পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বিশ্ব রাজনীতিতে একটি নতুন মেরুকরণ সৃষ্টি করতে শুরু করেছে। রাশিয়া ও চীনের হাত ধরে পূর্ব-পশ্চিমের শক্তিতে একটি ভারসাম্য এবং বিভক্তি আরো স্পষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করেছে। এতদিন পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদী শক্তি একটি ইসলামোফোবিক এজেন্ডা সামনে রেখে মধ্যপ্রাচ্য এবং মুসলমান প্রধান দেশগুলোতে যথেচ্ছ আগ্রাসন, নিয়ন্ত্রণ ও হুকুমদারি চালাচ্ছিল। সিরিয়া যুদ্ধে রাশিয়ার হস্তক্ষেপ ও পশ্চিমা জোটের পরাজয় শত্রæ হিসেবে রাশিয়াকে টাগের্টে পরিনত করে ইউক্রেনকে টোপ হিসেবে ব্যবহারের মধ্য দিয়ে তা জমিয়ে তোলা হয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধের পর মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরেশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক চালচিত্রে সেই নতুন মেরুকরণ আরো স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ছে। পশ্চিমা বিশ্বের ইসলাম বিদ্বেষী ইসলামোফোবিক এজেন্ডা নিয়ে রাশিয়া-চীন নিরব দর্শকের ভূমিকার পালন করলেও এবার তাদেরকে একটি স্পষ্ট অবস্থানে আসতে দেখা যাচ্ছে। এর প্রথম প্রতিফলন দেখা গেল গত সপ্তাহে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে গৃহিত একটি প্রস্তাবে ১৫ মার্চ তারিখকে আন্তর্জাতিক ইসলামোফোবিয়া প্রতিরোধ দিবস হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। পাকিস্তানের আনীত প্রস্তাবে ওআইসির সদস্যভুক্ত ৫৫টির বেশি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের পাশাপাশি চীন ও রাশিয়ার মত ভেটোপাওয়ার সম্পন্ন পরাশক্তি দেশও এই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়ে প্রস্তাবটি পাস করতে সহায়ক ভ’মিকা রেখেছে। ২০১৯ সালের ১৫ মার্চ নিউজিল্যান্ডের একটি মসজিদে ইসলাম বিদ্বেষী হেইটগ্রæপের নৃশংস হামলায় অর্ধ শতাধিক মানুষ হতাহত হয়েছিল। সেই দিনটিকে স্মরণে রেখেই ১৫ মার্চকে ইসলামোফোবিয়া প্রতিরোধ দিবস হিসেবে গ্রহণ করেছে জাতিসংঘ। দীর্ঘদিন পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় পশ্চিমা ইসলামোফোবিক এজেন্ডার বিপক্ষে এমন একটি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সক্ষম হল। এতদিন পশ্চিমাদের ভূ-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক দাবার ঘুটির চালে চীন-রাশিয়ার মত পরাশক্তিগুলোও এ ব্যাপারে নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে চলেছিল। বিশ্বরাজনীতির পরিবর্তিত বাস্তবতায় ইসলাম বিদ্বেষী প্রপাগান্ডা পশ্চিমা বিশ্বে আগের মত কার্যকর ভূমিকা রাখতে না পারলেও এশিয়ায় ভারত, ইউরোপে ফ্রান্সের মত সাবেক মুসলমান উপনিবেশ প্রভাবিত দেশগুলোতে দেখা যাচ্ছে নতুন বাস্তবতা। ইসলামোফোবিয়া প্রতিরোধে জাতিসংঘের প্রস্তাবের পক্ষে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় বিপক্ষে ভোট না দিলেও প্রস্তাবটির বিরুদ্ধে ভারত, ফ্রান্স এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নকে এক সুরে কথা বলতে দেখা গেছে। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বক্তব্য হচ্ছে, যেহেতু জাতিসংঘ ২২ আগস্টকে ধর্ম ও বিশ্বাসের কারণে ভিকটিমদের স্মরণে আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে, সে হিসেবে ১৫ মার্চকে ইসলামোফোবিয়া প্রতিরোধ দিবস ঘোষণাকে তারা পুনরাবৃত্তি বলে মনে করে। প্রস্তাবটি গ্রহণের মধ্য দিয়ে জাতিসংঘ এর যথার্থতাকে মান্যতা দিতে সক্ষম হয়েছে।
