Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কী প্রভাব পড়তে পারে আপনার ওপর?

অনলাইন ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ১ মার্চ, ২০২২, ১:৫৯ পিএম

বিশ্বের যেসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসা বাণিজ্য বা আমদানি-রপ্তানি বেশি হয়, টাকার অংকে সেই তালিকার শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে নেই রাশিয়া বা ইউক্রেন। কিন্তু দুইটি দেশের সঙ্গেই বাংলাদেশের বাণিজ্য রয়েছে।

যদিও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত নিরপেক্ষ অবস্থান ধরে রেখেছে। কিন্তু বৈশ্বায়নের এই যুগে পৃথিবীর যেকোনো দেশের মধ্যে সংঘাতের প্রভাব অন্য দেশগুলোর ওপরেও ছড়িয়ে যায়। ফলে হাজার কিলোমিটার দূরের এই দুই দেশের সংকট নানাভাবে প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে বাংলাদেশের নাগরিকদের ওপরেও। বাংলাদেশের বিশ্লেষকরা বলছেন, রাশিয়া, ইউক্রেন ও পশ্চিমা দেশগুলোর এই সংঘাতে বাংলাদেশে তেল, গ্যাস, খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।

ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে বিশ্ব বাজারে তেলের দাম বেড়ে রেকর্ড ছুঁয়েছে। আন্তর্জাতিক বেঞ্চ মার্ক বেরেন্ট ক্রুডের তথ্য অনুযায়ী, এখন বিশ্ববাজারে এখন প্রতি ব্যারেল তেলের দাম একশো পাঁচ ডলার পর্যন্ত উঠে গেছে। পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বর্তমানে যে দামে জ্বালানি তেল কিনে বাংলাদেশে নিজেদের বাজারে বিক্রি করছে, তাতে প্রতিদিন ১৫ কোটি ডলার লোকসান গুনতে হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে গত বছরেই ডিজেলের দাম এক দফা বাড়িয়েছে বাংলাদেশের সরকার। যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে আর বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম আরও বাড়লে হয়তো তখন দেশের বাজারে মূল্য সমন্বয়ের চেষ্টা করবে সরকারগুলো। আর দেশের বাজারে দাম বাড়লে তার প্রভাবে পরিবহনের ভাড়া বাড়বে। পণ্য পরিবহনে খরচ বেশি হলে সেগুলোর দাম বাড়বে, যাত্রীদের বেশি ভাড়া গুণতে হবে, এমনকি কৃষি উৎপাদনেও খরচ বেড়ে যাবে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরুল ইমাম বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘এর আগে যখন ডিজেলের দাম বাড়ানো হলো, তখন আন্তর্জাতিক বাজারে দাম ছিল ৮০ ডলার। সেখানেই ডিজেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। এখন তেলের দাম যে হারে বেড়েছে, যুদ্ধের কারণে সেটা আরও বাড়তে পারে।’ ‘তখন তো আমাদের এখানেও মূল্য সমন্বয় করা ছাড়া বিকল্প থাকবে না। আর স্বাভাবিকভাবেই তেলের দাম বাড়লে পরিবহন খরচ বাড়বে। তখন পণ্যের দাম, যাত্রীদের ভাড়া, উৎপাদন খরচ- সব কিছুই বেড়ে যাবে,’ তিনি বলছেন।

বাংলাদেশ বর্তমানে প্রতি বছর ৫০ লাখ টন ডিজেল, ১৩ লাখ টন অপরিশোধিত তেল, ২ লাখ টন ফার্নেস অয়েল এবং ১ লাখ ২০ হাজার টন অকটেন আমদানি করে থাকে। বাংলাদেশ মূলত সউদী আরব ও আবুধাবি থেকে জ্বালানি তেল আমদানি করে থাকে। এছাড়া সিঙ্গাপুর থেকে ফার্নেস অয়েল আমদানি করে।

বিশ্ববাজারে এলএনজি গ্যাসের দামও বেড়েছে। যদিও বিদেশি একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গ্যাস কেনার দশ বছরের চুক্তি রয়েছে বাংলাদেশের, ফলে গ্যাসের দামে হয়তো এখনি বড় প্রভাব ফেলবে না। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতি মিলিয়ন ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট (এমএমবিটিউ) কিনছে ১১ ডলারে। কিন্তু গত ফেব্রুয়ারিতে যে অল্প কিছু গ্যাস মুক্ত বাজার থেকে কিনেছে বাংলাদেশে, সেখানে প্রতি এমএমবিটিউ দিতে হয়েছে ৩০ ডলার।

বাংলাদেশের গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো এর মধ্যেই গ্যাসের দাম প্রায় দ্বিগুণ করার প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে। আগামী ২১শে মার্চ থেকে এই বিষয়ে চারদিনের গণশুনানি শুরু করতে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। রাশিয়া বিশ্বের সবচেয়ে বড় গ্যাসের সরবরাহকারী, যদিও দেশটির প্রধান ক্রেতা ইউরোপের দেশগুলো। সেসব দেশের ৪০ শতাংশ গ্যাসের যোগান আশে রাশিয়া থেকে।

