পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
রাজধানীর যানজট কমাতে যেসব উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে তার কোনোটাই কাজে লাগছে না। বরং আইনের সঠিক প্রয়োগের অভাবে যানজট কমানোর ছোট উদ্যোগে জট অল্প বাড়ে, বড় উদ্যোগে দ্বিগুণ বাড়ে। যানজট সমস্যা মোকাবিলায় এর আগেও অনেক উদ্যোগের বাস্তবায়ন করেছে কর্তৃপক্ষ। দিনের বেলা শহরে ট্রাক ও আন্তঃনগর বাসের প্রবেশ বন্ধ করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় রেলওয়ে স্টেশনটা রাজধানী শহরের মধ্যে হওয়ায় রেলওয়ের লেভেল ক্রসিংয়ের কারণে অনেক ব্যস্ত রাস্তা একটা উল্লেখযোগ্য সময় ধরে বন্ধ থাকে, ফলে ট্রেন চলাচলের সময় বদলানো হয়েছে দূরগামী যাত্রীর সুবিধা-অসুবিধার কথা খেয়াল না রেখে, বিভিন্ন রাস্তায় রিকশা চলা বন্ধ করা হয়েছে। পথচারী পারাপারের জন্য রাস্তায় যে জেব্রাক্রসিং ছিল সেগুলো বাতিল করে ফুটওভার ব্রিজ ও আন্ডারপাস তৈরি করা হয়েছে। ট্রাফিক সিগন্যাল বাতি চালু করা হয়েছে, সর্বশেষ সিসি ক্যামেরাও বসানো হয়েছে। তাহলে কেন যানজট কমছে না? রাস্তায় আইন মানছি না আমরা। যত্রতত্র গাড়ি দাঁড় করানো, ফুটপাত দখল, কম গতি, বেশি গতির পরিবহন সমান্তরালে চলা আর পরিবহন আধিক্যের কারণে সড়কে যানজট বেশি লাগে। এর মধ্যে প্রতিদিন ঢাকার রাস্তায় নামছে প্রায় ২০০ বিভিন্ন ধরনের নতুন পরিবহন।
২০৩০ সালে ঢাকায় জনসংখ্যা হবে ৩০ কোটি। এ প্রেক্ষাপটে যানজট নিরসনে উদ্যোগ নেওয়ার সময় এখনই। রাজধানী ঢাকাকে সবার জন্য বসবাসের উপযোগী করতে হলে সুদূরপ্রসারী ও সমন্বিত মহাপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন জরুরি। যানবাহন এবং যানজট যে শহরের সচলতা শুধু কমিয়ে দিচ্ছে তাই নয়, আর্থিক ক্ষেত্রেও আঘাত হানছে। এখন যে পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আছে ঢাকা শহর সে পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকলে এ শহর অচল হয়ে পড়বে। আমাদের যেটুকু সড়কপথ আছে তাতে বর্তমান প্রেক্ষাপটে নানাবিধ পদক্ষেপ নিলে যানজট ৮০ ভাগ কমিয়ে আনা সম্ভব। বিশ্বের বড় বড় শহর এমনকি হজের সময় মক্কা-মদিনা; অলিম্পিক গেমসহ নানা বড় আসরের সময় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার দিকে লক্ষ করলে দেখা যাবে, সে সময় কত সহজেই না যানজট নিয়ন্ত্রণ করছে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো।
চীনে যখন অলিম্পিকের মতো বড় আসর হলো, তখন তারা একদিন পরপর জোড়-বেজোড় নাম্বারের প্রাইভেট গাড়ি চলাচল করার অনুমতি দিয়ে নতুন কৌশল বের করেছিল। এক দিন জোড় সংখ্যার গাড়িগুলো রাস্তায় চলার অনুমতি দিয়েছে তো পরদিন দিয়েছে বেজোড় সংখ্যার গাড়ি। বিশেষ মুহূর্তগুলোতে বাইরের শহরের গাড়ি শহরে ঢোকার অনুমতি দেওয়া হয়নি। সেক্ষেত্রে আগে থেকেই সরকারের পক্ষ থেকে পত্রিকায় ঘোষণা দেওয়া হয়। ফলে দুর্ভোগ হয় না, হয় না যানজটও। জোড়-বেজোড় নাম্বারের গাড়িগুলো আমাদের রাজধানীতেও একদিন পরপর চলাচল করতে দেওয়া যেতে পারে। ঢাকা মহানগর যানজট, পার্কিং