১৫ মার্চকে ইসলামোফোবিয়া প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালনের বিরোধিতাকারী স্বল্প কয়েকটি দেশের অন্যতম ভারত এবং ফ্রান্স নিজ নিজ দেশে সংখ্যালঘু মুসলমানরা রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে ইসলামবিদ্বেষের শিকার। এ ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থা খুবই ভয়াবহ। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামলে ইসলামোফোবিক এজেন্ডা সামনে রেখে ৭টি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে মুসলমানদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞাসহ নানাবিধ বৈষম্যমূলক নির্দেশনা জারি করা হয়েছিল। মুসলমান কমিউনিটি ছাড়াও খোদ মার্কিন সমাজের অভ্যন্তরেই সে সব পদক্ষেপের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিবাদ দেখা দিয়েছিল। সাদা চামড়ার মার্কিন নারী-পুরুষ ‘আই অ্যাম অ্যা মুসলিম টু’ প্ল্যাকার্ড হাতে মুসলমান ভিকটিমদের পাশে দাড়িয়েছিল। অন্যদিকে শতকরা প্রায় ২০ ভাগ বা প্রায় ২৫ কোটি মুসলমান জনসংখ্যা অধ্যুসিত ভারতের সরকার এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জনগোষ্ঠী এখন মুসলমানদের নাগরিকত্বহীন অথবা দ্বিতীয় সারির নাগরিকে পরিনত করার নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। খÐ-বিখÐ, বহুধাবিভক্ত ভারততে একত্রিত করে শত শত বছর শাসনের মধ্য দিয়ে আধুনিক ভারতের ভিত্তি রচনা করেছিল মূলত মুসলমান শাসকরা। মুসলমান সুলতান, মুঘল ও ইংরেজের অধীনে হাজার বছর ধরে ভারতের হিন্দু-মুসলমানরা শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করার কারণেই ভারত একটি বড় রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক এন্টিটি হিসেবে আত্মপ্রকাশিত হতে পেরেছিল। বিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে পর পর দুইটি মহাযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসকরা স্থানীয় জনগণের আন্দোলন-সংগ্রামের মুখে তাদের উপনিবেশগুলো ত্যাগ করার আগে তারা এমন কিছু আঞ্চলিক ডিসপিউট সৃষ্টি করেছিল যা আর কখনোই সমাধানের পথ খুঁজে পায়নি। অযোধ্যায় ৫শ বছরের পুরনো বাবরি মসজিদের স্থানে রামের জন্ম সংক্রান্ত বিতর্ক ও রামমন্দিরের কাল্পনিক অস্তিত্বের দাবী বৃটিশ ষড়যন্ত্রকারিরাই ঢুকিয়ে দিয়েছিল বলে ঐতিহাসিকভাবে প্রমানিত হয়। নব্বইয়ের দশকে ভারতের বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা আনন্দপটবর্ধনের ‘রাম কে নাম’ ডক্যুমেন্টারিতে এ চিত্র উঠে এসেছে। হিন্দু-মুসলমান শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থানে থাকা একটি জনপদকে রাজনৈতিক কারণে অশান্ত করে ফায়দা লোটার চিত্র এখন আরো বেশি স্পষ্ট। ভারতের কোনো কোনো রাজ্যে যে যত বেশি মুসলমান বিদ্বেষী ভূমিকা গ্রহণ করবে, সেখানে ভোটের রাজনীতিতে সে তত বড় নেতা হয়ে ওঠার বাস্তব উদাহরণ মূখ্যমন্ত্রী থেকে নরেন্দ্রমোদির ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়ে ওঠা, যোগী আদিত্যনাথের উত্তর প্রদেশের মূখ্যমন্ত্রী হওয়া এবং ভারতের ভবিষ্যত প্রধানমন্ত্রী হয়ে ওঠার পরীক্ষায় এখন উত্তর প্রদেশের কোটি কোটি মুসলমানকে হিন্দুত্ববাদের বলির পাঠা বানোনো হচ্ছে।
