Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আমরাও কি শ্রীলঙ্কা পরিস্থিতির মুখোমুখি?

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ৬ এপ্রিল, ২০২২, ১২:০২ এএম

দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা আজ চরম অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ও মানবিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন। ভেঙ্গে পড়া জাতীয় অর্থনীতি ও উৎপাদন ব্যবস্থা ও কর্মসংস্থানের নাজুক পরিস্থিতিতে ইউক্রেন যুদ্ধের উত্তাপে হঠাৎ করে জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ায় নিত্যপণ্যের সংকট ও দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়ায় সরকারের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ-অসন্তোষ গণবিস্ফোরণে পরিনত হয়েছে। খাদ্য, জ্বালানি তেল, বিদ্যুতের দাবিতে রাজপথে নেমে আসা মানুষকে দাবিয়ে রাখতে দেশজুড়ে ৩৬ ঘন্টার কার্ফিউ দিয়েও শেষরক্ষা হয়নি। অব্যাহত গণবিক্ষোভের মুখে গত রবিবার শ্রীলঙ্কা সরকারের অধিকাংশ মন্ত্রী গণপদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। ভারতীয় উপমহাদেশের দেশগুলোতে জিডিপি পার ক্যাপিটা, শিক্ষার হার এবং বাণিজ্যিক অবস্থানের দিক থেকে শ্রীলঙ্কা নি:সন্দেহে অগ্রগামী হিসেবে গণ্য ছিল। আশির দশকের শুরু থেকে সিকি শতাব্দী ব্যাপী দেশটির তামিল জনগোষ্ঠির একটি অংশের রাজনৈতিক ও রক্তক্ষয়ী বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতার মধ্যেও শ্রীলঙ্কার এই সামাজিক-অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা অব্যাহত ছিল। একবিংশ শতকের প্রথম দশকের শেষপ্রান্তে এসে চীনা সামরিক সহায়তায় বিচ্ছিন্নতাবাদী এলটিটিই গেরিলাদের পরাজিত করে একটি রাজনৈতিক সমঝোতা ও সমাধানের পথ প্রশ্বস্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে শ্রীলঙ্কার সামনে একটি নতুন অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার পথে এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। বিশেষত রাজা মাহিন্দার রাজাপাকসে শ্রীলঙ্কার ২৬ বছরের গৃহযুদ্ধের সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষত মুছে দিতে দক্ষিণ আফ্রিকার অনুকরণে একটি ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন গঠনের মধ্য দিয়ে নির্বিঘেœ সামনে এগিয়ে চলার সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করার বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু যে শ্রীলঙ্কা ২৬ বছরের গৃহযুদ্ধেও তার অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয়েছিল। গৃহযুদ্ধ যুগের অবসান ঘটিয়ে নতুন সম্ভাবনার দিগন্তে এগিয়ে যাওয়া শ্রীলঙ্কা সরকার বিদেশি অর্থায়নে গভীর সমুদ্রবন্দরসহ বেশকিছু মেগা উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। বৈদেশিক ঋণভারে জর্জরিত শ্রীলঙ্কা করোনাকালীন অর্থনৈতিক মন্দা এবং সরকারের মন্ত্রী এমপিদের দুর্ণীতির জালে আটকে সম্ভাবনার সব ক্ষেত্রসমুহ অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে এবং প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসেসহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রনালয় ও প্রতিষ্ঠানগুলো একটি পরিবার ও রাজনৈতিক পক্ষের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় এখন নানাবিধ সংকটের জন্য দেশের বিক্ষুব্ধ মানুষ এই পরিবারকেই দায়ী করছে।

