পবিত্র লাইলাতুল বরাত
![img_img-1719941820](https://old.dailyinqilab.com/resources/images/cache/169x169x3_1678112525_editorial-inq.jpg)
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাবিশ্বগুলো রাশিয়ার উপর নানা অর্থনৈতিক অবরোধসহ কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে এবং নিচ্ছে। ইউক্রেনকে সহায়তায় যত ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা প্রয়োজন তার উদ্যোগ নিয়েছে। পাশাপাশি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের বিরুদ্ধেও কঠোর অবস্থান ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থার কথা বলছে। এদিকে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভসহ বিভিন্ন শহরে হামলা অব্যাহত রেখেছে রাশিয়ার সেনারা। এর মধ্যেই গত সোমবার ইউক্রেন-বেলারুশ সীমান্তে আলোচনায় বসেছিলেন রাশিয়া ও ইউক্রেনের প্রতিনিধিরা। আলোচনাকালে ইউক্রেন রাশিয়াকে হামলা বন্ধের আহ্বান জানায়। এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই বৈঠক শেষ হয়। তবে রাশিয়ার প্রতিনিধিদল বলেছেন, আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে মতৈক্য হয়েছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার কারণে ইউক্রেনের সাধারণ নাগরিকরা ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে থাকায় বড় ধরনের মানবিক সংকটের মুখে পড়েছে বলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মানবিক সহায়তা ও জরুরি পরিস্থিতি ব্যবস্থাপনাবিষয়ক হাইকমিশনার ইয়ানেস লেনারসিস এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন। তিনি বলেছেন, অনেক অনেক বছর পর আমরা ইউরোপ মহাদেশে সবচেয়ে বড় মানবিক সংকট দেখছি। যুদ্ধে ইউক্রেনের ১ কোটি ৮০ লাখের মতো মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে। দেশ ছেড়ে শরনার্থী হওয়া মানুষের সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখে পৌঁছাবে। ইতোমধ্যে ৫ লাখের বেশি মানুষ পাশের দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে বলে জাতিসংঘের ইউএনএইচসিআর জানিয়েছে।
ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা বন্ধের আহ্বান জানিয়ে ঢাকাস্থ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ৮ দেশের রাষ্ট্রদূতরা এক যৌথ বিবৃতি দিয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘এই লেখা আমরা এমন একটা সময়ে লিখছি, যখন রাশিয়ার ভয়াবহ আগ্রাসনের মুখোমুখি ইউক্রেনকে চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে। একুশ শতকে ইউরোপের যে ছবিটির কথা আমরা কল্পনাতেও আনিনি, সেটাই এখন আমাদের দেখতে হচ্ছে। একটি আগ্রাসী দেশ তার শান্তিপূর্ণ প্রতিবেশী দেশ দখল করতে গিয়ে নিরাপরাধ লোকজনকে নির্বিচারে খুন করছে, অন্য রাষ্ট্রের আঞ্চলিক অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বকে বুড়ো আঙ্গুল দেখাচ্ছে।’ কোনো দেশ সে যেই হোক, অন্য দেশে আগ্রাসন চালিয়ে দখল করে নেয়া বা ধ্বংস করে দেয়া কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। আজ রাশিয়া ইউক্রেনে যে আগ্রাসন চালাচ্ছে, তাও কাম্য নয়। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদেশসহ পশ্চিমাবিশ্বের দেশগুলো এ নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন এবং মানবতা দেখাচ্ছে। বিবেকসম্পন্ন মানুষ তা দেখাবে, সেটাই স্বাভাবিক। তবে এই বিবেকবানরা যখন নিজেরাই নিকট অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত মিথ্যা অজুহাত এবং ব্লেম দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন মুসলমান অধ্যুষিত দেশে হামলা চালিয়ে, নির্বিচারে লাখ লাখ মানুষ হত্যা এবং উদ্বাস্তুতে পরিণত করে ধ্বংস করে দিয়েছে, তখন তাদের মানবতা ও বিবেক একটুও কাঁপেনি। কেন? তারা মুসলমান বলে? এসব দেশের লাখ লাখ উদ্বাস্তু মানুষ যখন ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ অভিমুখী হতে গিয়ে নৌকাডুবিতে মৃত্যুবরণ করছে এবং তীরে উঠে আটক হয়ে দেশগুলোর কারাগারে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে, তখন তো ইউক্রেনের জনগণের জন্য তাদের যে মানবিকতা এবং বিবেক জেগে উঠেছে, এমনভাবে জেগে উঠেনি! সমুদ্র সৈকতে নিষ্পাপ শিশুর লাশ পড়ে থাকতে দেখেও তাদের বুক এতটুকু কাঁপেনি। এখন আঞ্চলিক অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের যে কথা বলছে, তখন কি এসব কথা মনে রেখেছিল? যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের এমন আচরণ কি কপট ও দ্বিমুখী নয়? ভারতের প্রখ্যাত লেখক অরুন্ধতি রায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের এমন কপট আচরণের বিস্তারিত বিবরণ বেশ কয়েক বছর আগে এক সভায় তুলে ধরেছেন। সেখানে তিনি তুলে ধরেছেন, কিভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র রাষ্ট্রগুলো নানা মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আগ্রাসন চালিয়েছে। তার বক্তব্য সম্বলিত এই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। তিনি বক্তব্যে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বে যে ধরনের অনাচার করে তা তার রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত। রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত নিয়েই তারা অন্য দেশে হামলা চালায়। এ এক ভয়ংকর সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতা। আমরা ১৯৮৮ সালের ৩ জুলাইয়ের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখব, ভূমধ্যসাগরে অবস্থানরত মার্কিন যুদ্ধজাহাজ থেকে মিসাইল ছুঁড়ে ইরানের এক উড়োজাহাজ ভূপাতিত করে। এতে ২৯০ সাধারণ যাত্রীর সবাই নিহত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয়, দুর্ঘটনা বশত এ ঘটনা ঘটেছিল। জর্জ বুশ তখন যুক্তরাষ্ট্রে তার নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছিলেন। তাকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি অত্যন্ত রুঢ়ভাবে মন্তব্য করেছিলেন, এ ব্যাপারে আমি কোনো ধরনের দুঃখ প্রকাশ করব না এবং ঘটনা যাই ঘটুক আমি তার তোয়াক্কা করি না। এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তার আগ্রাসী মনোভাবের প্রতিফলন ঘটে। অরুন্ধতি মন্তব্য করেন, যুক্তরাষ্ট্রের কী নিদারুণ এক নতুন আগ্রাসী যুগের সূচনা হয়েছে। তিনি বক্তব্যে উল্লেখ করেন, যুক্তরাষ্ট্র যখন ইরাকে আগ্রাসন শুরু করে তখন নিউ ইয়র্ক টাইমস ও সিবিএস গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের শতকরা ৪২ ভাগ নাগরিক বিশ্বাস করে, ইরাকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট নিউ ইয়র্কের টুইন টাওয়ার খ্যাত ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ও পেন্টাগনে হামলার পেছনে সাদ্দাম হোসেনের হাত রয়েছে এবং তিনি আল কায়দাকে সরাসরি সমর্থন করেছেন। অথচ এই অভিযোগের পেছনে কোনো তথ্য-প্রমাণ ছিল না। এটা ছিল পুরোপুরি মিথ্যা, ভিত্তিহীন, বানোয়াট এবং করপোরেট মিডিয়ার অপপ্রচার। এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের মতামতকে প্রতারণাপূর্ণভাবে কাজে লাগানো হয়। ইরাকে পারমানবিক অস্ত্র থাকার মিথ্যা তথ্য ও অভিযোগের ভিত্তিতে হামলা চালানোর এটা ছিল একটি অজুহাত। যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদেশগুলোর যৌথ হামলায় ইরাক তছনছ হয়ে যায়। একটি সমৃদ্ধ দেশকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করা হয়। শুধু এখানেই শেষ নয়, আল কায়দাকে নির্মূলের নামে আফগানিস্তানে দুই দশক ধরে হামলা চালিয়ে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া হয়। আইএস দমনের নামে সমৃদ্ধ সিরিয়াকে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়া হয়। একইভাবে হামলা চালিয়ে লিবিয়াকে ধ্বংস করা হয়। নানা মিথ্যা এবং ভিত্তিহীন অজুহাতে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদেশগুলো একে একে সমৃদ্ধ মুসলমান দেশগুলোতে হামলা চালিয়ে নিশ্চিহ্নকরণ যুদ্ধ চালিয়েছে। এতে লাখ লাখ মুসলমান নারী-পুরুষ ও শিশু হত্যাযজ্ঞের শিকার হলেও জাতিসংঘসহ পশ্চিমা বিশ্ব ছিল নীরব। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলো মানবিকতার চরম লঙ্ঘন করলেও তাদের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি করেনি। তখন পশ্চিমা বিশ্বের মিডিয়াগুলো কোথায় ছিল? তারা তো এ নিয়ে কোনো ধরনের মানবিক দায়িত্ব পালন করেনি। এর কারণ হচ্ছে, যাদের হত্যা এবং উদ্বাস্তুতে পরিণত করা হয়েছে তারা মুসলমান। মুসলমান হত্যা করলে তাদের মানবিকতায় এতটুকু আঘাত লাগে না। এখনও কাশ্মীরসহ সারা ভারতে মুসলমানদের হত্যা, নির্যাতন, নিপীড়ন, বিতারণ কর্মকাণ্ড চলছে, তার বিরুদ্ধেও যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদেশগুলো প্রতিবাদ দূরে থাক লিপ সার্ভিসটুকু পর্যন্ত দিচ্ছে না। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনে ইউক্রেনিয়ানদের দুর্দশায় তারা যেভাবে মানবিকতা দেখাচ্ছে, তাদের দরদ যেভাবে উৎলে উঠছে এবং আবেগাপ্লুত হয়ে বিবৃতি দিচ্ছে, তার কারণ কি তারা শ্বেতাঙ্গ কিংবা তাদের ধর্মের অনুসারী বলে? তাদের মানবতাবোধ কি কেবলই তাদের জন্য? এই এককেন্দ্রিক মানবিকতা যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাবিশ্বের দ্বৈতনীতিকে এখন পুরো বিশ্বের কাছে প্রশ্নবোধক হয়ে আছে। এর ফলে, ইউক্রেনে রাশিয়া যে আগ্রাসন চালাচ্ছে, তাতে পশ্চিমা দেশগুলো বাদে মধ্যপ্রাচ্যের দেশসহ অন্যান্য দেশ নীরব অবস্থানে রয়েছে। এর কারণ বোধকরি ব্যাখ্যা করে বলার অবকাশ নেই।
ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদেশগুলোর মধ্যপ্রাচ্য এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আগ্রাসনের ক্রমবিকাশ বা ধারাবাহিকতা বলেই গণ্য করছেন পর্যবেক্ষকরা। রাশিয়ার আগ্রাসন সমর্থন করার কারণ নেই। দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তোলা হচ্ছে, একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ এবং যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের বিরুদ্ধে ইরাকসহ অন্যদেশগুলোতে আগ্রাসন ও যুদ্ধ চালানোর অভিযোগে অভিযুক্ত করা যেতে পারে। বর্তমান প্রেক্ষাপটের দৃষ্টিতে এর বিচার করলে হবে না। ভিয়েতনাম থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ, কিউবা, গ্র্যানাডা, পানামা ও নিকারাগুয়ায় যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদেশগুলো যেভাবে হামলা ও আগ্রাসন চালিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, সেই প্রেক্ষাপট থেকে তাদের যুদ্ধাপরাধ কিংবা অমানবিক আচরণকে বিচার করতে হবে। অতীত ও বর্তমানের আগ্রাসন ও চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধের বিচার এক দৃষ্টিতে দেখতে হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এসব অমানবিক, অযৌক্তিক ও আগ্রাসী মনোভাবের পেছনে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদেশগুলোর যুদ্ধবাজ সরকার প্রধানদের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে বিচারের মুখোমুখি করলে, আজ বিশ্বে কোনো শক্তিধর দেশ অন্য দেশে আগ্রাসন চালাতে পারত না। আমরা মনে করি, ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন নিরসনে সমঝোতা ও কূটনৈতিক পন্থা অবলম্বন করতে হবে। এক্ষেত্রে উভয় পক্ষের ‘উইন উইন সিচুয়েশনে’র মধ্য দিয়ে সমাধান খুঁজতে হবে। একপাক্ষিক বা পশ্চিমাবিশ্বের একতরফা সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া সমীচিন হবে না। ফ্রান্স, তুরস্কসহ অন্যান্য দেশের সরকার প্রধানদের উদ্যোগী ভূমিকা পালন করতে হবে। সমঝোতার পরিবর্তে ন্যায্যতার ভিত্তিতে সংকটের সুরাহা করতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।