চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
বিখ্যাত আইনবিদ Louts Henkin তাঁর ‘‘The International Bill of rights’’ গ্রন্থের ভূমিকাতে মন্তব্য করেছেন যে, ‘‘Human Rights is the idea of our time’’ অর্থাৎ মানবাধিকার হল বর্তমানকালের ধারণা। মানবাধিকার সম্পর্কে পশ্চিমা প্রায় সকল আইনবিদের বিশ্বাস এ রকমই। কিন্তু সাধারণভাবে অনুসৃত মানবাধিকার সম্পর্কিত এহেন ধারণা কতটুকু সত্য? মানবাধিকার কি আসলেই বর্তমানকালের ধারণা? ম্যাগনাকার্টা, ফরাসী বিপ্লব-এ সবের পথ ধরেই কি দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে মানবাধিকার সংক্রান্ত আইনের যথাযথ বিকাশ হয়? আন্তর্জাতিক বা সার্বজনীন মানবাধিকার সংক্রান্ত ধারণার ইতিহাসের সূচনা কেবল ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বরে? এর পূর্বে কি পৃথিবীর মানুষ সার্বজনীন মানবাধিকারের ধারণার সঙ্গে পরিচিতি লাভ করেনি? সমাজে, রাষ্ট্রে, আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে এর সফল বাস্তবায়ন প্রত্যক্ষ করেনি? এখন থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বে তমসায় নিমজ্জিত ধরণীতে আল-কুরআনের আলোকবর্তিকা, রহমতের বার্তা নিয়ে যিনি এই নশ্বর ধরাধামে এসে পৃথিবীকে আলোকিত করে গেছেন সেই রাহমাতুল্লিল আলামীন, সাইয়েদুল মুরছালিন, খাতামুন নাবীঈন, মানবমুক্তির দূত, যাঁকে উসিলা করে সবকিছু সৃষ্টি করা হয়েছে সেই মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কর্মময় জীবনের উপর যৎকিঞ্চিৎ আলোচনা করলে এমন সব তথ্য অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে আমাদের সামনে ভেসে উঠবে যাতে সকলেই বলতে বাধ্য হবেন যে, সার্বজনীন বা আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের ধারণা দিয়েছেন হযরত মুহাম্মদ (সা:), প্রতিটি পর্যায়ে সকলের জন্য মানবাধিকারকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন তিনিই, নিঃসন্দেহে তিনিই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানবদরদী, সার্বজনীন মানবাধিকার ধারণা বাস্তবরূপ পরিগ্রহ করেছিল তাঁর পবিত্র হাতেই। M.N. Roy বলেছেন, ‘‘Very few Moslems of our time are aware of the great role played by Islam in the play house of history’’ অর্থাৎ ইতিহাসের রঙ্গশালায় ইসলামের সুমহান অবদান সম্পর্কে আজকের খুব অল্পসংখ্যক মুসলমানই অবগত। যেখানে অধিকাংশ মুসলমানই বিশ্বসভ্যতায় তাদের ধর্ম ইসলাম এবং ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সুমহান অবদান সম্পর্কে ওয়াকেব হাল নয়, সেখানে পশ্চিমা জগতের ধারণা কেমন হবে তা বলাই বাহুল্য। পশ্চিমা আইনবিদরা হয় ইসলাম ও এর নবী সম্পর্কে অজ্ঞ, না হয় আদর্শিকভাবে তারা ইসলাম বিরোধী। আর এ জন্যই মানবাধিকার আইনকে আধুনিককালের বলে চালিয়ে দিয়ে তারা এক্ষেত্রে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর অবদানকে অস্বীকার করতে চাইছেন।
ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়। ইসলাম ধর্ম প্রথম স্পষ্ট সুনির্দিষ্ট আকারে সকল মৌলিক অধিকার তথা মানবাধিকার প্রদান করেছে। কিন্তু এ বক্তব্যের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ না করে যারা মানবাধিকার আইনকে বর্তমানকালের বলতে চান, তাদের বক্তব্যকে খন্ডন করার জন্য। সত্যের উদঘাটনের জন্য পাশ্চাত্যে মানবাধিকার আইনের উৎপত্তির উপর আলোকপাত করা জরুরী।
