Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পুতিনের পরিকল্পনা নিয়ে দুর্ভাবনার অন্ত নেই পশ্চিমাদের

অনলাইন ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ২১ মার্চ, ২০২২, ৪:০২ পিএম

রাশিয়ার নেতা ভ্লাদিমির পুতিন তার নিজস্ব এক ভুবনে আটকা পড়ে আছেন, আর এটা নিয়ে পশ্চিমা দেশের গুপ্তচরদের মনে দুর্ভাবনার অন্ত নেই। তার মন কীভাবে কাজ করে, কী তার উদ্দেশ্য - গুপ্তচরেরা বহুদিন ধরেই তা জানতে চেয়েছেন, যাতে তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে একটা আগাম ধারণা পাওয়া যায়।

আর গুপ্তচরদের এই আকাঙ্ক্ষা আরও বেশি গুরুত্ব পেয়েছে ইউক্রেনে রুশ হামলার পর। তারা জানতে চান পুতিনের ওপর চাপ বেড়ে গেলে তার প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে। তার মনের অবস্থা সম্পর্কে জানতে পারলে ইউক্রেন সঙ্কট যাতে আরও তীব্র না হয় তার একটা ব্যবস্থা খুঁজে পাওয়া যাবে। একটা গুজব রয়েছে রাশিয়ার নেতা অসুস্থ, কিন্তু অনেক বিশ্লেষক মনে করেন তিনি একা হয়ে পড়েছেন, এবং তার নিজের ধারণা বা বিশ্বাসের বাইরে যেসব মতামত রয়েছে - তা তিনি দেখতে পাচ্ছেন না।

তার এই একাকীত্ব ফুটে উঠেছে তার ছবিতে। যেমন, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁর সাথে বৈঠকে দেখা গেছে একটা লম্বা টেবিলের দুই প্রান্তে দু'জন নেতা বসে আছেন। ইউক্রেনে হামলার ঠিক পুতিন রুশ নিরাপত্তা পরিষদের সাথে যে বৈঠক করছেন, সেই ছবিতেও এই চিত্র ফুটে উঠেছে। ইউক্রেনে হামলার জন্য পুতিন যে প্রাথমিক পরিকল্পনা তৈরি করেছিলেন সেটি যেন এক কেজিবি অফিসারের তৈরি, ব্যাখ্যা করছেন একটি পশ্চিমা দেশের একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা।

এটি তৈরি করেছেন একদল ষড়যন্ত্রকারীর মতো লোক, যারা গোপনীয়তার ব্যাপারটিকে খুবই গুরুত্ব দিয়েছেন। কিন্তু এর ফলে তৈরি হয়েছে বিশৃংখল এক পরিস্থিতি। এই হামলা চালানোর জন্য রুশ বাহিনীর কোন কোন অধিনায়ক একেবারেই প্রস্তুত ছিলেন না। ফলে অনেক রুশ সৈন্য ইউক্রেনের সীমান্ত অতিক্রম করেছে এটা না জেনেই যে কেন তারা এই হামলা চালাচ্ছে।

পশ্চিমা দেশের গুপ্তচরেরা তাদের নানা সূত্র থেকে এসব পরিকল্পনার কথা আগেই জানতে পেরেছিলেন। রাশিয়ার নেতৃত্বের অংশ এমন বহু লোক এসব পরিকল্পনার কথা জানতেন না। এখন এসব গুপ্তচরের প্রধান ভাবনা রুশ নেতা এরপর কী করবেন সেটি খুঁজে বের করা। কিন্তু কাজটা সহজ নয়। "ক্রেমলিনের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা আঁচ করার ক্ষেত্রে প্রধান যে সমস্যা সেটা হলো - সব সিদ্ধান্ত নেন পুতিন নিজে," বলছেন জন সাইফার। মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএতে কাজ করা সময় তিনি রাশিয়া অপারেশন বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেছেন।

পুতিন জনসমক্ষে যেসব বক্তব্য দেন তার মধ্য দিয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে জানা গেলেও, কাজটা তিনি কীভাবে করবেন সেটা বড় একটা চ্যালেঞ্জের ব্যাপার। ব্রিটিশ গুপ্তচর বিভাগ এসআইএস, যেটি এমআইসিক্স নামে বেশি পরিচিত, তার এককালীন প্রধান ছিলেন স্যার জন সয়্যার্স। তিনি বলছেন, "রাশিয়ার মতো দেশে যেখানে গোয়েন্দা তথ্য জোগাড় করা কঠিন, সেখানে রুশ নেতার মাথার ভেতরে কী ভাবনা কাজ করছে সেটা জানতে পারা কঠিন এক চ্যালেঞ্জ।" "বিশেষভাবে যেখানে তার আশেপাশে অনেকেই জানেন না যে আসলে ঠিক কী ঘটতে চলেছে," বলছেন তিনি।

পশ্চিমা গুপ্তচর কর্মকর্তারা বলছেন, পুতিন তার নিজের তৈরি একটি বুদবুদের মধ্যে বসবাস করছেন। বাইরে থেকে প্রকৃত তথ্য অনেক সময়েই তার কাছে পৌঁছায় না। বিশেষভাবে তার নিজের মতামতের বিরুদ্ধে কোন কথা কেউ বলে না। "তিনি নিজের অপপ্রচারের মধ্যে বন্দি হয়ে আছেন," বলছেন মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক এড্রিয়ান ফার্নাম, "তিনি বিশেষ কিছু লোকের কথা শোনেন। এর বাইরে অন্যরা যা বলেন তা তিনি শুনতে চান না। এর ফলে বাইরের দুনিয়া সম্পর্কে তার ভাবনা বেশ অদ্ভুত।"