দেশভাগের আগে কলকাতা ও আসামে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা সৃষ্টি করে ধর্মভিত্তিক বিভাজনকে অনিবার্য করে তোলা হয়েছিল। এরপরও কোনো একক দেশ হিসেবে ভারত হচ্ছে সবচে বড় মুসলমান জনসংখ্যার দেশ। এ সংখ্যা পাকিস্তান বা বাংলাদেশের জনসংখ্যার চেয়ে বড়। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের প্রতি আস্থা রেখেই হাজার বছর ধরে বংশানুক্রমিকভাবে বসবাসরত সেখানকার মুসলমানরা ১৯৪৭ সালে ভারতকেই নিজের দেশ হিসেবে বেছে নিয়েছিল। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলমানের আত্মত্যাগ হিন্দুদের চেয়ে কম নয়। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিকভাবে দেশকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে মুসলমানদের অবদান অনেক বেশি। ভারতে হিন্দুত্ববাদী বৈষম্য নীতি মাথাচাড়া দিয়ে না উঠলে এ নিয়ে বিতর্কের কোনো প্রয়োজনও হয়তো ছিল না। ভারতের হিন্দুত্ববাদ আধুনিক গণতন্ত্র এবং মাল্টিকালচারালিজমের সহাবস্থান নীতির সাথে চরমভাবে বেমানান। যেখানে দেশে দেশে রাষ্ট্র এবং তার গণতান্ত্রিক-রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো নাগরিকদের মধ্যকার জাতিগত ও সাংস্কৃতিক বিরোধ কমিয়ে আনার চেষ্টা করছে, সেখানে ভারতে দেখা যাচ্ছে উল্টো চিত্র। ভারতের রাষ্ট্র তথা সরকার ও কিছু সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান মুসলমানদের বিরুদ্ধে সংখ্যা গরিষ্ঠ হিন্দু জনগোষ্ঠিকে ক্ষেপিয়ে তোলতে যা’ কিছু করা যায় তার সবই করছে তারা। এতদিন হিন্দুতআবাদীদের সভা-সমাবেশ ও রাজনৈতিক কর্মসূচির মধ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িকতাকে ভোটের রাজনীতির হাতিয়ারে পরিনত করা হয়েছে। এখন সেখানকার পাঠ্যপুস্তক থেকে শুরু করে মুম্বাই’র চলচ্চিত্র অঙ্গনকে সব হিন্দৃুর মধ্যে মুসলমান বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেয়ার এজেন্ডা বাস্তবায়নের কাজে লাগানো হচ্ছে। ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের অবস্থা অনেকটাই ইসরাইল নিয়ন্ত্রিত ফিলিস্তিনের মত। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামের ডিবেটেও ফিলিস্তিনের সাথে কাশ্মিরের তুলনা উঠে আসতে দেখা যাচ্ছে। কাশ্মির কখনোই ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল না। শতকরা ৯০ভাগ মুসলমান জনগোষ্ঠি অধ্যুসিত কাশ্মিরে শিখ রাজা হরি সিংকে ক্ষমতায় বসিয়ে সদ্য স্বাধীন ভারতের সাথে আঁতাত করে ভারতীয় ইউনিয়নভুক্ত করার ক্ষেত্রে কাশ্মিরের যে বিশেষ মর্যাদার কথা ভারতীয় সংবিধানে সন্নিবেশিত করা হয়েছিল, সংবিধানের সেই ৩৭০ ধারা বাতিল করে দিয়ে কাশ্মিরকে একটি বিজেপি শাসিত জেলখানায় পরিনত করার প্রেক্ষাপট আরো অনেক আগেই শুরু করা হয়েছিল। উত্তাল উত্তপ্ত কাশ্মির নিয়ে ভারত-পাকিস্তানের দ্ব›দ্ব জম্মু-কাশ্মিরের মুসলমান নাগরিকরা যেমন ভারতীয় বাহিনীর টার্গেট, তখন সেখানকার হিন্দু সংখ্যালঘুরাও প্রতিপক্ষের দ্বারা নিরাপত্তাহীনতা বোধ করবেন, এটাই স্বাভাবিক। কাশ্মিরের পন্ডিতরা এক বছরে বা এক দশকে কাশ্মির উপত্যকা ত্যাগ করেনি। বিশেষত কাশ্মির উপত্যকায় ডেমোগ্রাফি পরিবর্তনের ঐতিহাসিক ধারাক্রম প্রায় ২ হাজার বছর ধরে চলমান। স¤্রাট অশোকের আমলে কাশ্মির উপত্যকাসহ ভাররে বিভিন্ন অঞ্চল বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠতার তথ্য পাওয়া যায়। বর্তমানে কাশিা¥রের মত মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলোতে মুসলমানদের গণহত্যা ও বিতাড়নের মধ্য দিয়ে বৌদ্ধদের বিতাড়িত করে হিন্দু আধিপত্য ও সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রতিষ্ঠার পুরনো ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন চলছে?