পাশ্চাত্য আইনবিদগণ মানবাধিকারকে বর্তমানকালের ধারণা বলে মনে করেন- এ কথা আমরা ইতোমধ্যেই উল্লেখ করেছি। তাদের বিশ্বাস মতে ১৯৪৫ সালে প্রণীত জাতিসংঘ সনদ হল প্রথম দলিল যেটা নাকি মানবাধিকারের ধারণাকে আন্তর্জাতিকরণ (Internationalised) করেছে যদিও এই সনদের কোথাও মানবাধিকার সমূহের উল্লেখমাত্র করা হয়নি। তারপর আসে ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর যে দিনটি বিশ্বমানবাধিকার দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। ১৯৪৮ সালের এ দিনে সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র তৈরী করা হয়। বিশ্বের মানুষ এখন এটিই স্বীকার করে যে, সার্বজনীন মানবাধিকারের ধারণা মূলত এ সময়েরই। তবে এ কথা ঠিক যে, পাশ্চাত্যে সার্বজনীন মানবাধিকারের ধারণার জন্ম ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর থেকে নির্ধারণ করা হলেও প্রকৃত অর্থে এর পেছনেও রয়েছে পর্যায়ক্রমিক একটি ইতিহাস। তবে এ ইতিহাস কোন ক্রমেই ১২১৫ ঈসায়ী সালের পূর্বের নয়।
যে ইংরেজ জাতি নিজেদের ‘সভ্য’ বলে দাবি করে থাকে তারা আসলে কতটুকু সভ্য, তাদের তথাকথিত এই ‘সভ্য’ হবার ইতিহাসই ক’দিনের এসব ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য পাঠকদের জন্য আমি প্রয়োজনীয় কিছু তথ্য তুলে ধরছি। ইংল্যান্ডে দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত ছিল রাজতন্ত্র। তখন মানুষের অধিকার বলতে কিছু ছিল না। পূর্বে ইংল্যান্ডে মনে করা হত যে, মানুষকে কোন অধিকার দেয়া বা না দেয়া রাজার স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা। নিরংকুশ ক্ষমতার অধিকারী সেইসব রাজা মানুষকে মানুষ হিসেনে মনে করত না। রাজাদের নির্মম অত্যাচারে অতিষ্ঠ জনগণ শত শত বছরের করুণ ইতিহাসের পথ পরিক্রমায় দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে অবশেষে মরিয়া হয়ে ঘুরে দাঁড়ায়। ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন সময়ে জন্ম নেয় মানুষের অধিকার সংক্রান্ত কিছু বিল। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ডা. এম এরশাদুল বারী মন্তব্য করেন ঃ ‘‘The idea of human rights to a great extent evolved as a result of political absolutism since rights of man became a slogan against the injustices and indignities committed by tyrannical or despotic governments’’ অর্থাৎ মানবাধিকার ধারণার অনেকাংশে বিকাশ ঘটে স্বেচ্ছাচারী শাসকের স্বেচ্ছাতন্ত্রের ফল হিসেবে, যখন অত্যাচারী ও স্বেচ্ছাচারী সরকারসমুহের সকল অবিচার ও অমর্যাদাকর ব্যবহারের বিরুদ্ধে মানুষের অধিকার একটি শ্লোগানে পরিণত হয়’’ ইংল্যান্ডে মানবাধিকার বিকাশের পথে পরিক্রমার চারটি পর্যায় হল ১২১৫ সালের ম্যাগনাকাটা, ১৬২৮ সালের পিটিশন অব রাইটস ১৬৮৮ সালের বিল অব রাইটস এবং ১৭০১ সালের অ্যাক্ট অব সেটেলমেন্ট।