শুধুমাত্র মার্চ মাসেই শ্রীলঙ্কায় খাদ্যসহ নিত্যপণ্যের মূল্য বেড়েছে শতকরা ৩০ ভাগের বেশি। বিদ্যুত উৎপাদনের জ্বালানি সংকটের কারণে দিন-রাতের বেশিরভাগ সময় দেশজুড়ে লোডশেডিং চলছে। দেশের হাসপাতালগুলোতে ওষুধ সরবরাহ ও চিকিৎসা সেবাও কার্যত বন্ধ হয়ে পড়েছে। সাধারণ মানুষের সাথে দেশের স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীও রাজপথে নেমে বিক্ষোভ করছে। ফেসবুক-ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কাগজ সরবরাহে ঘাটতি থাকায় দেশের প্রিন্ট মিডিয়ার প্রচারও সীমিত হয়ে পড়ার খরব বেরিয়েছে। পুলিশের পাশাপাশি রাজপথে আধা সামরিক ও সেনাবাহিনী নামিয়ে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করে, কার্ফিউ দিয়ে জনগণের বিক্ষোভ দমনের অপচেষ্টা ইতিমধ্যেই ব্যর্থ হয়েছে। থালা-বাটি হাতে রাজপথে নেমে আসা জনশ্রোতে মন্ত্রী পরিষদ সদস্যদের প্রায় সবাই গণপদত্যাগের পর করণীয় নির্ধারণে রাষ্ট্রপতির সাথে বৈঠকে বসেছেন রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা। তবে বিক্ষুব্ধ জনতা প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া, প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসের পদত্যাগের দাবিতে এখনো অনড় রয়েছে। সংকট নিরসনে একটি অন্তবর্তী সরকার গঠণের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার কথা শোনা যাচ্ছে। তবে দেশের বিরোধিদলীয় আইন প্রণেতা ও রাজনৈতিক নেতারা দেশে সামরিক শাসন জারির আশঙ্কার কথা বলেছেন। সে ধরণের কিছু হলে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষকে ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব নাও হতে পারে। বিরোধি রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা শ্রীলঙ্কায় বর্তমান অবস্থার জন্য রাজপাকসে পরিবারের কর্তৃত্ববাদী শাসনকেই দায়ী করছেন। শ্রীলঙ্কায় শিক্ষার হার শতকরা ৯০ ভাগের উপরে, যা উপমহাদেশে সর্বোচ্চ। এই সচেতন জনগণকে নির্বতনমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে দমিয়ে রাখা যে অসম্ভব, গত কয়েকদিনের গণবিক্ষোভে তা অনেকটাই স্পষ্ট হয়েছে। সোমবার শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গর্ভনরের পদত্যাগের পর প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ার পদত্যাগের দাবি আরো জোরালো হয়ে উঠার মধ্যেই প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে বিরোধি রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে একটি জাতীয় সরকার গঠনের আহŸান জানিয়েছেন।

গৃহযুদ্ধের সময় শ্রীলঙ্কার ম্যানুফকচারিং খাতে বিপর্যয়ের পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতায় মূলত পর্যটন ও সেবাখাত নির্ভর শ্রীলঙ্কা অর্থনীতি করোনাকাল থেকে পর পর দুই বছর চরম মন্দার কারণে যে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে তা মোকাবেলা করার পর্যাপ্ত বিকল্প ব্যবস্থা বা রক্ষা কবচ সে দেশের সরকারের হাতে ছিল না। শ্রীলঙ্কার এ অবস্থার জন্য তাদের স্বপ্ন বিলাসি মেগা প্রকল্পগুলোকে অনেকে ‘ধার করে ঘি খাওয়া’ বলে টিপ্পনী কাটছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশও হাজার হাজার ডলারের বৈদেশিক ঋণে বেশকিছু মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। গত একদশকে দেশের মানুষের উপর বৈদেশিক ঋণের বোঝা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। পদ্মাসেতু, রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুত প্রকল্প, পদ্মারেল সংযোগ, ঢাকা এমআরটি, মেট্টোরেলসহ যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের দীর্ঘসূত্রিতা, অস্বাভাবিক ব্যয়বাহুল্য এবং লগ্নিকৃত বিনিয়োগ যথাসয়ে ফেরত আসা নিয়ে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। কয়েকদিন আগে ঢাকায় একটি প্রাক-বাজেট আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে দেশের একজন শীর্ষ অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর দেশের মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে কিছু কিছু আপাতত অপ্রয়োজনীয়-অলাভজনক মেগাপ্রকল্পের লগ্নি ফেরত আসা নিয়ে এমন সংশয় প্রকাশ করেছেন। তিনি এ প্রসঙ্গে শ্রীলঙ্কার পরিনতির কথা স্মরণ করিয়ে দেন। যেসব কারণে শ্রীলঙ্কায় বর্তমান অর্থনৈতিক সঙ্কট তৈরী হয়েছে, তিন-চার বছর আগেও সেখানকার অর্থনৈতিক সঙ্কট এমন প্রকট ছিল না। রাষ্ট্র ও জনগণের অর্থনৈতিক সংকট, নিত্যপণ্যের মাত্রাহীন মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি রাজাপাকসে পরিবারের ব্যাপক দুর্নীতি ও কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভ একটি দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক-রাজনৈতিক মিথস্ক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। আহসান এইচ মুনসুর সাহেব মেগা প্রকল্পগুলোর উচ্চব্যয় ও এর রিটার্ণ নিয়ে সংশয় থেকে যে আশঙ্কার কথা বলেছেন, বাংলাদেশের অবস্থা আদতে আরো অনেক বেশি খারাপ। শ্রীলঙ্কায় সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দমনে জরুরী অবস্থা ঘোষণা, কার্ফিউ জারি এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অ্যাকসেস সীমিত করা হলেও বিক্ষোভ দমনে জনগণের উপর লাঠি-গুলি-টিয়ারগ্যাস বা সরকারি দলের পেটোয়া বাহিনী লেলিয়ে দেয়ার অভিযোগ উঠেনি। গত একযুগে বাংলাদেশে এমন বেশকিছু গণদাবী সামনে রেখে দেশের ছাত্র সমাজসহ সাধারণ মানুষ রাজপথে নেমে আসার পর সেসব গণবিক্ষোভ-গণদাবি যেভাবে দমন করা হয়েছে, শ্রীলঙ্কায় তার সিকিভাগও হয়নি।

করোনাকালে বাংলাদেশে কোটি কোটি মানুষের আয় কমলেও দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে সাড়ে ৩ হাজারের বেশি নতুন কোটিপতির নাম যুক্ত হয়েছে। অর্থাৎ কোটি কোটি মানুষের মধ্যবিত্ত অবস্থান থেকে নি¤œবিত্ত শ্রেণীতে অবনতি ঘটলেও আরেকটি শ্রেণী সাধারণ মধ্যবিত্ত অবস্থা থেকে উচ্চবিত্ত শ্রেণীতে পরিনত হয়েছে। গত দুই দশকে দেশ থেকে প্রায় ১০ লক্ষকোটি টাকা পাচার হয়েছে। এর শতকরা ৭০ ভাগ টাকা পাচার হয়েছে গত এক দশকে। সাধারণ মানুষের আয় কমে গেলেও পরিসংখ্যানের হিসেবে প্রবৃদ্ধির অংক কিন্তু সে তথ্য দেয় না। এভাবেই একদিকে সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি অন্যদিকে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ার মধ্যে নিত্য পণ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়ে দরিদ্র মানুষের জীবন যাত্রা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে। সেই সাথে বিচারহীনতার সংস্কৃতি, রাজনৈতিক