Inqilab Logo

মঙ্গলবার ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

তথ্য-উপাত্তের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা

মোহাম্মদ ওমর ফারুক দেওয়ান | প্রকাশের সময় : ৯ জুন, ২০২২, ১২:০২ এএম

কোনো কিছু সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে সে সম্পর্কিত বিভিন্ন উপাত্তকে যৌক্তিক পরিসজ্জায় উপস্থাপনকেই তথ্য বলে। বিভিন্ন উপাত্তকে ‘ডাটা’ বলা হয়, তা প্রক্রিয়াজাতকরণ, পরিচালন এবং একত্রিতকরণের মাধ্যমে প্রাপ্ত ফলাফলকে তথ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। উপাত্ত বা ডাটা হলো তথ্যের ক্ষুদ্রতম একক, যা এলোমেলো বা অগোছালো কয়েকটি অক্ষর, সংখ্যা, চিহ্ন বা যে কোনো কিছু হতে পারে। এগুলো যথাযথভাবে উপস্থাপন করলে একটি অর্থ প্রকাশ করে, যা থেকে কোনো কিছু সম্পর্কে জ্ঞান বা ধারণা লাভ করা যায়।

তথ্য মানব সভ্যতার উন্নয়নের পরতে পরতে মিশে আছে। সঠিক তথ্য ব্যতীত কোনো পরিকল্পনাই সফল হয় না। ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি, শিক্ষা-চিকিৎসা, উৎপাদন-বিপণন, অর্থনীতি-সমরনীতি প্রতিটি ক্ষেত্রেই তথ্যের প্রয়োজন। তথ্য ব্যতীত মানব জীবন এক প্রকার অচল। তাই বলা হয় ‘তথ্যই শক্তি’। আর সেই তথ্যের প্রবাহ অবারিত না হলে কোনো পরিকল্পনাই গ্রহণ করা সম্ভব হয় না। তাই বিশ্বব্যাপী আওয়াজ উঠেছে তথ্য প্রকাশ করতে হবে, তথ্য আদানপ্রদানের মাধ্যমে পরস্পরকে সহযোগিতা করতে হবে।

তথ্যের অবাধ প্রবাহ এবং জনগণের তথ্য অধিকার নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে তথ্য অধিকার আইন করা হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানে চিন্তা, বিবেক ও বাক-স্বাধীনতা নাগরিকের অন্যতম মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত এবং তথ্য প্রাপ্তির অধিকার চিন্তা, বিবেক ও বাক-স্বাধীনতার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণের ক্ষমতায়নে তথ্য অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের জন্য অত্যাবশ্যকীয়। জনগণের অধিকার নিশ্চিত করা হলেই সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও সংবিধিবদ্ধ সংস্থা এবং সরকারি ও বিদেশি অর্থায়নে সৃষ্ট বা পরিচালিত বেসরকারি সংস্থার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বৃদ্ধি পাবে, দুর্নীতি হ্রাস পাবে ও সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে।

তথ্য অধিকার আইনে বর্ণিত কর্তৃপক্ষের নিকট হতে প্রত্যেক নাগরিকের তথ্য লাভের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে এবং ‘তথ্য সরবরাহ করতে বাধ্য’ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, তথ্য প্রদানের জন্য তথ্যের ক্যাটালগ ও ইনডেক্স তৈরি করে রাখতে বলা হয়েছে, ওয়েবসাইটে প্রদর্শনের কথা বলা হয়েছে। মানুষের জন্য সহজলভ্য করে রাখতে বলা হয়েছে। স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, কোনো কর্তৃপক্ষ কোনো তথ্য গোপন বা সংকোচিত করে রাখতে পারবে না।