১২১৫ সালের জুন মাসে ইংল্যান্ডের রাজা জন এবং রাষ্ট্রের বিত্তশালীদের মধ্যে স্বাক্ষরিত এ সনদটিকে ‘‘Keystone of English Liberty’’’ অর্থাৎ মানবাধিকারের চাবিকাঠি বলা হয়। ইংরেজ আইনবিদ Loard chathan মন্তব্য করেন, The petition of Right and the Bill of Rights along with the magna carta constitute the Bible of the English constitution. অর্থাৎ পিটিশন অব রাইট, বিল অব রাইট এবং ম্যাগনাকাটা ইংলিশ সংবিধানের বাইবেল স্বরূপ।’’ ইংল্যান্ডে মানবাধিকারের বিকাশ তথা মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার পিছনে যে দলিলটিকে চিহ্নিত করা হয় তা হল ১২১৫ সালের ম্যাগনাকার্টা। কিন্তু এ ম্যাগনাকার্টার পেছনে রয়েছে শত শত বছরের রক্তাক্ত ইতিহাস। নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষ এর মাধ্যমে ক্ষমতাসীনদের নিকট হতে যৎসামান্য অধিকার লাভের পথ খুঁজে পায়। অবশ্য যে ম্যাগনাকার্টাকে ইংল্যান্ডে মানবাধিকার আইনের উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তা কোন বিচারেই জনগণের সনদ (People’s charter) হিসেবে মর্যাদা প্রাপ্তি দাবি রাখে না। প্রথমত, এটি জনগণের সঙ্গে নয়, বরং প্রভাবশালীদের সঙ্গে রাজার একটি চুক্তি ছিল। দ্বিতীয়ত, এর বিধানসমূহ ছিল রাজকীয় অফিসারদের দ্বারা স্বেচ্ছাচারভাবে কর আরোপ এবং সম্প্রতি আটক বা দখলের বিধান রহিত করা, রাজ্যের মধ্যে ব্যবসায়ীদের চলাফেরার স্বাধীনতা প্রদান, জুরি কর্তৃক বিচার প্রভৃতি। সর্বসাধারণের বিষয়টি এখানে বিবেচনায় আনা হয়নি। বলা হয় ‘‘Although initially the objective of the magna carta was to compel the king to rule in a fair manner and to protect the barorns from unfair treatment by the goverment, subsequently many of the rights and guarantees granted to them were extended to the common people’’
অর্থাৎ যদিও প্রথমে ম্যাগনাকার্টার লক্ষ্য ছিল রাজাকে ন্যায়পন্থায় শাসন করতে বাধ্য করানো এবং সরকারের অন্যায় আচরণ থেকে ‘ব্যারন’দের রক্ষা করা। কিন্তু তাদেরকে প্রদত্ত অধিকার সমূহের অনেকগুলোই পরবর্তীতে সাধারণ মানুষদের প্রদান করা হয়।’’ সুতরাং যে সনদটিকে ইংল্যান্ডের মানবাধিকার আইনের প্রথম মাইলফলক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়, তা প্রকৃত অর্থে জনগণের সনদ ছিল না।
ব্রিটিশ জনগণের মানবাধিকার ইতিহাসের দ্বিতীয় দলিলটি হল ১৬২৮ সালের পিটিশন অব রাইটস। এই বিলের মাধ্যমে জনগণের কয়েকটি অধিকারকে স্বীকার করা হয়। কিন্তু রাজা কর্তৃক এটি প্রত্যাখ্যাত হতে পারে এ ভয়ে খুব কৌশলে ‘বিল’ আকারে নয়, বরং ‘পিটিশন’ আকারে এটি পেশ করা হয়। এতে মোট ৪টি ধারা রয়েছে। ৪টি ধারায় পর্যায়ক্রমে বলা হয়েছে ঃ ১. পার্লামেন্টের অনুমোদন ছাড়া কোন ব্যক্তির উপর কর আরোপ করা যাবে না। ২. কারণ দর্শানো ব্যতিরেকে কোন ব্যক্তিকে জেলে আটক রাখা যাবে না। ৩. সেনাবাহিনীর কোন দল গৃহকর্তার পূর্ব অনুমতি ছাড়া করে গৃহে অবস্থান করতে পারবে না, এবং ৪. রাজা বা রাণী কর্তৃক আইনে প্রসিডিং এর জন্য কমিশন জারী করা যাবে না।
১৬৮৮ সালে প্রণীত এ বিলের মাধ্যমে রাজা বা রাণী কর্তৃক স্বেচ্ছাচারীভাবে আদালত গঠন সংক্রান্ত ক্ষমতা হ্রাস করা হয়। এর দ্বারা রাজার নিকট প্রজাদের আবেদন করা, পার্লামেন্টে সদস্যদের কথা বলা এবং বিতর্কে অংশগ্রহণের স্বাধীনতা স্বীকৃত হয়। ১৭০১ সালে প্রণীত এ আইনটিতে মূলত বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা বলা হয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।