Inqilab Logo

শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভোগান্তি নিয়েই ঈদযাত্রা

বাস-লঞ্চে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ টিকিটের চেয়ে দ্বিগুন যাত্রী নিয়ে ঢাকা ছেড়েছে বেশির ভাগ ট্রেন সদরঘাট টার্মিনাল লোকে-লোকারণ্য : লঞ্চে বসার জায়গা নেই; ঘাটে ঘাটে ভোগান্তি সড়ক পথ

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১ মে, ২০২২, ১২:০৩ এএম

পথে যানজট ভোগান্তি আর দুর্ভোগ জেনেও অতিরিক্ত টাকা দিয়ে টিকিট কেটে গ্রামের উদ্দেশে ছুটছে মানুষ। রাজধানীর কর্মজীবী মানুষ কেউ একা এবং কেউ স্ত্রী-সন্তান নিয়ে পরিবারের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করতে গ্রামের ছুটছেন। কেউ ট্রেনে, কেউ বাসে এবং কেউ গণপরিবহনে যাচ্ছেন। যারা সে সুযোগ থেকে বঞ্ছিত হয়েছেন, তাদের কেউ কেউ মোটরসাইকেলে দূরের পথ ধরেছেন। ঈদের ছুটি শুরু হয়ে গেছে। ফলে কর্মজীবীরা যে যেভাবে পারছেনÑ ঢাকা ছেড়ে গ্রামে যাচ্ছেন। লাখ লাখ মানুষ একসঙ্গে ঢাকা ছাড়ার কারণে পথে পথে ভোগান্তিতে পড়ছেন। লঞ্চঘাট, কমলাপুর স্টেশন, সায়েদাবাদ, গাবতলী, মহাখালী বাসটার্মিনালে লাখ লাখ মানুষের ভোগান্তির দৃশ্য টিভির সচিত্র প্রতিবেদনে দেখছেন। তারপরও ভোগান্তিকে সঙ্গী করেই ঘর থেকে বের হচ্ছেন গ্রামের বাবা-মা-ভাই-বোনের সঙ্গে মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর উদযাপনের জন্য। কর্মজীবীরা গ্রামে যাবেন, সে সুযোগে পরিবহন মালিক, লঞ্চ মালিকরা অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছেন। কেউ কেউ দ্বিগুন ভাড়া আদায় করছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।

গতকাল কমলাপুর রেল স্টেশন থেকে ২৪ ঘণ্টায় চারটি স্পেশাল ট্রেনসহ ১২২টি ট্রেন ছেড়ে গেছে দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে। প্রতিটি ট্রেনে টিকিটের চেয়ে অতিরিক্ত যাত্রী দেখা গেছে। ট্রেনের ভেতরে দাঁড়ানো যাত্রী ছাড়াও ছাদে শত শত যাত্রী দেখা গেছে। লঞ্চেও একই দৃশ্য চোখে পড়েছে। সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে দেখা যায়, প্রতিটি লক্ষ্যে অতিরিক্ত যাত্রী বহন করা হচ্ছে। এ নিয়ে কথা বললে লঞ্চ মালিকরা জানান, ঈদের সময় যাত্রীদের চাপ বেশি থাকে। তাছাড়া সারা বছরের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া হয়, ঈদে ঘরমুখি যাত্রীদের কাছ থেকে। গাবতলী, মহাখালী, সায়েদাবাদ টার্মিনাল ও কল্যাণপুর, টিকাটুলি, ফকিরেরপুল, কলাবাগান, গুলিস্তান, শ্যামলী বাসস্ট্যান্ড থেকে কত হাজার দূরপাল্লার বাস ছেড়ে গেছে তার সঠিক হিসেবে নেই। সংশ্লিষ্টদের মতো হাজার হাজার দূরপাল্লার বাস রাজধানী ঢাকা থেকে বিভিন্ন জেলার উদ্দেশ্যে ঈদের ঘরমুখো যাত্রীদের নিয়ে চলে গেছেন। তবে বেশির ভাগ বাস যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করেছেন।

একটি ইন্সুরেন্সে চাকরি করেন রংপুরের পীরগাছার মো. জোবেদ হোসেন। ঈদের ছুটিতে ট্রেনের টিকিট পাননি। পরিবারের সঙ্গে ঈদ করতে গতকাল শুক্রবার সকালে রাজধানীর কল্যাণপুর বাসটার্মিনালে আসেন। এসআর, হানিফ, নাবিল ও শ্যামলীর কাউন্টারে টিকিট পাননি। এরপর আহাদ এন্টারপ্রাইজে এসে টিকিট পান। তার কাছ থেকে টিকিটের দাম রেখেছে ১ হাজার ২৫০ টাকা। জোবেদ হোসেন জানান, ঢাকা থেকে রংপুর নন-এসির বাসভাড়া কয়েক মাস আগে ছিল ৫০০ টাকা। ডিজেলের দাম বৃদ্ধির পর ভাড়া বাড়িয়ে করা হয় ৭৭৬ টাকা। ঈদের সময় নেয়া হয় ১ হাজার ২৫০ টাকা। তিনি বলেন, ‘কী করব, বাড়ি তো যাওয়া লাগবে।’ আহাদ এন্টারপ্রাইজের মতো ঢাকা থেকে দূরপাল্লার সব রুটের এবং সব কোম্পানীর বাস সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে ১০০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত বেশি নেয়া হচ্ছে।

বঙ্গবন্ধু সেতুতে সাড়ে ৩৩ হাজার
বঙ্গবন্ধু সেতু দিয়ে ছুটছে যানবাহন উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায়। ঈদ যাত্রীদের নিয়ে এসব যানবাহন ধীর গতিতে সেতু অতিক্রম করছে। বৃহস্পতিবার থেকে গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় বঙ্গবন্ধু সেতু দিয়ে প্রায় ৩৩ হাজার ৫৩৯টি যানবাহন পারাপার হয়েছে। আর এতে টোল আদায় হয়েছে ২ কোটি ৭৭ লাখ ২৯ হাজার ৫০০ টাকার। টাঙ্গাইলের মহাসড়কে যানবাহনের চাপ থাকলেও স্বাভাবিকভাবে চলাচল করছে। ফলে এখন পর্যন্ত ঈদযাত্রায় তেমন ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে না উত্তরবঙ্গগামী মানুষজনকে। ইনকিলাবের স্থানীয় সংবাদদাতা জানান, কালিহাতীর ঢাকা-টাঙ্গাইল বঙ্গবন্ধু সেতুপূর্ব মহাসড়কে সারাদিন স্বাভাবিক গতিতে যানবাহন চলাচল করছে। ভোর থেকে মহাসড়কে পরিবহনের চাপ থাকলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়। এতে কোথাও যানজট বা ধীরগতি নেই।

বঙ্গবন্ধু সেতুপূর্ব পাড়ে উত্তরবঙ্গগামী মোটরসাইকেল পারাপারের জন্য দুটি লেন চালু করা হয়েছে। এতে সেতুর পূর্ব গোলচত্বর থেকে মোটরসাইকেলগুলো স্টক ইয়ার্ড (মালবাহী পরিবহন থেকে মালামাল আনলোডের স্থান) সড়ক দিয়ে সেতুর টোল প্লাজায় প্রবেশ করছে।

জানা গেছে, ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কের মির্জাপুর থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব পার পর্যন্ত ৮ শতাধিক আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন রাখা হয়েছে। বাস ছাড়াও প্রতিবারের মতো এবারও মানুষ পরিবার-পরিজন নিয়ে খোলা ট্রাকে করে বাড়ি ফিরছে। তবে মহাসড়কের চন্দ্রা থেকে এলেঙ্গা পর্যন্ত চার লেন সুবিধা পেয়ে যানবাহনগুলো স্বাভাবিক গতিতে আসতে পারলেও এলেঙ্গা থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্বপাড় পর্যন্ত সাড়ে ১৩ কিলোমিটার দুই লেনের কারণে যানবাহনের গতি কমাতে বাধ্য হচ্ছেন যানবাহন চালকরা।

মহাসড়কের এলেঙ্গা হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মো. আতাউর রহমান বলেন, গাড়ির চাপ আস্তে আস্তে বাড়ছে। তবে কোথাও যানবাহন চলাচল থেমে নেই। পরিবহন চলাচল স্বাভাবিক করতে সড়কে কাজ করে যাচ্ছে পুলিশ। ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতুপূর্ব মহাসড়ক পরিদর্শন করেছেন ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি (ক্রাইম) নুরে আলম মিনা বলেন, বিগত ঈদগুলো থেকে এবার ঈদযাত্রায় পুলিশ প্রশাসন বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে পুলিশের নজরদারি ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে।