সমস্যা, পরিবেশ দূষণ ও জনদুর্ভোগের পরিপ্রেক্ষিতে আশু করণীয় হলো পার্কিং চাহিদা পূরণের জন্য নীতিমালা প্রণয়ন, বিনামূল্যে পার্কিং বন্ধ করা এবং অবৈধ পার্কিংয়ের জন্য জরিমানার ব্যবস্থা করা, সর্বত্র জায়গা ও সময়ের মূল্যানুসারে পার্কিং ফি নেওয়া, পার্কিং থেকে প্রাপ্ত অর্থ পাবলিক পরিবহনের মানোন্নয়নে ব্যয় করা। এইসঙ্গে নগরের ব্যস্ততম এলাকায় প্রাইভেট কার চলাচলের ক্ষেত্রে কনজেশন চার্জ গ্রহণ করা, প্রাইভেট কারের লাইসেন্স সীমিত করা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অফিস-আদালতে প্রাইভেট গাড়ির পরিবর্তে পাবলিক পরিবহনের ব্যবস্থা করা, প্রাইভেট গাড়ি নির্ভর অবকাঠামো (ফ্লাইওভার, পার্কিংয়ের স্থান তৈরি) নির্মাণ না করা। পাবলিক পরিবহন, জ্বালানিমুক্ত যান ও পথচারীদের সুবিধা বৃদ্ধি করা। জায়গা ও সম্পদের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা ও প্রাইভেট কারের পার্কিং সমস্যা সমাধানে পার্কিংয়ের জন্য সময় ও স্থান অনুসারে অর্থ গ্রহণই যুক্তিযুক্ত। ফিলিপাইনে একসময় তীব্র যানজট ছিল। সেখানে স্বাভাবিক চলাচল ছিল কষ্টসাধ্য। যতদূর জানি, সেখানকার ট্রাফিক ব্যবস্থা এখন বেশ নিয়ন্ত্রিত। কীভাবে এই আইনটি তৈরি হয়েছে ফিলিপাইনে? ফিলিপাইনের আইন অনুসারে সেখানে কোনো গাড়ির লাইসেন্স প্লেটের অক্ষরটা যদি ১ অথবা ২ দিয়ে শেষ হয়, তবে সেই গাড়িটি রাস্তায় সোমবারে থাকার অনুমতি পাবে না। আবার যদি সেটা ৩ বা ৪ দিয়ে শেষ হয় তাহলে মঙ্গলবার গাড়ি থাকতে হবে ঘরেই। ৫ ও ৬ যাদের গাড়ির লাইসেন্স প্লেটের শেষ অক্ষর, তারা তাদের গাড়ি নিয়ে বেরোবেন না বুধবার। বৃহস্পতিবারে রাস্তায় থাকবে না সেসব গাড়ি, যেগুলোর লাইসেন্স প্লেটের শেষে রয়েছে ৭ ও ৮। আর ৯ ও ০ যাদের গাড়ির লাইসেন্স প্লেটের শেষ নম্বর, তাঁরা বাড়িতেই থাকবেন শুক্রবারে। তো কী মনে হয়? ফিলিপাইনের এই আইনটা যে নতুন পরিকল্পনাটা দিল তা কি কাজ দেবে এই বাংলাদেশে? রাজধানী ঢাকায় যানজটের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে অতিরিক্ত প্রাইভেট কারের উপস্থিতি। রাস্তার যানবাহনের প্রায় ৮০ শতাংশ প্রাইভেট কার। কোনো কোনো পরিবারের ৩/৪টি প্রাইভেট কার রয়েছে। কোনো কোনো সময় দেখা যায়, কার ড্রাইভার ও একজন যাত্রী। রোড লাইসেন্স দেওয়ার সময় কর্তৃপক্ষ এই সব বিবেচনায় আনে বলে মনে হয় না।
একটি রিপোর্টে দেখা যায় যে, রাজধানীর মোট রাস্তার ৫৪.২ শতাংশ জায়গা দখলে রাখে প্রাইভেট কার। প্রশ্ন জাগে প্রাইভেট কারের সংখ্যাধিক্যের কারণ কী? কারা রাতারাতি এত টাকার মালিক হলেন? একটি পরিসংখ্যান মতে গত দশ বছরে শুধু রাজধানীতে যানবাহন রেড়েছে দুই লাখ বার হাজার একশত তিনটি। ট্রাফিক অব্যবস্থাপনাও যানজটের কারণ। ট্রাফিক পুলিশ সিগন্যালের তোয়াক্কা না করে একই পয়েন্টে আধাঘণ্টা পর্যন্ত একদিকের যানবাহন আটকে রাখে। অনেক সময় অটো সিগন্যাল বাতিতে যানবাহন নিয়ন্ত্রিত হয় না। সবুজ বাতির বদলে ট্রাফিক পুলিশের হাত যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করছে।