দমনপীড়ন, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো অকার্যকর হয়ে পড়া, সরকারি প্রশাসন, আমলাতন্ত্র, বিচারব্যবস্থায় রাজনৈতিক পক্ষপাত ও দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ার কারণে সামাজিক ন্যায়বিচার চরমভাবে বাঁধাগ্রস্ত হওয়ার নজির সৃষ্টি হয়েছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গুম-খুনের অভিযোগ, হাজার হাজার রাজনৈতিক মামলায় বিরোধিদলের কয়েক মিলিয়ন কর্মীকে হয়রানির শিকারে পরিনত করা হয়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতি শ্রীলঙ্কায় হয়নি। মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে আমাদের পুলিশ ও র‌্যাবের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের নিষেধাজ্ঞা সেই সত্যকেই বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছে। ক্ষমতাসীনদের দ্বারা দেশে গণতন্ত্র বাঁধাগ্রস্ত হয়েছে, আইনের শাসন বাঁধাগ্রস্ত হয়েছে, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে। সিন্ডিকেটেড কারসাজি ও দুর্নীতির কারণে দেশের কৃষকরা বাম্পার ফসল উৎপাদন করেও ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় লাভসহ বিনিয়োগ ঘরে তুলতে পারেনা কৃষকরা। গত এক দশকে বিদ্যুত খাতের ঘাটতি পুরণ ও উন্নয়নে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। বিদ্যুতের জরুরি প্রয়োজন মেটাতে রেন্টাল-কুইকরেন্টাল বিদ্যুতকেন্দ্র থেকে অস্বাভাবিক উচ্চমূল্যে বিদ্যুত কিনে জনগণের রাজস্বের টাকা থেকে প্রতিবছর কয়েক বিলিয়ন ডলারের ভর্তুকি দিয়েছে সরকার। লক্ষ লক্ষকোটি ভর্তুকির টাকায় কেনা বিদ্যুতে এখনো সাধারণ মানুষের চাহিদা পুরণ করতে পারছেনা বিদ্যুত বিভাগ। এখনো খোদ রাজধানী শহরে দিনে কয়েকবার লোডশেডিং পোহাতে হচ্ছে। এই রমজান মাসেও ঢাকার অধিকাংশ এলাকায় গ্যাসের চাপ না থাকায় ধর্মপ্রাণ-রোজাদার মানুষকে অশেষ দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। আর প্রতিদিন টিসিবি’র ট্রাকগুলোর পেছনে মানুষের ভীড় বেড়েই চলেছে। বিনামূল্যে নয়, ন্যায্যমূল্যে পন্য কিনতে একেকটি টাকের পেছনে ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে শত শত মানুষের পন্য কেনার প্রানান্ত চেষ্টা থেকেই বুঝা যায়, সাধারণ মানুষ এখন কতটা দুর্বিসহ সময় পার করছে।

একদিকে অস্বাভাবিক উচ্চ খরচের মেগা প্রকল্পে চীন-রাশিয়ার হাজার হাজার কোটি ডলারের বিনিয়োগ, অন্যদিকে দেশের রাষ্ট্রীয় বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের উপর পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞার চাপে বাংলাদেশ নিয়ে একটি ভূ-রাজনৈতিক রশিটানাটানি চলছে। আমরা শ্রীলঙ্কা দেখছি, ইউক্রেন দেখছি, মিয়ানমারও দেখছি। পাকিস্তানে ক্ষমতার পরিবর্তনে পশ্চিমাদের গোপন কারসাজির ঘটনা ইতিমধ্যে ফাঁস হয়ে গেছে। প্রায় ধসে পড়া একটি অর্থনীতিকে চীন-রাশিয়ার সহায়তায় শক্ত ভিত্তি দিতে সাফল্যের কাছাকাছি না পৌঁছলেও পতন ঠেকাতে সক্ষম হয়েছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। এখন রিজিম চেঞ্জ করে সেখানে আবারো সেনাশাসন কায়েমের পুরনো খেলায় মেতে উঠেছে দেশি-বিদেশি কুশীলবরা। পাকিস্তানে সংসদীয় গণতন্ত্র বহাল থাকলেও দেশটির ইতিহাসে কোনো সরকারই তার মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেনি। অঘটন-অপমৃত্যুর মধ্য দিয়ে মাঝপথেই বিদায় নিতে