রাষ্ট্রক্ষমতা যখন হিন্দুত্ববাদিদের হাতে তখন কাশ্মিরের সামগ্রিক পরিস্থিতির জন্য এবং ব্রাহ্মনদের কাশ্মির ত্যাগের জন্য একচ্ছত্রভাবে মুসলমানদের উপর দোষ চাপিয়ে পুরো ভারত জুড়ে মুসলিম বিদ্বেষ উস্কে দেয়ার রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কার্যক্রম চালাচ্ছে ভারত সরকার। গত সপ্তাহে ভারতের বলিউড থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত হিন্দি ফিল্ম ‘দ্য কাশ্মির ফাইলস’ দেখে সিনেমা হলেই মুসলিম বিদ্বেষী শ্লোগান ও অসহিষ্ণুতার চিত্র বেরিয়ে আসছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায়। ভারতীয় সাংবাদিক রানা আইয়ুবের এ সংক্রান্ত মতামত ও ভিডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর তা এখন পশ্চিমা গণমাধ্যমেও উঠে আসছে। কাশ্মিরের স্বায়ত্বশাসন ও বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নিয়ে সেখানে সেনাশাসন জারির পর থেকে সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কার্যত জেলখানায় বন্দির জীবন কাটাচ্ছে। নির্যাতনের শিকার, আতঙ্কগ্রস্ত কাশ্মিরের মানুষকেই এখন কাশ্মিরি পন্ডিতদের দেশছাড়ার হেতু হিসেবে শুধু কাশিা¥রীদেরই নয়, সব ভারতীয় মুসলমানকেই ভিকটিমাইজ করা হচ্ছে। পরিচালক বিবেক অগ্নিহোত্রি অভিনেতা ও বিজেপি নেতা অনুপম খের, মিথুন চক্রবর্তি ও পল্লবি জোশিকে নিয়ে একটি বাণিজ্যিক ছবি নির্মান করেছেন। এর মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রকার ও কলাকুশলিরা মিলে এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চেয়েছেন। প্রথম টার্গেট ভারতীয় সমাজের সাম্প্রদায়িক মনোভঙ্গিকে সামনে রেখে মুনাফা বাণিজ্য করা। প্রথম সপ্তাহেই শতকোটি টাকা বাণিজ্য করেছে কাশ্মির ফাইল্স। যুগপৎ দ্বিতীয় টার্গেট হচ্ছে ভারতীয় হিন্দুদের মধ্যে মুসলমানদের সম্পর্কে ঘৃনা-বিদ্বেষ ছড়িয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করা। রানা আইয়ুব তার ভিডিও পোষ্টে দেখিয়েছেন, একটি সিনেমা হলের ভেতরেই ‘গুলিমারো সালে কো’ শ্লোগান দিয়ে মুসলমানদের হুমকি দিতে শুরু করেছিল দর্শকরা। এ সপ্তাহে উত্তর প্রদেশে এক সিনেমা হলে কাশ্মির ফাইলস দেখে বের হয়েই হিন্দুৃত্ববাদীরা মুসলমান বিদ্বেষি শ্লোগান দিতে শুরু করলে স্থানীয় মুসলমান যুবকরা বাধা দিলে রক্তাক্ত সংঘাতের খবর পাওয়া গেছে। এমন একটি বিদ্বেষ-বিভাজন সৃষ্টিকারি মুভিকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভ’য়সী প্রশংসা করেছেন। এতে নাকি কাশ্মির পরিস্থিতির প্রকৃত সত্য বেরিয়ে এসেছে! যারা এর বিরোধিতা-সমালোচনা করছে, তারা নাকি সত্যকে ভয় পায়। মুসলমানরা কাশ্মিরের পন্ডিতদের সেখান থেকে বের করে দিয়েছে, এমন তথ্য হাজির করে মূলত তারা কাশ্মিরের ডেমোগ্রাফি পরিবর্তনের রাজনৈতিক এজেন্ডাকে জায়েজ করার চেষ্টা করছে। ইউক্রেন যুদ্ধে বিশ্বের নতুন রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মেরুকরণে ভারতের অবস্থান কোথায় তা এখনো স্পষ্ট নয়। সউদি আরব বা আমিরাতের মত মার্কিন বশংবদ শাসকরাও যখন রাশিয়ার দিকে ঝুকে পড়তে শুরু করেছে। তেলবাণিজ্যের লেনদেন ডলারের পরিবর্তে রুবলে করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। রাশিয়ার প্রস্তাবের কাছে জেলেনস্কির ইউক্রেন কার্যত আত্মসমপর্ণ করতে চলেছে। তখন ভারতও রাশিয়ার সাথে তার পুরনো সখ্য বজায় রাখতে সচেষ্ট রয়েছে। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা, প্রলোভন ও প্রবল চাপের মধ্যেও এই কঠিন সময়ে রাশিয়া-চায়নার ভূ-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সমঝোতা ২৫ সালা তেলচুক্তির মধ্য দিয়ে নতুন উচ্চতা গ্রহণ করেছে।
ভারতের মুসলমান জনসংখ্যা রাশিয়া ও ইউক্রেনের সম্মিলিত জনসংখ্যার চেয়েও বেশি। কট্টর বিজেপে নেতা যোগি আদিত্যনাথের উত্তর প্রদেশের মুসলমান জনসংখ্যা ইউক্রেনের মোট জনসংখ্যার প্রায় সমান। ইউক্রেন যুদ্ধের ফলাফল যাই ঘটুক, ভারতে চলমান মুসলমান বিদ্বেষী রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক তৎপরতা বিশ্বের সবচেয়ে বড় এথনিক ক্লিনজিং বা গণগত্যা পরিস্থিতির আশঙ্কা জোরদার করা হচ্ছে। কয়েকমাস আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় মুসলমানদের একটি ভার্চুয়াল সেমিনারে জেনোসাইড ওয়াচের প্রতিষ্ঠাতা গ্রেগরি স্ট্যান্টন এবং বর্ষিয়ান মার্কিন রাষ্ট্র ও সমাজচিন্তক-দার্শনিক নোম চমস্কির কণ্ঠে এমন আশঙ্কার কথা ধ্বনিত হয়েছে। ভারতীয় ক্ষমতাসীন শ্রেণী বিশ্বসম্প্রদায়ের এমন আশঙ্কাকে থোরাই কেয়ার করছেন। বিশ্ব যখন মিথ্যা প্রচারনা নির্ভর ইসলামোফোবিক এজেন্ডা প্রতিরোধে ঐকমত্য পোষণ করছে, ভারতীয়রা তখন ২৫ কোটি মুসলমান নাগরিক ও প্রতিবেশী দেশের মুসলমানদের টার্গেট করে নতুনভাবে ইসলামোফোবিয়া ছড়িয়ে দিতে চাইছে। দিল্লীর পর ত্রিপুরায় নির্মম-রক্তাক্ত মুসলিম বিদ্বেষী দাঙ্গার পর গত বছর মুম্বাই’র ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র নির্মাতা রোহিত শেঠি অক্ষয় কুমার, রণবির সিংকে নিয়ে কাল্পনিক, মুসলিম বিদ্বেষী গালগল্প নির্ভর ‘সূর্যবংশি’ নির্মান করে সফল হয়েছিলেন। এভাবে একের পর এক ইসলামোফোবিক চলচ্চিত্র নির্মান করে বিজেপির মুসলমান বিদ্বেষী রাজনৈতিক এজেন্ডাকে সাধারণ শান্তিপ্রিয় হিন্দুদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। ভারতের বর্তমান সাম্প্রদায়িক-রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে একটি ব্যাপক গণহত্যার আলামত বলে আশঙ্কা করেছেন, গ্রেগরি স্ট্যান্টন। আল জাজিরা অনলাইনে প্রকাশিত জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের গণহত্যা প্রতিরোধ বিষয়ক সাবেক বিশেষ এডভাইজর জুয়ান ই মেন্ডেজের সাক্ষাৎকার ভিত্তিক এক প্রতিবেদনে ভারতের বিস্ফোরন্মুখ সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতিকে খুবই বিপজ্জনক ও গভীর সংকটপূর্ণ বলে অভিহিত করেছেন। চলতি বছরের(২০২২) ২১ জানুয়ারীতে প্রকাশিত প্রতিবেদনটির শুরুতেই উত্তরখন্ডের হরিদ্বারে অনুষ্ঠিত হিন্দু মহাসভায় হিন্দু নেতারা মুসলমানদের নির্মূলের প্রস্তুতি গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। সেখানে উপস্থিত কট্টর হিন্দু নেতাদের মধ্যে হিন্দু মহাসভা নেত্রি সাদ্বী অন্নপূর্ণা মা নাকি বলেছেন,( “ঊাবহ রভ লঁংঃ ১০০ ড়ভ ঁং নবপড়সব ংড়ষফরবৎং ধহফ শরষষ ঃড়ি সরষষরড়হ ড়ভ ঃযবস, বি রিষষ নব ারপঃড়ৎরড়ঁং,” ) এমনকি যদি আমাদের মধ্যে মাত্র ১০০জনও সেনায় পরিনত হতে পারি এবং তাদের ২০ লাখ লোককে হত্যা করতে পারি, আমরা বিজয়ী হব।
আল জাজিরার এই রিপোর্ট ভারতে সম্ভাব্য গণহত্যার গ্রেগরি স্ট্যান্টনের আশঙ্কাকেই সামনে নিয়ে আসছে। গুজরাট দাঙ্গায় হাজার হাজার হিন্দু-মুসলমানের (বেশিরভাগ মুসলমান) মৃত্যুর পর বর্ষিয়ান ভারতীয় সাংবাদিক-কলামিস্ট, সাহিত্যিক খুশবন্ত সিং অনুসন্ধানি তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছিলেন, তা ‘দ্য এন্ড অফ ইন্ডিয়া’ শিরোনামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল। একসময় গুজরাটের কষাই নামে খ্যাত নরেন্দ্র মোদি দিল্লীর মসনদে বসার আগেই খুশবন্ত সিং ২০১৪ সালের ২০ মার্চ ৯৯ বছর বয়েসে পরলোক গমন করেন। ১৯৪৬ সাল থেকে বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত ভারতের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার রাজনৈতিক বিবর্তন সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি দেখেছেন, যতই দিন যাচ্ছে, ভারতের সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক সংস্কৃতি তত বেশি নির্মম ও নৃশংস হয়ে উঠেছে। বইয়ের মুখবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘ধর্মের চরম বিকৃতি আমাদেরকে(ভারতীয়) বিশ্বের সবচেয়ে নির্মম মানুষে পরিনত করেছে’। সেই দেশভাগের সময় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা থেকে ১৯৮৪ সালে শিখ বিরোধি দাঙ্গা, ২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গাসহ বিজেপি শাসনের আগ পর্যন্ত সংঘটিত দাঙ্গার গতিপ্রকৃতি দেখেই মি: খুশবন্ত সিং এন্ড অব ইন্ডিয়া’র আলামত খুজে পেয়েছেন। এখন হিন্দু মহাসভার নেতারা লাখ লাখ মুসলমান হত্যার প্রস্তুতির কথা বলছেন, জাতিসংঘ জেনোসাইড প্রিভেনশন অ্যাডভাইজার এবং গ্রেগরি স্ট্যান্টনের তরফ থেকে গণহত্যার আশঙ্কা করা হয়েছে। ভারতে এমন আশঙ্কায় প্রতিবেশি ও বিশ্বসম্প্রদায়কে নিরব দর্শকের ভ’মিকা পালনের সুযোগ নেই।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।