অধ্যাপক ফার্নাম একটি বই লিখেছেন যার শিরোনাম 'গুপ্তচরদের মনোজগৎ এবং গুপ্তচরবৃত্তি।' এতে তিনি দেখিয়েছেন, 'গ্রুপ থিংক' বলে একটি বিশেষ সমস্যা যেখানে নেতার আশেপাশে সবাই শুধু তার মনোভাবকেই সমর্থন করে যায়। "তিনি যদি এই গ্রুপ থিংকের শিকার হন, তাহলে প্রথমে জানতে হবে এই গ্রুপে কে কে আছে," বলছেন অধ্যাপক ফার্নাম। অবশ্য পুতিনের ঘনিষ্ঠ সার্কেলের সদস্য সংখ্যা খুব কম। কিন্তু ইউক্রেনে হামলা চালানোর সিদ্ধান্তর সাথে জড়িত ছিলেন আরও অল্প হাতে গোনা কিছু মানুষ।

পশ্চিমা স্পাই কর্মকর্তারা মনে করছেন, এদের সবাই 'প্রকৃত অনুগত' যাদের মতোই একই ধরনের ভাবনা-চিন্তা রয়েছে এবং পুতিনের মতোই তাদের মনেও একই বিষয় নিয়ে মোহ কাজ করে। পুতিনের ঘনিষ্ঠ সার্কেলের পরিধি যে কত ছোট - তার একটা ধারণা পাওয়া যায় ইউক্রেনে রুশ অভিযানের ঠিক আগে।

রুশ জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের এক বৈঠকে তিনি সে দেশের বহির্গোয়েন্দা বিভাগের প্রধানকে প্রকাশ্যে ভর্ৎসনা করেন। সবার সামনে তাকে অপমান করেন। এর কয়েক ঘণ্টা পর পুতিন যে ভাষণ দেন সেখানে ফুটে ওঠে এমন এক লোকের কথা যিনি খুব ক্রুদ্ধ, এবং ইউক্রেন ও পশ্চিমা দুনিয়া নিয়ে যিনি একেবারেই মোহগ্রস্ত।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের এসব কথাবার্তার ওপর যারা খুব কড়া নজর রাখেন তারা বলছেন, নব্বইয়ের দশকে রাশিয়া অবমাননার শিকার হয়েছে বলে যারা মনে করেন তাদের মতোই পুতিন সেই সব অবমাননার উপযুক্ত জবাব দিতে চান। পাশাপাশি পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়াকে দমিয়ে রাখতে চায় এবং তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র করছে বলেও পুতিন বিশ্বাস করেন।

সিআইএর পরিচালক উইলিয়াম বার্নসকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল প্রেসিডেন্ট পুতিনের মানসিক অবস্থা বিশ্লেষণ করতে। তিনি বলেছিলেন পুতিনের মনে "বহু বছর ধরে ক্ষোভ আর উচ্চাকাঙ্ক্ষা একসাথে মিলেমিশে টগবগ করছে।" সিআইএর প্রধান বলেন, এই দুটি বিষয় রুশ নেতার মনকে আগের চেয়ে কঠোর অবস্থানে নিয়ে গেছে এবং বিপরীতমুখী চিন্তাভাবনাগুলো এখন তার কাছে পৌঁছায় না।

তাহলে মি. পুতিন কি মানসিকভাবে অসুস্থ? পশ্চিমা দেশের অনেকেই এই প্রশ্ন বহু বছর ধরে করে আসছেন। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন অন্য কথা। এই বিষয় নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করেছেন এমন একজন মনোবিজ্ঞানী বলছেন, মি. পুতিনের মানসিক ভারসাম্য নিয়ে প্রশ্ন করা হবে ভুল। ইউক্রেনে হামলা চালানোর সিদ্ধান্তের পেছনে যুক্তিগুলো বুঝতে পারছি না বলেই মি.পুতিন 'পাগল' এটা মনে করা ঠিক হবে না।

সিআইয়ের মধ্যে একদল কর্মী রয়েছেন যাদের প্রধান কাজ হচ্ছে বিদেশে যারা সর্বোচ্চ পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন তাদের 'নেতৃত্বের পর্যালোচনা' চালানো। হিটলারের সময় থেকেই এই কাজটা হয়ে আসছে। গোপন তথ্য বিশ্লেষণ করে এরা নেতাদের অতীত, ঘনিষ্ঠ মানুষজনের সাথে তাদের সম্পর্ক এবং তাদের স্বাস্থ্য ইত্যাদি সম্পর্কে তারা গবেষণা চালান। তাদের আরেকটা সূত্র হচ্ছে নেতাদের সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে এমন লোকদের সাথে কথা বলে তথ্য সংগ্রহ করা।

দু'হাজার চৌদ্দ সালে সাবেক জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা মের্কেলের সাথে যখন প্রেসিডেন্ট ওবামার সাক্ষাৎ হয়েছিল সে সময় তিনি মন্তব্য করেছিলেন যে প্রেসিডেন্ট পুতিন 'এক ভিন্ন দুনিয়ায়' বসবাস করেন। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট সম্প্রতি যখন পুতিনের সাথে বৈঠক করেন তখন তিনি দেখতে পান রুশ প্রেসিডেন্ট আগের তুলনায় "অনেক বেশি কঠোর এবং অনেক বেশি নি:সঙ্গ।" সূত্র: বিবিসি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পশ্চিমা

২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