Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মিল্কী হত্যার প্রতিশোধ নিতেই টিপুকে হত্যা

গুলির পর মেসেজ দেয়া হয় ‘ইট ইজ ডান’ পরিকল্পনায় আওয়ামী লীগ নেতা : দুবাই বসে হত্যার ছক কষে মুসা : দল থেকে ওমর ফারুক বহিস্কার : চারজনকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব

বিশেষ সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ৩ এপ্রিল, ২০২২, ১২:০১ এএম

যুবলীগ নেতা রিয়াজুল হক খান মিল্কী হত্যার প্রতিশোধ, মতিঝিল এলাকার চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজির নিয়ন্ত্রণ নিতেই আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপুকে হত্যা করা হয়েছে। হত্যার পরিকল্পনা করেন মতিঝিলের ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা ওমর ফারুক। আর দুবাই বসে হত্যার মিশন বাস্তবায়ন করেন আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসী মুসা। হত্যার মিশন বাস্তবায়নে কিলারদের সঙ্গে ১৫ লাখ টাকায় চুক্তি করেন তিনি। গত শুক্রবার টিপুর হত্যার অন্যতম পরিকল্পনাকারী এবং তাকে অনুসরণকারীসহ ৪ জনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। তাদের কাছ থেকে হত্যাকাণ্ডে নজরদারির কাজে ব্যবহৃত মোটরসাইকেল এবং চুক্তির ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা ও মোবাইলসহ অন্যান্য সামগ্রী উদ্ধার করা হয়। গতকাল শনিবার কারওয়ান বাজার র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব সদর দপ্তরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এসব তথ্য জানান।

সংবাদ সম্মেলনে আরো বলা হয়েছে, টিপুকে গুলির পর আসামিরা একজন আরেকজনকে মেসেজ দেন ‘ইট ইজ ডান’। রমনা ও মিরপুরসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেপ্তারকৃত ওমর ফারুক মতিঝিল ১০ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। গ্রেপ্তার বাকি তিনজন হলেন-আবু সালেহ শিকদার ওরফে শুটার সালেহ (৩৮), নাসির উদ্দিন ওরফে কিলার নাসির (৩৮) ও মোরশেদুল আলম ওরফে কাইল্যা পলাশ (৫১)। বছরের পর বছর ধরে টিপুর সঙ্গে গ্রেপ্তার ব্যক্তিসহ মতিঝিলকেন্দ্রিক রাজনীতিবিদ ও আন্ডারওয়ার্ল্ডের অপরাধীদের দ্বন্দ্ব ছিল। মতিঝিল এলাকায় চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, স্কুল-কলেজের ভর্তি বাণিজ্য ও কাঁচাবাজারসহ বিভিন্ন বাজারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এসব দ্বন্দ্ব ছিল।

তিনি আরো বলেন, দুবাই যাওয়ার আগে পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে যান মুসা, হুন্ডির মাধ্যমে আরও চার লাখ টাকা মুসাকে দেয়া হয়। বাকি ছয় লাখ টাকা দেশে হস্তান্তর করার চুক্তি হয়। ছয় লাখের মধ্যে র‌্যাব গ্রেফতারের সময় তিন লাখ ৩০ হাজার টাকা জব্দ করে। দুবাই থাকা মুসা ২০১৬ সালে রিজভী হাসান হত্যাকাণ্ডের চার্জশিটভুক্ত ৩ নম্বর আসামি। গ্র্রেফতারকৃতদের বরাতে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, হত্যাকাণ্ডটি দেশে ঘটলেও নিয়ন্ত্রণ করা হয় দুবাই থেকে। দেশে থাকা নাছির উদ্দিন ওরফে কিলার নাছির, মোরশেদুল আলম ওরফে কাইল্লা পলাশসহ আরও কয়েকজন জাহিদুল ইসলাম টিপুর অবস্থান সম্পর্কে বেশ কয়েকদিন ধরে মুসার কাছে তথ্য প্রেরণ করতেন। ঘটনার দিন সন্ধ্যার পর গ্রেফতার নাছির উদ্দিন ওরফে কিলার নাছির চারবার টিপুর অবস্থান সম্পর্কে মুসাকে অবহিত করেন। পরে টিপু গ্রান্ড সুলতান রেস্টুরেন্ট থেকে বের হওয়ার সময় গ্রেফতার মোরশেদুল আলম ওরফে কাইল্লা পলাশ তাকে নজরদারিতে রাখেন এবং তার অবস্থান সম্পর্কে ফ্রিডম মানিককে অবহিত করেন। টিপুর অবস্থান সম্পর্কে জানানোর পরিপ্রেক্ষিতে রাত সাড়ে ১০টার দিকে আন্ডার ওয়ার্ল্ডের তত্ত্বাবধানে কিলার কর্তৃক হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়।

তিনি বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা যায়, গ্রেফতার ওমর ফারুকের সঙ্গে হত্যাকাণ্ডের জন্য ১৫ লাখ টাকার চুক্তি হয়। ওই ১৫ লাখ টাকা রিজভী হাসান হত্যাকাণ্ডে জড়িত আসামিদের মধ্যে ওমর ফারুক ৯ লাখ এবং অবশিষ্ট টাকা নাছির উদ্দিন ওরফে কিলার নাছির, আবু সালেহ শিকদার ওরফে শুটার সালেহ ও মুসা দেন।
ডিবির হাতে গ্রেফতার শুটার মাসুম ও দামালের এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ততার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, হত্যাকাণ্ডটি কাটআউট পদ্ধতিতে করা হয়। যেখানে গ্রেফতার নাছির ও ওমর ফারুকের কাছে পরিকল্পনার তথ্য রয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা মুসাকে দায়িত্ব দিয়েছেন। মুসা সমন্বয়কারী হিসেবে আন্ডার ওয়ার্ল্ডের সন্ত্রাসীদের সঙ্গে সমন্বয় করেছে ও কিলার নিয়োগ করে। যেহেতু আমরা মুসাকে গ্রেফতার করতে পারিনি এবং তিনি দুবাই চলে গেছেন, তাই কাকে তিনি আন্ডারওয়ার্ল্ডের মাধ্যমে শ্যুটার নিয়োগ করেছিলেন সেটা মুসাকে গ্রেফতারের পর জানা যাবে। গ্রেফতার নাছির, ওমর ফারুক ও সালেহর কাছ থেকে আমরা কোনো শ্যুটার বা কিলারের নাম পাইনি।

দুবাইয়ে অবস্থানরত আন্ডারওয়ার্ল্ডের এই সন্ত্রাসী কে জানতে চাইলে র‌্যাবের এ কর্মকর্তা বলেন, এখানে আমরা বিভিন্নভাবে বিভিন্ন সন্ত্রাসীর নাম পেয়েছি। আমরা মুসার অবস্থান পেয়েছি দুবাইতে। সেখানে তিনি আন্ডারওয়ার্ল্ডের এক শীর্ষ সন্ত্রাসীর তত্ত্বাবধানে রয়েছেন। একইভাবে কাইল্লা পলাশ একজন শীর্ষ সন্ত্রাসীকে এই হত্যাকাণ্ডের তথ্য দিচ্ছিলেন, যার অবস্থান পার্শ্ববর্তী একটি দেশে। আবার মুসা এর আগে কিলিংমিশনে একজন কিলার নিয়েছিলেন, সেখানে আন্ডারওয়ার্ল্ডের একজন সন্ত্রাসীর নাম আমরা পেয়েছি, তার অবস্থান আমরা পাচ্ছি ফ্রান্সে। এখন তথ্যপ্রযুক্তির যুগে এ দেশে অবস্থান করে ভিপিএনের মাধ্যমে আরেক দেশের নম্বর দিয়ে কল করা যায়। এখন এই ঘটনায় আন্ডারওয়ার্ল্ডের সন্ত্রাসীদের নাম ব্যবহার করা হয়েছে, নাকি তারা সরাসরি জড়িত সেটি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। শুধু আন্ডারওয়ার্ল্ডের সন্ত্রাসী নয়, আন্ডারগ্রাউন্ডের কিছু সন্ত্রাসীর নামও আমরা পেয়েছি। যাদের অনেককেই আমরা গ্রেফতার করেছি। তাদেরও এই হত্যাকাণ্ডে সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে। কোনোকিছুই আমরা উড়িয়ে দিচ্ছি না। সে বিষয়েও তদন্ত চলমান।

আরেক প্রশ্নের জবাবে কমান্ডার মঈন বলেন, গ্রেফতার নাছির জানিয়েছেন মুসার সঙ্গে তার নিয়মিত যোগাযোগ হয়েছিল। কীভাবে এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হবে, সেটি মুসা নাছিরকেই জানিয়েছিলেন। নাছির আরও জানিয়েছেন, পরিকল্পনায় কিলারের পাশাপাশি ব্যাকআপ প্ল্যানও ছিল। এ কথা মুসাই তাদের জানিয়েছেন। যখন হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়, তখন নাছির ঘটনাস্থলের কাছাকাছি ছিলেন। তিনি মুসাকে জানিয়েছেন ‘ইট ইজ ডান’। এতে মুসার আর ব্যাকআপ প্ল্যানের প্রয়োজন হয়নি।

মুসাকে দুবাই থেকে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মুসার অবস্থান শনাক্ত করার বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মাধ্যমে শেয়ার করা হচ্ছে। দুবাইতে তিনি কোথায় কী অবস্থায় আছেন সে সম্পর্কে কিছু তথ্য আমরা পেয়েছি। সেসব তথ্য পুলিশ সদরদপ্তরের মাধ্যমে যেসব সংস্থাকে দেয়া প্রয়োজন ও যে মাধ্যমে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব সেসব কার্যক্রম নেয়া হচ্ছে। কারণ তাকে না পাওয়া গেলে টিপু হত্যার পুরো পরিকল্পনা সম্পর্কে জানা কঠিন।

হত্যাকাণ্ডের আরেকটি উদ্দেশ্য সম্পর্কে তিনি বলেন, গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের দলটি ২০১৬ সালে রিজভী হাসান ওরফে ‘বোঁচা বাবু’কে হত্যা করে। বাবু ছিলেন টিপুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী। বাবু হত্যা মামলায় পুলিশ গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে থেকে তিনজন ওমর ফারুক, আবু সালেহ শিকদার ও নাসির উদ্দিনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছে। সেই মামলাটি বর্তমানে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের রায়ের অপেক্ষায় আছে। সে মামলায় অভিযোগপত্রে থাকা ব্যক্তিরা মোরশেদুল আলম ওরফে কাইল্যা পলাশকে সুরতহাল সাক্ষী বানায় মামলার গতিপথ পাল্টানোর জন্য।

তিনি বলেন, বোঁচা বাবুর হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মামলা করেছিলেন তার বাবা আবুল কালাম। কিন্তু মামলার যাবতীয় খরচসহ সবকিছু দেখভাল করছিলেন জাহিদুল ইসলাম টিপু। আসামিরা ৫০ লাখ টাকা দিয়ে মামলার দফারফার জন্য টিপুকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু টিপু রাজি হননি। গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের দাবি, টিপুর কারণেই মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে গেছে এবং বিচার দ্রুত হচ্ছে। আসামিদের আশঙ্কা ছিল, এ মামলায় তাদের কারও ফাঁসি হবে। তাই মামলার স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত করতে প্রথমে মামলার বাদী আবুল কালামকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। পরে আসামিরা ভেবে দেখলেন, বাদীর পরিবর্তে টিপুকে হত্যা করলে মামলার কার্যক্রম ব্যাহত করা যাবে। গত ২৪ মার্চ রাত সোয়া ১০টার দিকে রাজধানীর শাহজাহানপুরে ইসলামী ব্যাংকের পাশে বাটার শোরুমের সামনে আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপুকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এসময় গাড়ির পাশে রিকশায় থাকা সামিয়া আফরান প্রীতি (১৯) নামে এক কলেজছাত্রীও নিহত হন। এছাড়া টিপুর গাড়িচালক মুন্না গুলিবিদ্ধ হন।

আওয়ামী লীগের নেতা জাহিদুল ইসলাম ওরফে টিপু হত্যাকাণ্ডের ঘটনার ‘অন্যতম পরিকল্পনাকারী’ ওমর ফারুককে মতিঝিল থানার অধীন ১০ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কমিটি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তিনি এই কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক রিয়াজ উদ্দিন রিয়াজ এ তথ্য জানান।

এর আগে টিপু হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে ওমর ফারুকসহ চার জনকে গ্রেফতার করার কথা জানায় র‌্যাব। চার আসামিই ২০১৩ সালে হত্যার শিকার যুবলীগ নেতা মিল্কী অনুসারী বলে জানিয়েছে র‌্যাব। রমনা ও মিরপুরসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে গতকাল চার জনকে গ্রেফতার করা হয়।
রিয়াজ উদ্দিন রিয়াজ বলেন, টিপু হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে র‌্যাব তাকে গ্রেফতার করেছে। সেখানে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। সে কারণে মহানগর আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়েছে। তার দায়ভার তো মহানগর আওয়ামী লীগ নিতে পারে না। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রের ৪৭ ধারায় তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: হত্যা


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