রাষ্ট তথ্য লাভের অধিকার নিশ্চিত করলেও নাগরিক কতটুকু তথ্য সংগ্রহ করে জীবনমান উন্নয়ন করতে পেরেছে, সেটা বিবেচ্য বিষয়। ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠিত হওয়ায় সরকারের কম-বেশি সকল তথ্যই এখন ওয়েবসাইটে পাওয়া যাচ্ছে। আপনি যে পেশাতেই থাকেন না কেন, পেশার উৎকর্ষ সাধনের জন্য তথ্য জানা আপনার দরকার। ধরুন, আপনি গ্রামের কৃষক, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করাচ্ছেন। ভালো কৃষিপণ্য, কৃষিবীজ কোথায় পাওয়া যায়; সার-বীজ-মাটির গুণাগুণ দেখে ফসল উৎপাদন; কোনো মার্কেটে আপনার উৎপাদিত ফসলের দাম কত, সরকার আপনাকে কী কী সুবিধা দিচ্ছে, আপনার পণ্যটি বিদেশে রপ্তানি করা যায় কি-না, চাষবাস, সংরক্ষণ পদ্ধতি; ইত্যাদি সকল বিষয়ই ওয়েবসাইটে পাবেন। কৃষক হিসেবে আবহাওয়ার আগাম বার্তা জানা অত্যাবশ্যক। আপনি মোবাইল থেকে ১০৯০ নম্বরে কল করে আগাম বার্তা জেনে নিতে পারেন। ছেলেমেয়েদের স্কুল-কলেজে ভর্তি, চাকরির আবেদন, কোথায় কোন চাকরির সুযোগ আছে ইত্যাদিও নেটে অবারিত আছে। ছেলেমেয়েরা চোখ-কান একটু খোলা রাখলে তারা দেশবিদেশেও লেখাপড়া, চাকরির সুযোগ করে নিতে পারে। আপনি যে পেশার মানুষই হোন, আপনার জানার বিষয়টি গুগলে লিখে সার্চ করুন। দেখবেন, শতশত তথ্য আপনার সামনে এসে ধরা দিয়েছে। তবে, সমস্যা হলো প্রচুর তথ্য হাতের নাগালে থাকলেও আমরা সেটার সন্ধান না করে অনেক সময় বিভ্রান্ত হই। এমনিভাবে একজন ব্যবসায়ীর জন্য তথ্য জানা অত্যাবশ্যক। পণ্যের আমদানি-রপ্তানি, দামের উঠা-নামা, দেশ-বিদেশে পণ্যের চাহিদা, আন্তর্জাতিক দরপরিস্থিতি, সরবরাহ, বিপণন ব্যবস্থা ইত্যাদির তথ্য ভালোভাবে জানলেই আপনি ভালো ব্যবসায়ী হতে পারবেন।

একটা বিষয় আমাদের জানা দরকার, সরকারের সকল মন্ত্রণালয়, বিভাগের ওয়েবসাইটে নাগরিকের প্রয়োজনীয় সকল তথ্যই দেওয়া আছে। সরকার তথ্য বাতায়ন করেছে। এতে পুরো দেশের সকল অফিসের ঠিকানা, কর্মকর্তাদের তালিকা, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম, কীভাবে তথ্য প্রদান করা হয় ইত্যাদি বিস্তারিত উল্লেখ আছে। আমাদের কাজ সে তথ্য সংগ্রহ করে নিজের উন্নয়ন সাধন করা। ডিজিটাল বাংলাদেশের কারণে বিশ্বের সকল তথ্যই এখন হাতের মুঠোয়। আপনার হাতে একটা এনড্রয়েড মোবাইলও আছে, কিন্তু আপনি ব্যবহার করছেন না। সরকার অনেকগুলো মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এসব প্রকল্পের তথ্য ওয়েবসাইটে রয়েছে। এখান থেকে কী কী সুবিধা পাওয়া যাবে তার আলোকে আমরা আগামী দিনের পরিকল্পনা করতে পারি।