ট্র্যাফিক বিভাগের হিসাব মতে, সেই সড়কের কম করে হলেও ৩০ ভাগ বা তারও বেশি দখল হয়ে আছে অবৈধ পার্কিং এবং নানা ধরনের দখলদারদের হাতে। এছাড়া ফুটপাথ হকারদের দখলে থাকায় প্রধান সড়কেই পায়ে হেঁটে চলে নগরবাসী। ফলে যানজটের সঙ্গে আছে জনজট। আরেকটি হিসাবও আছে। ঢাকায় ১৫ ভাগ যাত্রী দখল করে আছে মোট সড়কের ৭০ ভাগ। কীভাবে? স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট এসটিপি-র হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে ঢাকায় কমবেশি ১৫ ভাগ যাত্রী প্রাইভেট গাড়িতে যাতায়াত করেন। এই প্রাইভেট কারের দখলে থাকে ৭০ ভাগেরও বেশি রাস্তা। বাকি ৮৫ ভাগ যাত্রী অন্য কোনো ধরনের গণপরিবহন ব্যবহার করে। অর্থাৎ তারা গণপরিবহন সড়কের মাত্র ৩০ ভাগ এলাকা ব্যবহারের সুযোগ পায়। এটা দেখবে কে? যানজট রাজধানীর নগর জীবনকেই শুধু বিপর্যস্ত করে তুলছে তা নয়, ঢাকাকে বসবাসের অযোগ্য হিসেবেও পরিচিতি এনে দিয়েছে। যানজট সমস্যার সমাধানে আর বেশ কয়েকটি ফ্লাইওভার নির্মাণের কাজ চলছে। এ নির্মাণ কাজের জন্য ব্যস্ত সড়কের একাংশ ব্যবহৃত হওয়ায় ধারে কাছের সব সড়কে যানজট অনিবার্য হয়ে উঠছে। নির্মাণ কাজের শম্বুকগতি মানুষের ভোগান্তিকে দীর্ঘস্থায়ী করছে। যানজটে এমনই অচলাবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে যে, আধাঘণ্টা দূরত্বের সড়ক অতিক্রম করতে গড়ে ৭-৮ গুণ পর্যন্ত সময় লাগছে। রাজধানীর যানজটের জন্য প্রাইভেট কারের মাত্রাতিরিক্ত সংখ্যা বৃদ্ধিকে দায়ী করা হয়। বলা হয়, রিকশার পাশাপাশি প্রাইভেট কারের আধিক্য অচলাবস্থার সৃষ্টি করছে। তবে অভিজ্ঞজনদের মন্তব্য, ট্রাফিক অব্যবস্থাপনা যানজটের জন্য প্রধানত দায়ী। ঢাকার রাজপথের এক বড় অংশ অবৈধ দখলদারদের দখলে চলে যাওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এ অবৈধ দখলদারিত্বের সঙ্গে রাজনৈতিক টাউট, পাড়া-মহল্লার মস্তান এবং পুলিশের সম্পর্ক থাকায় রাজধানীর সড়কগুলো দখলমুক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। রাজধানীর সড়ক ও ফুটপাত থেকে অবৈধ দোকানপাট উঠিয়ে দেওয়া সম্ভব হলে যানজট এমনিতেই সহনীয় হয়ে উঠবে। এর পাশাপাশি কঠোরভাবে ট্রাফিক আইনের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। যানবাহন চলাচলে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হলে যানজটের রশি টেনে ধরা সম্ভব হবে। রাজধানীর শহরতলীর কাঁচপুর ব্রিজের যানজটের কথা কে না জানে। আগে প্রতিদিন ঢাকা-চট্রগ্রাম এবং ঢাকা-সিলেটের ১৫টি জেলার মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা এ রাস্তায় চলতে গিয়ে আটকে থাকত। সেখান থেকে যানজট এখন উধাও হয়ে গেছে। কর্তব্যরত জাপানি প্রকৌশলীগণ সেখানকার যানজট দেখে হতবম্ব হন। তারা কয়েটি লেন করে দিয়ে যানজটমুক্ত করেন। যানজটের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রেড়িয়ে আসা সময়ের দাবি। সরকারকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে এই সমস্যার সমাধান করতে হবে যাতে জনগণ এই দুর্ভোগ থেকে রেহাই পায়।
লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।