হয় প্রতিটি নির্বাচিত সরকারকে। করোনাকালীন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে ক্ষমতায় এসে দেশটিকে অর্থনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষ্য সামনে রেখে প্রাথমিক স্তরে সফল হলেও তিনি এখন পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদীদের ভূ-রাজনৈতিক দাবাখেলার শিকারে পরিনত হয়েছেন। ইমরান খানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক একটি ডিপ্লোম্যাটিক চিঠি তিনি নিজেই ফাঁস করতে বাধ্য হয়েছেন। পার্লামেন্টে আস্থাভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রাখতে ব্যর্থ হওয়ার পর অভিশংসনের মুখে প্রেসিডেন্ট পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দিয়ে শেষরক্ষা করেছেন। এখন ৯০ দিনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে পাকিস্তানে ক্ষমতার পালাবদলের সম্ভাবনা তৈরী হয়েছে। জনরোষের মুখে শ্রীলঙ্কার মন্ত্রী পরিষদের ২৬ সদস্য পদত্যাগের পর প্রেসিডেন্ট জাতীয় সরকারের প্রস্তাব দিয়েছেন। পাকিস্তানেও বিরোধিদলগুলোর ডাকে পার্লামেন্টের ভিতরে-বাহিরে আন্দোলনের ঢেউয়ে প্রেসিডেন্ট পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দিতে বাধ্য হয়েছেন। পক্ষান্তরে গণতন্ত্রের মানদন্ডে বাংলাদেশের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। আন্তর্জাতিক জরিপে গত একযুগ ধরে এখানে হাইব্রিড রিজিমের শাসন চলছে। শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তানের জনগণ সরকারের বিরুদ্ধে রাজপথে নামতে পারলেও কর্তৃত্ববাদী শাসনের কারণে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষ তা পারছে না। প্রধান বিরোধিদলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা থেকে শুরু করে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের পর্যন্ত গুম-খুন, হামলা-মামলার শিকারে পরিনত করে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রতিরোধের পথ রুদ্ধ করা হয়েছে।
একদিকে পদ্মাসেতুসহ মেগাপ্রকল্প দেখিয়ে উন্নয়নের জিকির চলছে, অন্যদিকে কোটি মানুষের বেকারত্ব-কর্মহীনতা, কৃষকের বঞ্চনা, মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে সাধারণ মানুষের খেয়েপরে বেঁচে থাকা ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে। নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার চরমভাবে ব্যর্থ হচ্ছে। রমজান মাস শুরু হওয়ার তিনদিন আগেও যেখানে এককেজি শসার দাম ছিল ৩০-৪০ টাকা, রমজানের শুরুতে তা ৮০-১০০ টাকায় উঠে যাওয়ায় দরিদ্র মানুষের জন্য ইফতারিতে শশা কিনে খাওয়াও অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ভারত থেকে বিপুল পরিমান পেঁয়াজ আমদানি করে ভারতীয় কৃষকদের বাঁচানো গেলেও দেশীয় পেঁয়াজ চাষীদের মূল্য বঞ্চিত করে নি:স্ব করে ফেলা হচ্ছে। দেশে উৎপাদিত মাছ, গরুর গোশত, মুরগী এবং বাম্পার ফলনের পরও বেগুন, টমাটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি, লাউ, মিস্টি কুমড়া, গাজর ও লেবুর ন্যায্য দাম থেকে কৃষক বঞ্চিত হলেও খুচরা বাজারে রাতারাতি দুতিন গুণ দাম বাড়িয়ে দরিদ্র মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে ঠেলে দিয়ে তাদেরকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। কৃষক এবং ভোক্তা পর্যায়ে মূল্যের