আমরা এখন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে বাস করছি। এখানে তথ্য একটা প্রধান চালিকা শক্তি হিসেবে আভির্ভূত হয়েছে। প্রযুক্তির এখন রমরমা প্রসার। আপনি যে কাজই করুন না কেন, সেখানে প্রযুক্তির ব্যবহার আপনার কাজকে সহজ করে দেবে, উৎপাদন বা আউটপুট একাধিক গুণ বাড়িয়ে দেবে। কিন্তু প্রযুক্তির তথ্য জানা না থাকলে আপনার উৎপাদন বা আউটপুটের ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে। ফলে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকতে পারবেন না। খামার বা ফেক্টরি পাহারা দিতে এখন দারোয়ান না রাখলেও চলে। স্বল্প খরচে নিরবচ্ছিন্ন সার্ভিস পেতে এখন সবাই সিসি ক্যামেরা ব্যবহার করে। লোক দিয়ে মাটি কাটার দিন ফুরিয়ে আসছে। এখন সবাই স্কেবেটর দিয়ে মাটি কাটে, চাষবাস করে, পণ্য পরিবহন করে। কৃষি, আসবাবপত্র, গার্মেন্টস ও হোটেল খাতে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রভাব নিয়ে একটা সমীক্ষা হয়েছে। ফলাফলে দেখা গেছে, এসব ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার খুব দ্রæত বিস্তার লাভ করবে। ফলে এসব প্রযুক্তির সাথে তাল মেলাতে না পারা বা প্রশিক্ষণবিহীন মানুষগুলো খুব দ্রæতই চাকরি হারাবে। তাই আপনাকে এসব প্রযুক্তির তথ্য দ্রæতই জানতে হবে এবং তা রপ্ত করতে হবে। নির্মাণ শিল্পেও প্রযুক্তির ব্যবহার রাতারাতি বাড়ছে। মোবাইলের ইউটিউব খুললেই নির্মাণ শিল্পের শতশত প্রযুক্তির দেখা মেলে, যেখানে অল্প সময়ে কত কঠিন কাজগুলো টেকসই ও নিপূণভাবে করা হচ্ছে, যা আগে খুবই শ্রমঘন শিল্প ছিল। এসব প্রযুক্তির সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে না পারলে টিকে থাকা কঠিন হবে। চিকিৎসা ক্ষেত্রে প্রযুক্তি যে হারে বাড়ছে, তাতে আগামীতে ডাক্তারের প্রয়োজনীয়তা কমে যাবে। বিমান কখন এসে পৌঁছাবে বা কখন ছাড়বে এর জন্য এয়ারপোর্টে গিয়ে বসে থাকার দিন গত হয়েছে। এখন মোবাইলের মাধ্যমেই জানা যায় বিমানটা ঠিক কোন দেশের আকাশে উড়ছে, কখন এসে পৌঁছাবে। ঘরে বসেই বিমানের বোর্ডিং নিশ্চিত করা যায়। কিন্তু আমরা যদি সে প্রযুক্তি সম্পকে খবর না রাখি বা প্রযুক্তির ব্যবহার না শিখি তাহলে পিছিয়ে পড়বো। তাই আগামী দিনগুলোতে তথ্য-প্রযুক্তির শিক্ষায় শিক্ষিত জনশক্তির কদর বাড়বে অপ্রত্যাশিতভাবে।

আইনের ফলে সরকারি, বেসরকারি সকল অফিস-সংস্থা এখন নাগরিককে তথ্য দিতে বাধ্য। ফলে অফিস-সংস্থা এখন আর কর্মপরিকল্পনা, বাজেট, নাগরিক সুযোগ-সুবিধার বিষয়গুলো লুকিয়ে রাখতে পারছে না। এতে প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বৃদ্ধি পেয়েছে, অনিয়ম-দুর্নীতি অনেক কমে এসেছে। কোন অফিস কী কাজ করছে তা মানুষ সহজেই জানতে পারছে। হাতে একটু সময় নিয়ে প্রতিটি অফিসের ওয়েবসাইটে ঢুকলে দেখা যাবে, প্রচুর তথ্য দেওয়া আছে।

হাতের মোবাইলেই পুরো বিশ্বের তথ্য মজুদ আছে। সেগুলো বের করে নিজের প্রয়োজন মতো ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। তথ্য জানার পরিধি বাড়াতে হবে। তবে তথ্য জানায় একটু সতর্কতাও থাকা লাগবে। কারণ, কিছু দুষ্টলোক কিছু বিভ্রান্তিমূলক তথ্যও নেটে ছড়িয়ে রেখেছে। বিভিন্ন ধরনের গুজব ও অপপ্রচারে লিপ্ত আছে তারা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমে উস্কানি দিচ্ছে এরা। আপনি একটু মনযোগ, চিন্তা ও বিবেক দিয়ে পর্যবেক্ষণ করলেই কোনোটা সঠিক তথ্য আর কোনোটা গুজব, অপপ্রচার বা উস্কানিমূলক তথ্য তা সহজেই বুঝা যায়। এসব তথ্য যাচাই বাছাই করে গ্রহণ করতে হবে। সঠিক সূত্র থেকে নির্ভরযোগ্য তথ্য গ্রহণ করতে হবে।

লেখক: প্রকল্প পরিচালক, গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে প্রচার কার্যক্রম শক্তিশালীকরণ প্রকল্প।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন