Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভারতে নতুন করে ধর্মীয় সংঘাত উস্কে দিতে পারে যে আইন

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ৩ জুন, ২০২২, ৬:০৬ পিএম

ভারতে সব নাগরিকের জন্য একটি অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বা ইউনিফর্ম সিভিল কোড বাস্তবায়নের কথাবার্তা চলছিল অনেকদিন আগে থেকেই। এরকম কোন আইন হলে বিয়ে, বিচ্ছেদ, বা সম্পত্তির উত্তরাধিকারের মত বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে ভারতের বিভিন্ন সম্পদ্রায়ের মানুষেরা নিজ নিজ ধর্ম অনুযায়ী যে ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তিগত আইন অনুসরণ করেন - তা আর থাকবে না। ধর্ম, লিঙ্গ, বা যৌন অভিরুচি নির্বিশেষে সবার জন্য একটিই অভিন্ন আইন হবে।

একারণে শুরু থেকেই এতে প্রধান বাধা আসছে ধর্মের দিক থেকে। ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু ও প্রধান সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠী - উভয়েই এর তীব্র বিরোধিতা করে আসছেন। ভারতে একটি ইউনিফর্ম সিভিল কোড বা ইউসিসি করার জন্য আলোচনা শুরু হয় ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর থেকেই। ভারতের সংবিধানেও বলা আছে যে রাষ্ট্রের উচিত হবে এরকম একটি আইন করার জন্য প্রয়াস চালানো।

কিন্তু আজ পর্যন্ত ভারতে এরকম একটি অভিন্ন আইন হতে পারেনি, সুপ্রিম কোর্টের ভাষায় এটি এক ‘ডেড লেটার’ হয়েই রয়ে গেছে। তবে বর্তমানে ক্ষমতাসীন প্রধানমন্দ্রী নরেন্দ্র মোদির হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভারতীয় জনতা পার্টি এরকম একটি আইনের ভাবনাকে পুনরুজ্জীবিত করে তুলছে। ভারতের যেসব রাজে বিজেপি ক্ষমতায় আছে - যেমন উত্তর প্রদেশ, হিমাচল প্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশ - সেখানে ইউসিসি নিয়ে আলোচনা ক্রমশই জোরালো হচ্ছে।

বাস্তবিক, বিজেপির মূল নির্বাচনী প্রচারের সময় প্রধান অঙ্গীকার ছিল তিনটি। অযোধ্যায় বিতর্কিত ধর্মীয় স্থানটির ওপর রামমন্দির নির্মাণ, কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করা, এবং একটি অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রবর্তন। তো সেই মন্দির নির্মাণ এখন চলছে, কাশ্মীরের স্বায়ত্বশাসিত মর্যাদাও বাতিল করা হয়েছে। সুতরাং এখন পাদপ্রদীপের আলো এসে পড়েছে ইউসিসির ওপর।

এই অভিন্ন দেওয়ানি বিধি সম্পর্কে হিন্দু ডানপন্থী মহল থেকে যেসব কথাবার্তা বলা হচ্ছে তাও লক্ষণীয়। এতে ইউসিসিকে দেখানো হচ্ছে তাদের ভাষায় ‘পশ্চাৎপদ’ মুসলিম ব্যক্তিগত আইনসমূহের একটি প্রতিপক্ষ হিসেবে। মুসলিমদের তিন তালাক বা ‘তাৎক্ষণিক বিবাহবিচ্ছেদের’ উদাহরণও টানা হচ্ছে - যা ২০১৯ সালে মোদির সরকার নিষিদ্ধ করে। বিজেপির ম্যানিফেস্টোতে বলা হচ্ছে, ভারত যতদিন অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রবর্তন না করবে ততদিন পর্যন্ত সেদেশে জেন্ডার সমতা প্রতিষ্ঠিত হবে না।

তবে রাজনীতিবিজ্ঞানী আসিম আলি মনে করেন, বাস্তবতা অনেক বেশি জটিল। ‘ইউসিসি ভারতের হিন্দু ও মুসলিম উভয়েরই সামাজিক জীবনে ব্যাঘাত সৃষ্টি করবে’ - বলেন তিনি। আলির কথায়, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি তৈরি করতে গেলে তা এমন এক ‘প্যানডোরার বাক্স’ খুলে দেবে যার ফলে বিজেপি যে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠদের প্রতিনিধিত্ব করার দাবি করে - তাদের জন্যও অনাকাঙ্খিত পরিণতি বয়ে আনতে পারে।

মুসলিম নেতাদের তীব্র প্রতিবাদ : ইউনিফর্ম সিভিল কোড বিষয়ে ২০১৬ সালে ভারতের আইন কমিশন একটি জনমত যাচাইয়ের প্রক্রিয়া শুরু করার পরই এর তীব্র প্রতিবাদ হয়েছিল। কমিশনের চেয়ারম্যান জাস্টিস বি এস চৌহান তাদের ওয়েবসাইটে চার পাতার একটি প্রশ্নপত্র আপলোড করেছিলেন। যাতে বলা হয়, দেশে 'সামাজিক অন্যায়'গুলো দূর করার জন্য একটি ইউনিফর্ম সিভিল কোড প্রণয়ন করা যায় কি না, সেই লক্ষ্যেই তাদের এই উদ্যোগ। প্রশ্নপত্রে মুসলিমদের মধ্যে প্রচলিত তিন তালাকের প্রথা পুরোপুরি রদ করা, বহাল রাখা কিংবা তাতে সংশোধনী আনার ব্যাপারে মানুষের রায় কী জানতে চাওয়া হয়।

ভারতের প্রায় প্রধান সব ধর্মের বিভিন্ন বিতর্কিত বিষয় নিয়েই জাতীয় আইন কমিশন মতামত আহ্বান করে। মুসলিমদের তালাক ছাড়াও, খ্রিস্টানদের বিবাহবিচ্ছেদ চূড়ান্ত করার আগে দু'বছর অপেক্ষা করা, হিন্দু সমাজের কিছু অংশে 'মৈত্রী-কারার' বা বহুবিবাহের মতো যে পদ্ধতি চালু আছে, অথবা হিন্দু মেয়েদের পৈতৃক সম্পত্তির উত্তরাধিকার পাওয়া সহজ করতে আইন পরিবর্তন করা উচিত কি না - এসব নানা ব্যাপারে মতামত আহ্বান করা হয়।

কিন্তু ভারতের মুসলিম সমাজের সবচেয়ে প্রভাবশালী সংগঠন মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড এই জনমত যাচাই নিয়ে তীব্র আপত্তি জানায়। ভারতের মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড এই প্রক্রিয়া বয়কটের আহ্বান জানিয়ে অভিযোগ করে, ইউনিফর্ম সিভিল কোড প্রণয়নের নামে আইন কমিশন আসলে বিজেপি সরকারের গোপন এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চাইছে। বোর্ডের সদস্য হজরত মওলানা ওয়ালি রহমানি দিল্লিতে সাংবাদিক বৈঠক করে বলেন, বহু ধর্ম, বহু মতের দেশ ভারতে ইউনিফর্ম সিভিল কোড কখনও প্রযোজ্য হতে পারে না।

বিবাহ, বিবাহ-বিচ্ছেদ, সম্পত্তি বা উত্তরাধিকারের মতো বিষয়গুলো বিভিন্ন ধর্মের ‘পার্সোনাল আইনে’র মধ্যে পড়ে এবং সেখানে আইন কমিশন নাক গলাতে পারে না বলেও তিনি মন্তব্য করেন। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে কয়েক হাজার ইমাম এক সমাবেশ করে বলেন, মুসলিম পারিবারিক আইনের বদলে অভিন্ন দেওয়ানী বিধি তারা কোনমতেই মেনে নেবেন না। সূত্র: বিবিসি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভারত


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