Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভারতে বহুবিবাহ বন্ধের জন্য লড়ছেন যে মুসলিম নারীরা

অনলাইন ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ১২ মে, ২০২২, ১২:১২ পিএম

ভারতের মুসলিমদের মধ্যে বহুবিবাহের প্রথার প্রতি আরো একবার সবার নজর পড়েছে ২৮ বছর বয়সী রেশমার করা এক মামলার ফলে। এ মামলার কারণ - রেশমার স্বামী মোহাম্মদ শোয়েব খান তার স্ত্রীর কোন লিখিত অনুমতি না নিয়েই আরেকটি বিয়ে করতে গিয়েছিলেন।

দিল্লি হাইকোর্টে ওই মামলা করার সময় রেশমা এই আর্জিও জানিয়েছেন, যেন আদালত পুরুষদের একাধিক বিবাহের এই "সেকেলে প্রথা"কে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আইন প্রণয়ন করতে সরকারের প্রতি আদেশ জারি করে। আদালতের দলিলপত্রে দেখা যায়, রেশমার সাথে শোয়েব খানের বিয়ে হয় ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে। পরের বছর নভেম্বর মাসে এই দম্পতির একটি পুত্রসন্তান হয়।

রেশমা তার স্বামীর বিরুদ্ধে পারিবারিক সহিংসতা, নিষ্ঠুরতা, হয়রানি, এবং যৌতুক দাবির অভিযোগ এনেছেন। স্বামী শোয়েব খানও আবার একই রকম অভিযোগ এনেছেন রেশমার বিরুদ্ধে। রেশমা বলছেন, তাকে ও তার সন্তানকে ত্যাগ করে তার স্বামী, এখন আরেকটি স্ত্রী গ্রহণের পরিকল্পনা করছেন। রেশমার কথায়, তার স্বামীর এই পদক্ষেপ "অসাংবিধানিক, শরিয়া-বিরোধী, বেআইনি, অমানবিক, জবরদস্তিমূলক ও বর্বর।" তিনি বলেন, "মুসলিম নারীদের দুর্দশা কাটাতে এই প্রথার ওপর নিয়ন্ত্রণ আনা আবশ্যক।"

ভারতে বহুবিবাহের আইনি বৈধতার প্রশ্ন আর রেশমা-শোয়েবের বৈবাহিক দ্বন্দ্বের নিষ্পত্তি এখন হবে আদালতে। কিন্তু এ মামলাটি আবার নতুন করে ভারতে বহুবিবাহের প্রথাকে কেন্দ্র করে বিতর্ককে সামনে নিয়ে এসেছে। ভারতে মুসলিম ও কিছু উপজাতীয় জনগোষ্ঠী ছাড়া অন্য সবার জন্য বহুবিবাহ অবৈধ। পিউ রিসার্চ সেন্টারের ২০১৯ সালের এক রিপোর্টে বলা হচ্ছে - সারা পৃথিবীর প্রায় ২ শতাংশ মানুষ এমন বাড়িতে বাস করে যেখানে বহুবিবাহ ঘটেছে।

মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ তুরস্ক ও তিউনিসিয়ার মত দেশসহ পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই বহুবিবাহ নিষিদ্ধ। যে সব দেশে বহুবিবাহ বৈধ - সেখানেও বহু রকম নিয়মকানুন করে একে নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়। জাতিসংঘ বহুবিবাহকে "নারীর বিরুদ্ধে এক অননুমোদনযোগ্য বৈষম্য" বলে আখ্যায়িত করেছে, এবং একে "নিশ্চিতভাবে বিলুপ্ত" করার আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু ভারতের রাজনীতিতে এই বহুবিবাহ প্রশ্নটি "গেলাও যায় না, উগরানোও যায় না" এমন এক বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল বিজেপি অঙ্গীকার করেছে যে তারা ভারতে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বা ইউনিফর্ম সিভিল কোড চালু করবে। বিতর্কিত এই আইন কার্যকর হলে বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ এবং উত্তরাধিকারের মত বিষয়গুলো আর সংশ্লিষ্টদের ধর্মীয় আইন দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হবে না - বরং তা চলে আসবে এমন এক অভিন্ন আইনেরও আওতায় - যা সকল নাগরিকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।

কিন্তু ভারত এখন এমন এক কালপর্বের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে - যখন দেশটির সমাজ ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এই মেরুকরণের কারণে ভারতের সরকার যদি বিবাহসংক্রান্ত কোন আইনী সংস্কার করতে যায় - তাহলে নিশ্চিতভাবেই দেশটির মুসলিমদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ একে ইসলামের ওপর আক্রমণ বলে বিবেচনা করবে।

ভারতের সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং ইসলামী পণ্ডিত এস ওয়াই কোরেশি বলছেন, "ভারতে অনেকেই মনে করে যে প্রায় সব মুসলিমেরই চারটি করে স্ত্রী আছে, এবং তাদের বহুসংখ্যক বাচ্চাকাচ্চা হয় - যার ফলে একদিন মুসলিমরা সংখ্যায় হিন্দুদের ছাড়িয়ে যাবে। কিন্তু এটা সত্য নয়।" বলা দরকার, ভারতের জনসংখ্যা এখন ১৩০ কোটি এবং তার মাত্র ১৪ শতাংশ হচ্ছেন মুসলিম। ভারতের জনসংখ্যার ৮০ শতাংশই হিন্দু।

কোরেশি বলছেন, ভারতে মুসলিম পুরুষরা চারটি পর্যন্ত বিয়ে করতে পারে এবং কোরআনে বহুবিবাহের অনুমোদন আছে ঠিকই, কিন্তু তার সাথে "কড়া পূর্বশর্ত এবং বিধিনিষেধ আছে" - যা পূরণ করা প্রায় অসম্ভব। "কোরআন বলছে, একজন পুরুষ দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থ স্ত্রী গ্রহণ করতে পারে কিন্তু তা করতে হবে শুধুমাত্র অনাথ ও বিধবাদের মধ্যে থেকে - এবং তাদের সাথে সমান ব্যবহার করতে হবে, অন্য কোন কিছু করলেই তা হবে লঙ্ঘন" - বলছেন কোরেশি।

"কিন্তু সমানভাবে ভালোবাসা বাস্তবে প্রায় অসম্ভব, কারণ এর অর্থ তাদের সবাইকে একই কাপড় কিনে দেয়া নয় - বরং তার চাইতে অনেক বেশি কিছু।" কোরেশি বলছেন, বহুবিবাহের ব্যাপারে এ নির্দেশনা কোরআনে অন্তর্ভুক্ত হয় সপ্তম শতাব্দীতে। তখন আরবে গোত্রে-গোত্রে যুদ্ধ চলতো, বহু পুরুষই অল্প বয়সে মারা যেতো - তাই বিধবা ও এতিমদের সহায়তার জন্যই বহুবিবাহের কথা বলা হয়। "কিন্তু আসলে কোরআন বহুবিবাহকে ভালো চোখে দেখে না এবং এটাকে নিরুৎসাহিত করে" - বলেন মি. কোরেশি।

ভারতের মুম্বাইয়ের নারী অধিকারকর্মী জাকিয়া সোমান বহুবিবাহের একজন কড়া সমালোচক। তিনি বলেন, আজকের ভারতে কোন যুদ্ধ চলছে না এবং বহুবিবাহ হচ্ছে একটা "নারীবিদ্বেষী ও পিতৃতান্ত্রিক প্রথা" - যা অবশ্যই নিষিদ্ধ করতে হবে। জাকিয়া সোমান মুম্বাই-ভিত্তিক "ভারতীয় মুসলিম মহিলা আন্দোলন" বা বিএমএমএ নামে একটি সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা। তিনি বলছেন, বহুবিবাহ "নৈতিক, সামাজিক ও আইনী দৃষ্টিতে জঘন্য একটি প্রথা" এবং এটা যে আইনগতভাবে অনুমোদিত সেটাও একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

"আপনি কীভাবে বলতে পারেন যে একজন পুরুষ একটির বেশি স্ত্রী রাখতে পারে?" - বলেন জাকিয়া , "সম্প্রদায়কে এখন সময়ের সাথে সাথে এগিয়ে যেতে হবে। আজকের দিনে, আজকের যুগে এটি মানবাধিকার ও নারীর মর্যাদার গুরুতর লংঘন।" বিএমএমএ ২০১৭ সালে ২৮৯ জন নারীর ওপর একটি জরিপ চালিয়েছিল - যারা এরকম বহুগামী সম্পর্কের ভেতরে আছে। জরিপে তাদের শারীরিক, মানসিক, আবেগগত এবং অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে খোঁজখবর করা হয়। এর মধ্যে ৫০ জন নারীর জীবনের প্রাপ্ত তথ্য নিয়ে তারা একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেন।

