউবের মৌলিক গণতন্ত্র সম্পর্কে প্রকাশ্যে সমালোচনা করেন। ১৯৬২ সালের ১৪ জুলাই আইউব দলবিধি গঠন করে, দল পুনরুজ্জীবনের জন্য সরকারের কাছে বিভিন্ন বিবরণ দিয়ে অনুমতি নেয়ার প্রচলন শুরু করে। ১৯৬২ সালের ১৯ আগস্ট হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে মুক্তি দেয়া হয়।

তখন সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে এন.ডি.এফ গঠিত হয়। পাকিস্তানের উভয় অংশের নেতৃবৃন্দকে নিয়ে সমগ্র পাকিস্তানে জনসভার মাধ্যমে গনতান্ত্রিক শাসনতন্ত্রের আন্দোলন গড়ে তোলেন সোহরাওয়ার্দী। জেল থেকে বের হবার পর পর তার অপরিসিম পরিশ্রমে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। বিদেশে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় ১৯৬৩ সালের ৫ ডিসেম্বর বৈরুতের এক হোটেলে তিনি ইন্তেকাল করেন।

১৯৬৪ সালের ২৫ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু তার ৩২ নম্বর ধানমন্ডীর বাসায়, আওয়ামী লীগের এক বিশেষ সম্মেলন ডাকেন। এতে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য, সকল জেলা এবং মহকুমা শাখার সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকগণ উপস্থিত হন। এখানেই সংখ্যাগরিষ্ঠদের সিদ্ধান্তে আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবের উদ্যোগ নেয়া হয়। ১৯৬৪ সালের ১ মার্চ আওয়ামী লীগ ঘোষণা দিয়ে পুনরুজ্জীবন ঘটায়। এতে এনডিএফের নেতাগণ বঙ্গবন্ধুর উপর প্রচন্ডভাবে ক্ষেপে যান। উল্লেখ্য, একমাত্র আওয়ামী লীগেরই নিবেদিত এবং সংগঠিত কর্মীবাহিনী ছিল। আওয়ামী লীগের একদল নেতা এনডিএফের বাইরে দলের আত্মপ্রকাশের বিরুদ্ধে বিবৃতি দেন।

১৯৬৪ সালের ৫ জুন আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভা বসে। সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান ঐ সভায় ১১ দফা পেশ করেন। ১১ দফা নিয়ে সভায় বেশ হৈচৈ শুরু হয়। কেউ কেউ এটাকে দুঃসাহসিক বলে অভিহিত করেন। সম্পূর্ণটাই ছিল স্বায়ত্তশাসনের বিষয়। এতে ফেডারেল ভিত্তিক রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে পূর্ব পকিস্তানের মুদ্রা ব্যবস্থা, মুদ্রার আয়-ব্যয় হিসাব পৃথককরণ, পৃথক বৈদেশিক বাণিজ্য নীতি প্রণয়ন, নৌবাহিনীর সদর দপ্তর পূর্বাঞ্চলে স্থাপন ইত্যাদি ঐ ১১ দফায় ছিল। অনেক আলোচনার পর ১১ দফা গৃহীত হলেও প্রচার এবং দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলার ব্যাপারে কিছুটা অনীহা প্রকাশ পায়। বলা হয়, এতে আওয়ালী লীগের উপর চরম দমননীতি শুরু হবে।

১৯৬৪ সালের ১৩ জুলাই আওয়ামী লীগ দল পুনর্গঠনের পর প্রকাশ্য জনসভা করে পল্টনে। সভার সভাপতি ছিলেন মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগিশ, শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যান্যরা বক্তব্য রাখেন। রাজবন্দিদের মুক্তি, শিক্ষাঙ্গনে সরকারি সন্ত্রস বন্ধ, যুক্ত নির্বাচন, গণতান্ত্রিক অধিকার প্রভৃতি দাবি ছাড়াও জোর দেয়া হয় পূর্ব পকিস্তানের স্বায়ত্বশাসনের উপর। ১৯৬৪ সালের ১৪ জুলাই পুলিশ নগর আওয়ামী লীগ অফিসে হামলা চালায়। কমপক্ষে উপস্থিত ৮ জনকে গ্রেফতার করে এবং দলিলপত্র সিজ করে।

১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর পাক-ভারত যুদ্ধ লেগে যায়। ১৭ দিন যুদ্ধের পর জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে যুদ্ধ থামে। যুদ্ধে পাকিস্তানের যথেষ্ট ক্ষতি হয়। পশ্চিম পাকিস্তানেই যুদ্ধ চলেছে। আইয়ুব খানের ধারণা হয়েছিল, যুদ্ধের ফলে পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলের ঐক্য বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ যুদ্ধের সময় পূর্ব পকিস্তানের অসহায় অবস্থার কথা তুলে ধরে। আক্রামণ প্রতিরোধ করার মতো কোনো ব্যবস্থাই পূর্ব পকিস্তানে ছিল না। ১৯৬৫ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের বিশেষ অধিবেশনে পূর্ব পাকিস্তানের ঐ অসহায় অবস্থার বিশ্লেষণ হয় এবং এইসঙ্গে বলা হয় যে, ঐ যুদ্ধের সিংহভাগ ব্যয়ভার পূর্ব পকিস্তানকেই বহন করতে হবে। ১৯৬৬ সালের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের তাসখন্দে আইয়বু খান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মধ্যে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। আইয়ুব খানের মন্ত্রী জুলফিকার আলী ভূট্টো চুক্তির বিরোধিতা করেছিলেন। এনডিএফের নুরুল আমিনও চুক্তির বিরোধিতা করেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিব এক বিবৃতিতে উল্লেখ করেন, আমরা তাসখন্দ চুক্তির বিষয়ে মোটেও উৎসাহিত নই, আমরা চাই পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্বশাসন। ১৯৬৬ সালের ১৬ জানুয়ারি ৩২ নম্বর ধানমন্ডীর বাসায় শেখ সাহেবের বসভবনে ওয়ার্কিং কমিটির সভার পর ঐ বিবৃতি দেয়া হয়। অন্যদিকে আইয়ুব খানের পক্ষে এনডিএফের নেতা আতাউর রহমান পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করেন তাসখন্দ চুক্তির বিষয়ে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ১৯৬৬ সালের ১৮ জানুয়ারি যুদ্ধকালীন জরুরি অবস্থা তুলে নেবার জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানানো হয়। তাৎক্ষণিকভাবে আইয়ুব খানের মন্ত্রী খান আবদুস সবুর এক বিবৃতিতে জরুরি অবস্থা তুলে নেবার দাবীর নিন্দা জানান। ১৯৬৬ সালের ২১ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান পাল্টা বিবৃতিতে বলেন, জরুরি অবস্থা তুলে নেয়াটা অসুবিধা হলে নিশ্চয়ই তাসখন্দ চুক্তিটা অর্থহীন।

১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি নেজামে ইসলাম প্রধান লাহোরের চৌধুরী মোহাম্মাদ আলীর বাসভবনে পাকিস্তানের সবগুলো বিরোধীদলের সভা বসে। কিন্তু তার আগে ৫ ফেব্রুয়ারি সরকার ঐ বৈঠকের সকল খবর প্রকাশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করার জন্য নির্দেশ জারি করেন। বৈঠকেই বঙ্গবন্ধু ৬ দফা দাবি পেশ করেন। কিন্তু বিরোধী দলগুলো কোনো অঞ্চলের স্বায়ত্বশাসন নিয়ে কথা না তোলার জন্য আহবান জানায়। আওয়ামী লীগ বৈঠক বর্জন করে। ঐ দিনেই তিনি লাহোরে সাংবাদিক সম্মেলন করে ৬ দফা ঘোষণা করেন। ১৯৬৬ সালের ৭ মার্চ পাকিস্তানের সকল পত্রপত্রিকায় ৬ দফার খবর ছাপা হয়। ১৯৬৬ সালের ১১ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিমান বন্দরে সাংবাদিক সম্মেলনে ৬ দফার ব্যাখ্যা প্রদান করেন। তিনি এটাকে বাঙালির বাঁচার দাবি বলে আখ্যায়িত করেন সেদিনই। কিন্তু অবাক ব্যাপার ছিল এটাই, তরুণ সমাজ তার প্রত্যাবর্তনের আগেই বরিশাল, ঢাকা, কুমিল্লা, নোয়াখালী, সিলেট, চট্টগ্রামসহ সর্বত্র পোস্টার এবং দেয়াল লিখনে ছেয়ে ফেলেছে ৬ দফার কথা। ৬ দফার প্রথম প্রচার পুস্তিকাটি প্রকাশিত হয় প্রচার সম্পাদক আবুদল মোমিন কর্তৃক, যা গ্লোব প্রিন্টার্স থেকে মুদ্রিত। পুস্তিকাটি সম্ভবত প্রথম প্রচার করা হয় ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারে। তখনই বোঝা যাচ্ছিল, ৬ দফার ঝুঁকি এড়ানোর জন্য কেউ কেউ দল থেকে সরে যাবার উদ্যোগ নিচ্ছে। ১৯৬৬ সালের ১৩ মার্চ আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটিতে ৬ দফা অনুমোদন করা হয়।

১৯৬৬ সালের ১৮ মার্চ মতিঝিলের হোটেল ইডেনে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন শুরু হয়। সভাপতি মাওলানা তর্কবাগীশ অনুপস্থিত থাকেন। ঐ কাউন্সিলেও ৬ দফা বিপুল সমর্থনে অনুমোদিত হয়। করাচী আওয়ামী লীগের সভাপতি মিয়া মঞ্জুরুল হক তার ভাষণে সর্বাত্মক সমর্থনের কথা ঘোষণা করেন। ১৯ মার্চ কাউন্সিল অধিবেশনে ওয়ার্কিং কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ঐ দিনেই সন্ধ্যা নাগাদ কমিটিও অনুমোদন করেন কাউন্সিলররা। সর্বসম্মিতিক্রমে সভাপতি নির্বাচিত হন শেখ মুজিবুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদ।[চলবে]

লেখক: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, কেন্দ্রীয় ১৪ দলের সমন্বয়ক ও মুখপাত্র



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: আওয়ামী লীগ


আরও
আরও পড়ুন