মাঝখানে যে বিশাল ব্যবধান, সেখানে রয়েছে একটি সিন্ডিকেটেড মধ্যস্বত্বভোগী। এরা পাইকারি ব্যবসায়ী, হাইওয়ের চাঁদাবাজ, ঘাটের ইজারাদার, কারওয়ান বাজার-শ্যামবাজারের আড়তদার, খাতুনগঞ্জ, নিতাইগঞ্জ- সওয়ারিঘাটের ব্যবসার নিয়ন্ত্রক। এদের সিন্ডিকেটেড কারসাজিতে তিরিশ টাকা কেজির পেঁয়াজ একসপ্তাহে আশি টাকায় উঠে যায়। আশি টাকার সয়াবিন তেল দুইশ টাকায় কিনতে বাধ্য হয় দরিদ্র মানুষ। নানা কারণে কখনো কখনো খাদ্যশস্যের সংকট হতেই পারে। তবে দেশে দুর্ভীক্ষ দেখা দেয় খাদ্য বা সম্পদের অভাবের কারণে নয়, সম্পদের সুষম বন্টন এবং মানুষের ক্রয়ক্ষমতায় বৈষম্যের কারণে। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে বিদেশ থেকে মিলিয়ন টন খাদ্য সহায়তার পরও দুর্ভীক্ষে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর পেছনের কারণ ছিল উচ্চ মুনাফার জন্য মজুদদারির কারণে দরিদ্র মানুষ খাদ্যপণ্য সংগ্রহ করতে না পারা। শ্রীলঙ্কায় এখন যে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে তার পেছনে রয়েছে অপরিনামদর্শি মেগা প্রকল্পের পেছনে বিপুল অর্থব্যয়, বৈদেশিক ঋণের বোঝা এবং রেমিটেন্স আয়ে হঠাৎ ধস নেমে যাওয়া। ডলারের রিজার্ভ শেষ হয়ে যাওয়ায় হঠাৎ বেড়ে যাওয়া উচ্চমূল্যে পেট্রোলিয়াম কিনতে না পারায় বিদ্যুৎ উৎপাদন, কৃষি উৎপাদন থেকে শুরু করে পণ্য পরিবহন পর্যন্ত সর্বত্র বিরূপ প্রভাব পড়েছে। আর এই দুর্গতির জন্য জনগণ রাজাপাকসে পরিবারের কর্তৃত্ববাদী শাসনকেই দায়ী করছে দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষ। আন্তর্জাতিক প্রতিটি র‌্যাংকিংয়ে বাংলাদেশ এখন তলানিতে অবস্থান করছে। আমাদের শহরগুলোর বাসযোগ্যতা, বায়ুর মান, পানি দূষণ, শব্দ দূষণ, খাদ্যের ভেজাল, কৃষকের বঞ্চনা, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা, অপুষ্টি-অসুস্থতার মহামারীর মধ্যেও মানুষ কেবল উন্নয়নের আওয়াজ শুনছে। ঢাকা ওয়াসা শহরের বেশিরভাগ এলাকায় দূষিত পানি সরবরাহ করায় প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ ডায়রিয়া-কলেরায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী প্রকৃতিভিত্তিক উন্নয়ন দর্শনের কথা বলেছেন। খুবই সময়োপযোগী কথামালা। তার আগে লুন্ঠন, দুর্নীতি, মূল্যসন্ত্রাস ও অর্থপাচারের মত অর্থনৈতিক ক্যান্সারের বিরুদ্ধে সার্জারি অপারেশন করতে হবে। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অধিকার অবারিত হওয়া ছাড়া মানবাধিকার লঙ্ঘন ও জবাবদিহিতামূলক সুশাসন নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।

[email protected]



 

Show all comments
  • jack ali ৬ এপ্রিল, ২০২২, ১২:০৯ পিএম says : 0
    আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী ও তাদের চামচাদের কত বড় সাহস তারা সবসময় বলে দেশে কোনো গরিব লোক নাই আমাদের দেশ নাকি সিঙ্গাপুর এবং ক্যানাডা থেকেও উন্নত আসলে তাদের কথা সত্যি কেননা তারা তো গরিব না তারা তো আমাদের দেশের রক্তের টাকা লুটপাট করে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক সেই জন্যই তারা গায়ের জোরে বলে দেশে কোনো গরিব লোক নাই আল্লাহ আপনাদেরকে ছাড় দিবেনা যখন মৃত্যু সামনে আসবে তখন বুঝতে পারবেন কোথায় যাবেন
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: শ্রীলঙ্কা


আরও
আরও পড়ুন