"আমরা দেখেছি যে তারা এমন এক পরিস্থিতির মধ্যে আটকা পড়ে গেছি যা অত্যন্ত অন্যায়। তাদের সবার জন্যই এটা এক দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা এবং অনেকের মধ্যেই মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিয়েছে" - বলেন মিজ সোমান। বিএমএমএ এর আগে মুসলিমদের বিতর্কিত তিন তালাক প্রথা নিয়েও ব্যাপক আন্দোলন করেছিল এবং গত কয়েক বছর আগে এটি ভারতে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

সংগঠনটি ২০১৯ সালে ভারতে বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করার আবেদন জানিয়েও সুপ্রিম কোর্টে একটি আবেদন করেছে। ক্ষমতাসীন দল বিজেপির নেতা এবং আইনজীবী অশ্বিনীকুমার দুবেসহ আরো কয়েকজন এধরনের আইনী চ্যালেঞ্জ করেছেন। তবে এর ফলে ভারতের রক্ষণশীল মুসলিমদের মধ্যে থেকে অভিযোগ উঠেছে যে এটা তাদের ধর্মে হস্তক্ষেপের শামিল।

"ইসলাম ধর্মে আইন হচ্ছে ঐশী। আমরা কোরআন এবং হাদিসকে মানি। আল্লাহ যা আইনসিদ্ধ করেছেন - তাকে পরিবর্তন করার অধিকার কোন মানুষের নেইৱ - বলেন ড. আসমা জোহরা, যিনি অল-ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের মহিলা শাখার প্রধান। এই সংগঠনটি আদালতে মি. দুবের করা আবেদনের বিরোধিতা করছে।

তিনি বলছেন, মুসলিমদের মধ্যে বহুবিবাহ "খুবই বিরল এবং এটি একটি নন-ইস্যু" । তিনি অভিযোগ করছেন বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর জুলুম করতে চাইছে। "আপনি কি কখনো একজন মুসলিম পুরুষ দেখেছেন যার চারটি স্ত্রী আছে? বেশির ভাগ পুরুষই বলবে চারজনের কথা ছেড়ে দিন, ২০২২ সালে একজন স্ত্রীর ভরণপোষণ করাই কঠিন। তা ছাড়া মুসলিমদের মধ্যে একাধিক বিয়ের হার সবচেয়ে কম"- বলেন আসমা জোহরা।

তার এই কথার ভিত্তি হচ্ছে একটি জরিপের উপাত্ত। এতে দেখা গেছে যে বহুবিবাহ সব ধর্মেই আছে। ভারতে ১৯৬১ সালের আদমশুমারির সময় ১০০,০০০ বিবাহের নমুনার ওপর জরিপ চালিয়ে দেখা যায় - মুসলিমদের মধ্যে বহুবিবাহের হার হচ্ছে ৫.৭ শতাংশ যা অন্য সব ধর্মীয় সম্প্রদায়ের চেয়ে কম। এর পরের আদমশুমারীগুলোর সময় এ ইস্যুতে নিরবতা পালন করা হয়। তবে বহুবিবাহের ওপর সর্বসাম্প্রতিক যে উপাত্ত পাওয়া যায় তা এসেছে ২০০৫-০৬ সালের জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য জরিপ থেকে।

এতে দেখা যায়, সব ধর্মেই বহুবিবাহের সংখ্যা ব্যাপক ভাবে কমে যাচ্ছে। "যেহেতু এই উপাত্ত বেশ পুরোনো -তাই আমাদেরকে ট্রেন্ডের দিকে তাকাতে হবে। আমরা যদি ১৯৩০ থেকে ১৯৬০ সালের আদমশুমারির উপাত্ত পরীক্ষা করি - তাহলে দেখা যাবে সব ধর্মীয় সম্প্রদয়ের মধ্যেই বহুবিবাহের সংখ্যা অব্যাহতভাবে কমছে, এবং প্রতি দশকেই বহুবিবাহ সবচেয়ে বেশি কমেছে মুসলিমদের মধ্যে" - বলেন মি. কোরেশি। তিনি অবশ্য যোগ করেন যে এক্ষেত্রে একমাত্র পারিবারিক স্বাস্থ্য জরিপটিতেই ভিন্ন ফল দেখা যাচ্ছে। সূত্র: বিবিসি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভারত


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