ঢাকা-চট্টগ্রাম সহাসড়ক
ঈদুল ফিতরের ছুটি শুরু হয়েছে; মানুষও ঢাকা থেকে গ্রামে যেতে শুরু করেছে। প্রতি বছর ঈদের আগে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহসড়কে প্রচণ্ড যানজট দেখা যায়। কিন্তু এবারের চিত্র কিছুটা ভিন্ন। মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জ অংশে যানজট তেমন নেই। গত বৃহস্পতিবার ও গতকাল শুক্রবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত সরেজমিনে দেখা যায়, নারায়ণগঞ্জ জেলার ওপর দিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড থেকে সোনারগাঁও উপজেলার মেঘনা টোল প্লাজা পর্যন্ত প্রায় ২২ কিলোমিটার এলাকায় চট্টগ্রামগামী যানবাহনগুলো স্বাভাবিকভাবে চলাচল করছে। তবে মেঘনা টোলপ্লাজা থেকে ঢাকাগামী সড়কের মদনপুর চৌরাস্তা মোড়ে সিগনালে ১৫ থেকে ২০ মিনিট যানবাহনগুলোতে বসে থাকতে হচ্ছে। এতে প্রায় এক থেকে দেড় কিলোমিটার রাস্তা পর্যন্ত যানজট সৃষ্টি হচ্ছে।

তাছাড়া সাইনবোর্ড মোড় ও শিমরাইল মোড়ে (চিটাগাং রোড নামে পরিচিত) যানজট দূর করতে কয়েকশ’ গজ দূরে ইউটার্নের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ফলে ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জগামী গাড়িগুলো সানারপাড় ইউটার্ন হয়ে সাইনবোর্ড দিয়ে প্রবেশ করছে। অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জ থেকে চট্টগ্রাম বা সিলেটগামী গাড়িগুলো মাতুয়াইল ইউটার্ন নিয়ে যাচ্ছে। যার ফলে এখন এসব মোড়ে কোনো গাড়ি জটলাও নেই। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের অবৈধ কাটাগুলোও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এতে মহাসড়কে যত্রতত্র গাড়ি ঘোরানো বন্ধ হয়েছে।
ঢাকা-সিলেট মহাসড়কেও সোনারগাঁয়ের কাঁচপুর মোড় থেকে রূপগঞ্জের ভুলতা-গাউছিয়া পর্যন্ত সড়কে গাড়ি চাপ থাকলেও যানজট নেই। তবে ভুলতা ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে গাড়িগুলো ধীরগতিতে চলাচল করছে। প্রাইভেটকারসহ বিভিন্ন পরিবহনের বাস ফ্লাইওভারের উপর দিয়ে নির্বিঘ্নে চলে যাচ্ছে।

ঢাকা থেকে চট্টগ্রামগামী তিশা পরিবহনের চালক সোলেমান মৃধা বলেন, এবার ঈদ যাত্রায় ঢাকায় আসতে কোনো যানজট পাইনি। মহাসড়কের কাটাগুলো বন্ধ করে দিয়ে সব থেকে ভালো করেছে। এর কারণে যত্রতত্র গাড়ি ইউটার্ন নিতে গিয়ে যানজট ও দুর্ঘটনা হয়। তাছাড়া শিমরাইল মোড়ে পুলিশ গাড়ি দাঁড়াতেই দিচ্ছে না। তবে মেঘনা টোল প্লাজায় যানজটের সম্ভবনা রয়েছে।

কাঁচপুর হাইওয়ে থানার পরিদর্শক ওমর ফারুক বলেন, ঈদ যাত্রায় ঢাকা-সিলেট ও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জ অংশে কোথাও যানজট নেই। যান চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। ঢাকা থেকে গাড়িগুলো ভালোভাবে বের হয়ে যেতে পারছে। তবে ঢাকামুখী পণ্যবাহী ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, লরী, পিকআপ এসব বেশি ঢুকছে। এজন্য মদনপুর চৌরাস্তা মোড়ে সিগনালে একটু যানজট আছে।

মেঘনা টোল প্লাজার সহকারী ব্যবস্থাপক হযরত আলী জানান, শুক্রবার থেকে গাড়ির চাপ বেড়ে গেছে। টোলের ৮টি বুথ চালু আছে। ফলে গাড়ির কোনো সিরিয়াল হচ্ছে না। কার্ড স্ক্যান করে ও ফ্রাস্ট ট্র্যাক সুবিধাও আছে। মোটরসাইকেলের আলাদা লেন করা হয়েছে। ট্রাক স্কেল করার জন্যও সিরিয়াল ধরতে হবে না। কোন ট্রাক স্কেল নিয়ে সমস্যা হলে এর জন্য আলাদা ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রতিদিন ২৫ হাজার গাড়ি চলাচল করছে। এখন থেকে ঈদের আগে পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিন ৪০ হাজার গাড়ি চলবে ধারণা করা যাচ্ছে। তবে এতেও কোনো সিরিয়াল ধরতে হবে না।

ট্রেনে টিকিটের চেয়ে দ্বিগুন যাত্রী
ট্রেনে ঈদযাত্রা শুরু হয়ে গেছে। প্রথম দিনই যাত্রীদের চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়। ট্রেনের ভেতর ছাড়াও শত শত যাত্রী ট্রেনের ছাদেও ভ্রমণ করছেন। যারা টিকিট কেটেছেন তাদের অনেকেই সিটে বসতে পারেননি। এমনকি অনেক যাত্রী সিট পর্যন্ত যেতে পারেননি। গতকাল ২৪ ঘণ্টায় ১২২টি ট্রেন কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে ছেড়ে গেছে দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে। এরমধ্যে ৪টি স্পেশাল ট্রেন ছিল।

গতকাল শুক্রবার প্রায় সবগুলো ট্রেন যথাসময়ে কমলাপুর থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে ছেড়ে গেছে। এতে বেশ স্বস্তিতে ট্রেন ভ্রমণ শুরু করলেও টিকিট কেটেও সিটে বসতে না পারায় যাত্রীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। দুপুরে বনলতা এক্সপ্রেস ট্রেনে বসে ছিলেন মো. খাইরুজ্জামান। তিনি বলেন, করোনার কারণে গত দুই বছর ঈদে তিনি বাড়িতে যাননি। এবার মা-বাবার সঙ্গে ঈদ উদযাপন করতে বাড়িতে যাচ্ছেন। ট্রেনে টিকিট কাটা নিয়ে কিছুটা সমস্যা হয়েছিল। কিন্তু এখন সিটে বসতে বেগ পেতে হচ্ছে।

শিডিউল অনুযায়ী বনলতা এক্সপ্রেস ট্রেনটির বেলা ১টা ৩০ মিনিটে ছাড়ার কথা। নির্দিষ্ট সময়ের আগে থেকেই প্লাটফর্মে ছিল ট্রেনটি। সিলেটগামী জয়ন্তিকা এক্সপ্রেসের যাত্রী মো. আসাদ বলেন, ট্রেনের টিকিট পেতে একটু ঝামেলা হয়েছিল। আমি অনলাইনে টিকিট করেছিলাম। আমার এবং আমার স্ত্রীর মোবাইলফোন থেকে ট্রাই করি, কিন্তু পাইনি। পরে অফিসের কম্পিউটার থেকে চেষ্টা করে পেয়েছি। দুই বছর পর বাড়িতে ঈদ করতে পারব।
রাজধানীর যানজটের ভয়ে ট্রেন ছাড়ার অনেক আগেই স্টেশনে এসে বসে ছিলেন অনেকে। পুরো প্ল্যাটফর্মে মানুষের সরব উপস্থিতি ছিল। তিল ধরনের ঠাঁই নেই। হুইসেল বাজিয়ে একেকটি ট্রেন গন্তব্যের উদ্দেশে প্ল্যাটফর্ম ছাড়ছে, আরেকটি ট্রেন এসে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়াচ্ছে। ঠিক সময়মতো ট্রেন ছাড়ায় সন্তুষ্ট হয়েছেন যাত্রীরাও। ট্রেনের কোনো ঠাঁই নেই। যত যাত্রী টিকিট কেটে যাচ্ছেন তার চেয়ে বেশি যাত্রী বিনা ভাড়ায় ভ্রমণ করছেন।
রেলমন্ত্রী অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলাম সুজন বলেছিলেন, যতজন টিকিট কাটবে ততজন যাত্রী টেনে যাবে। সিটের বাইরে একজনও অতিরিক্ত যাত্রী বহন করা হবে না। অথচ কমলাপুর থেকে ছেড়ে যাওয়া ট্রেনগুলোতে দেখা গেলে ভিন্ন চিত্র। প্রতিটি ট্রেনে শত শত টিকিটবিহীন যাত্রী উঠে পড়েছেন।

সার্বিক বিষয়ে কমলাপুর রেলস্টেশনের ভারপ্রাপ্ত স্টেশন ম্যানেজার মো. আমিনুল হক বলেন, শুক্রবার তৃতীয় দিনের মতো ঈদযাত্রা করছেন মানুষ। সারাদিনে ১২২টি ট্রেন কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে ছেড়ে গেছে দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে। এরমধ্যে ৪টি স্পেশাল ট্রেন রয়েছে। বঙ্গবন্ধু সেতু এক লেন হওয়ায় সেখানে অপেক্ষা করতে গিয়ে কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে। তাছাড়া সবাইকে নিরাপদে নামিয়ে দিতে প্রতিটি স্টেশনে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে কিছু সময় বেশি থামানো হবে। ফলে সময় মেনে চলা কঠিন হবে। তবে কোনো দুর্ঘটনা না হলে সময়সূচিতে বড় ধরনের বিপর্যয় হবে না। আমরা চেষ্টা করেছি দ্রুত ঢাকা থেকে ট্রেনগুলোকে ছেড়ে দিতে।

সদরঘাট লোকে-লোকারণ্য
রাজধানীর সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল হয়ে নৌপথে দক্ষিণাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় লঞ্চ চলাচল করে। ঈদকে সামনে রেখে বাড়ি ফেরা মানুষের উপচে পড়া ভিড়ে ভোগান্তিতে পড়েছে যাত্রীরা। টার্মিনাল যেন লোকে-লোকারণ্য হয়ে গেছে। গত বৃহস্পতিবার ও গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত রাজধানীর সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল ঘুরে ঈদে বাড়ি ফিরা যাত্রীদের ভিড়াভিড়ের এসব দুর্ভোগ দেখা যায়। হাজার হাজার মানুষ পরিবারের সঙ্গে ঈদ করতে গ্রামে ছুটছেন। বরিশালগামী লঞ্চের যাত্রা মো. শরীফ উদ্দিন দুই কাঁধে দুই ব্যাগ, সঙ্গে রয়েছে ২ বছরের কন্যা ও স্ত্রী মোছা. সালমা বেগম। যাত্রা পথে তিনি বলেন, করোনার কারণে গত ২ বছর ঢাকায় ঈদ করেছি। এবার ঈদে বাড়ি যাচ্ছি। ঈদ যাত্রায় এখনো কোনো ধরনের বাড়তি ভাড়া কিংবা সমস্যার কথা শুনিনি। তবে অতিরিক্ত যাত্রীর চাপ থাকায় বেশ কিছুটা দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে পরিবার-পরিজন নিয়ে।

ভোলার হাতিয়ার বাসিন্দা শহিদুল ইসলাম বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে লঞ্চে উঠেন। তিনি একা থাকায় তেমন ঝামেলা হয়নি। তবে তিনি অভিযোগ করে বলেন, ভাড়া তো কম নিচ্ছে না লঞ্চ মালিকরা; তাহলে অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন করবে কেন? ঈদ যাত্রায় শুধু শুধু আমাদের ভোগান্তি বাড়িয়ে জীবনকে হুমকিতে পেলে লঞ্চ মালিকরা। কয়েকজন যাত্রী জানান, কোনো কোনো লঞ্চে ভাড়া বেশি নিলেও অনেক লঞ্চে নির্ধারিত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। তবে ধারণ ক্ষমতার চেয়ে দ্বিগুন যাত্রী নেয়ায় ভেতরে বসা এবং চলাফেরার অসুবিধা হচ্ছে।

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, সরকারি-বেসরকারি অফিস ছুটির পরপরেই ঈদে ঘরে ফেরা ঘরমুখি মানুষের ঢল নেমেছে রাজধানীর সদরঘাটে। সবগুলো রুটের লঞ্চে একই চিত্র দেখা গেছে। বাড়তি ভাড়া এবং দুর্ভোগের জন্য যাত্রীরা ছুটির প্রথম দিন ও সপ্তাহের শেষ কর্মদিবস হওয়াতে এ যাত্রীর চাপ বেড়েছে জানান লঞ্চ মালিকরা। গত দুই ঈদের পর এবারে একটু বেশি যাত্রী পেয়ে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন।

লঞ্চ মালিকরা আরো জানান, সব ধরনের সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ছুটি হওয়ায় ঈদের ছুটির লঞ্চ যাত্রার তৃতীয় দিনে মানুষের ঢল নেমেছে। বাড়তি সতর্কতা হিসাবে আমরা নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের নিয়ম অনুসরণ করে জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যসহ যাবতীয় সকল নিয়মকানুন মেনে যাত্রীদের টিকিট দিচ্ছি।
এছাড়াও যাত্রী সচেতনতায় নৌপুলিশের পক্ষ থেকে লঞ্চ টার্মিনালে লিফলেট বিতরণ করতে দেখা গেছে।
লঞ্চে অতিরিক্ত যাত্রী চাপসহ সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিএর নৌ-নিরাপত্তা ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের যুগ্ম-পরিচালক শেখ মো. সেলিম রেজা বলেন, ঈদের ছুটিতে বাড়তি যাত্রী চাপ রয়েছে। ঘাটে আমাদের টহল টিমসহ নৌ পুলিশের কর্মকর্তারা কাজ করছে।

শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌরুটে জনস্রোত
মো. শওকত হোসেন, লৌহজং (মুন্সীগঞ্জ) থেকে জানান, ঈদে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার জন্য মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া নৌরুটে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ঘরমুখো লাখো মানুষের ভিড় ও ৫ শতাধিক যানবাহনের চাপ দেখা গেছে। ভোর থেকে শিমুলিয়া ফেরিঘাট এলাকায় জনস্রোতের পরিনত হয়। অতিরিক্ত যাত্রী ও মোটরসাইকেলের চাপে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে শিমুলিয়া ফেরি ঘাট এলাকা। গতকাল ভোর রাত সাহরীর পর থেকেই রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছোট-বড় যানবাহনে ও মোটরসাইকেলে চড়ে যাত্রীরা শিমুলিয়া ঘাটে এসে উপস্থিত হতে শুরু করেন। অতিরিক্ত চাপে প্রচণ্ড গরমে ঘাট এলাকায় চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন যাত্রীরা।

গতকাল সকাল থেকেই দেশের বিভিন স্থান থেকে প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস মোটরসাইকেল, পিকআপে করে ভেঙে ভেঙে পায়ে হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছাতে শিমুলিয়া ঘাট এলাকায় এসে জড়ো হয় যাত্রীরা। এ সময় ঘাট এলাকায় পারাপারের জন্য প্রায় পাঁচ শতাধিক যানবাহন ও দুই শতাধিক মোটরসাইকেলকে অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। সরেজমিনে ফেরিগুলোতে প্রাইভেটকারের তুলনায় অতিরিক্ত যাত্রী ও মোটরসাইকেল নিয়ে পদ্মা নদী পার হতে দেখা গেছে।

এদিকে শিমুলিয়া ঘাট থেকে শ্রীনগর উপজেলার দোগাছি পর্যন্ত রাস্তায় দীর্ঘ গাড়ির লাইন লক্ষ্য করা গেছে। বিআইডব্লিউটিসি শিমুলিয়া সূত্র জানায়, এগুলো বাসের সারি। বাস ফেরিতে পারাপার করা হচ্ছে না। এতএব, মহাসড়ক থেকে বাসগুলো যাত্রী নিয়ে ফিরে যাবে। যার প্রভাব ঘাটে পরবে না। যাত্রীরা বিভিন্ন ছোট-বড় যানবাহন, পিকআপ ও মোটরসাইকেল করে অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে এবং হেঁটে শিমুলিয়াঘাটে আসছে, পরিবহনে অতিরিক্ত চাপে রাস্তায় রাস্তায় ভোগান্তির শিকার হচ্ছে বলে জানা গেছে।

শিমুলিয়া ঘাটে সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য তারা কাজ করে যাচ্ছে। গাড়িগুলোকে ফেরির প্লাটুন থেকে দূরে আটকে দিচ্ছে। ফেরি আসার পরই শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে গাড়িগুলোকে ফেরিতে উঠতে দিচ্ছে। শিমুলিয়া নৌরুটে ১৫৩টি স্পিডবোট ও ৮৫টি লঞ্চ চলাচল করছে। ফেরির সংখ্যা কম থাকায় লঞ্চেই বেশি সংখ্যক যাত্রীপার হতে দেখা গেছে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্পোরেশন বিআইডব্লিউটিসির শিমুলিয়া ঘাটের ব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) মো. ফয়সাল বলেন, চার শতাধিক যানবাহন ও কয়েক শতাধিক মোটরসাইকেল ফেরি পারাপারে অপেক্ষায় আছে। নৌরুটে মোট ১০টি ফেরি পারাপারে কাজ করছে। বিআইডব্লিউটিএ শিমুলিয়া ঘাটের নৌনিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহকারী পরিচালক মো. শাহাদাত হোসেন বলেন, ফেরিঘাটে যানবাহনের পাশাপাশি মানুষের সংখ্যাও বেড়েছে। ভোর থেকে ১৫৩টি স্পিডবোট ও ৮৫টি লঞ্চ চলাচল করছে।

দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে ঠাঁই নেই
মোজাম্মেল হক, গোয়ালন্দ (রাজবাড়ী) উপজেলা থেকে জানান, ঈদ উপলক্ষ্যে দক্ষিণ বঙ্গের প্রবেশদ্বারখ্যাত দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে চোখে পড়ার মতো ছিল ঘরমুখো মানুষের উপচে পড়া ভিড়।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, পাটুরিয়া ঘাট থেকে ছেড়ে আসা প্রতিটি ফেরিতে রয়েছে ঘরমুখো মানুষের উপচে পড়া ভিড়। তারপরও চোখে পড়ামত ছিল ব্যক্তিগত মোটরসাইকেল এর ভিড়।
দৌলতদিয়া ঘাটের পন্টুনে ফেরি ভেড়ার সাথে সাথে অঘোষিত প্রতিযোগিতা নিয়ে নামছে শত শত রাজধানী ফেরত মানুষ। বিশেষ করে এই গরমে শিশুসহ মহিলাদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। এদিকে দৌলতদিয়া ফেরিঘাটের জিরো পয়েন্ট হতে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে প্রায় ৪ কিলোমিটারজুড়ে গণপরিবহনের দীর্ঘ সারির সৃষ্টি হয়েছে। ঢাকা ফেরত যাত্রী সবুজ মিয়া বলেন, ভোর রাতে ঢাকা থেকে রওয়ানা হয়েছি। যাতে করে রোদের গরমে পড়তে না হয়। তারপরও পরিবারের সাথে ঈদ করার জন্য আগেভাগেই চলে যাচ্ছি। পরিবারের সাথে ঈদ করার মজাই অন্যরকম। যদিও গাড়ি ভাড়া একটু বেশি নিচ্ছেন গাড়ি চালকরা।

অপর যাত্রী রহিমা বলেন, আমরা পরিবারসহ ঢাকায় থাকি, পরিবারের সবার সাথে ঈদ করার জন্য গ্রামের বাড়ি মাগুরায় যাচ্ছি। যদিও এই গরমে ছোট বাচ্চাদের নিয়ে যাতায়াত করা কষ্টকর। তারপরও যেতে হচ্ছে ঈদের আনন্দ পরিবারের সাথে ভাগাভাগি করার জন্য।
বিআইডব্লিউটিসির ঘাট শাখার ব্যবস্থাপক মো. সিহাব উদ্দিন ইনকিলাবকে বলেন, এই ঈদে যানজটমুক্ত রাখতে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ফেরি বাড়ানো হয়েছে। এই নৌরুটে ছোট বড় ২১টি ফেরি চলাচল করছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ঈদযাত্রা

২৮ এপ্রিল, ২০২২
২৬ জুন, ২০২১

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