কিন্তু একের পর রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞা জারি করছে। সেখানে রাশিয়ার গ্যাস বা তেলেরও ওপরে এখনো সরাসরি কোন নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়নি। কিন্তু অর্থনৈতিক নানা নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার গ্যাসের সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হলে এসব দেশ মুক্ত বাজার থেকে গ্যাস কিনবে। ফলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, মুক্ত বাজারে গ্যাসের দাম আরও বেড়ে যেতে পারে। সেই মূল্য হয়তো তখন বাংলাদেশের গ্যাসের দাম বৃদ্ধির শুনানিতে একটি প্রভাবক হয়ে দেখা দিতে পারে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরুল ইমাম বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ''এটা অবশ্যই বাংলাদেশের ওপর চাপ তৈরি করবে। কারণ ইউরোপে রাশিয়ার গ্যাসের সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হলে তারা চাইবে, যেকোনো জায়গা থেকে গ্যাস সেখানে নিয়ে যেতে। তখন আমরা যেসব মার্কেট থেকে সহজে গ্যাস পেতাম, তখন আর সেই দামে সহজে পাবো না।'' ''তখন তাদের সাথে প্রতিযোগিতা করে আমাদের গ্যাস কিনতে হবে, এলএনজির দাম অতি চড়া দামে কিনতে হবে। ফলে এখানে গ্যাসের দামও বাড়বে, একটা ক্রাইসিসও তৈরি হবে।''

বিদ্যুতের দাম বাড়লে সবকিছুর দাম বাড়বে: তেল ও গ্যাসের দামের সঙ্গে অনেকটাই সম্পর্ক রয়েছে বিদ্যুতের দামের। কারণ বাংলাদেশে বিদ্যুতের একটি বড় অংশ উৎপাদনে এই দুইটি জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করা হয়। তেল ও গ্যাসের দাম বাড়লে সরকারের সামনে বিকল্প থাকবে দুইটি। এক. এই খাতে ভর্তুকির পরিমাণ আরও বাড়িয়ে দেয়া। কিন্তু সেক্ষেত্রে সরকারের অন্যান্য খাত থেকে খরচ কমিয়ে এনে এই খাতে ব্যবহার করতে হবে। ফলে উন্নয়ন বা অন্যান্য প্রকল্প বাধাগ্রস্ত হতে পারে। অথবা জ্বালানি পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দেয়া। প্রথমটি করা হলে যেমন সরকারের খরচ বাড়বে, দ্বিতীয়টি করার হলে জনগণের খরচ বহুগুণ বেড়ে যাবে। সেই সঙ্গে মূল্যস্ফীতিও বেড়ে যাবে।

গমের সংকট তৈরি হলে প্রভাব পড়বে খাদ্য পণ্যে: আমদানি ও রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে প্রতি বছর প্রায় ১১০ কোটি ডলারের বাণিজ্য হয়ে থাকে। রাশিয়া থেকে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি আমদানি করে গম। ইউক্রেন থেকেও এই পণ্যটি বাংলাদেশ আমদানি করে।

বাংলাদেশের গমের মোট চাহিদার এক তৃতীয়াংশ আসে এই দুইটি দেশ থেকে, বলছেন বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্প গ্রুপ সিটি গ্রুপের একজন পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা। প্রতি বছর এই দুইটি দেশ থেকে প্রায় একশো কোটি টন গম বাংলাদেশে আসে। কিন্তু এই যুদ্ধের কারণে গমের সেই সরবরাহ নিয়ে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। দেশের মোট ভুট্টার চাহিদার ২০ শতাংশ আসে এই দুইটি দেশ থেকে। সূর্যমুখী তেলের আশি শতাংশই আসে এই দুইটি দেশ থেকে।

রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা দেশগুলোর জারি করা নিষেধাজ্ঞার ফলে সরাসরি এসব পণ্য কেনা কঠিন হয়ে উঠতে পারে। যুদ্ধের কারণে এর মধ্যেই গম, সূর্যমুখী তেল আর ভুট্টার দাম বাড়তে শুরু করেছে। গম থেকেই ময়দা, আটা, সুজিসহ বিভিন্ন খাদ্যজাত পণ্য তৈরি করা হয়। বাংলাদেশের একজন বেকারি ব্যবসায়ী দেলোয়ার হোসেন বলছেন, ''গমের দামে তো আর সরকারি ভর্তুকি থাকে না। এখন আমাদের বেশি দামে কিনতে হলে রুটি, বিস্কুটের দামও বাড়িয়ে দিতে হবে।''

মোহাম্মদপুরের টাউন হলের একজন ক্রেতা আঁখি আক্তার বলছেন, সূর্যমুখী তেলের দামও বেড়ে গেছে। গত মাসেও যে দামে কিনেছি, এই মাসে দুশো টাকা বেশি দিয়ে পাঁচ লিটারের জার কিনতে হচ্ছে। এর বাইরে তুলা, সরিষা ও মসুর ডাল রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে আমদানি করা হয়।

প্রভাব পড়বে রপ্তানিতে পণ্যে: বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের নতুন বাজার হিসাবে দেখা হচ্ছে রাশিয়াকে। গত বছর বাংলাদেশ থেকে রাশিয়ায় যে ৭৮ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, তার মধ্যে তৈরি পোশাকই সবচেয়ে বেশি। গত বছর বাংলাদেশ থেকে রাশিয়ায় ৬০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। তবে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা আশঙ্কা করছেন, এই যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে তাদের রপ্তানির ওপর বিরূপ প্রভাব তৈরি করবে।

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি কারক ও কারখানা মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সাবেক সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ''আমরা এর মধ্যেই চিন্তায় পড়ে গেছি। কারণ সুইফট সিস্টেম থেকে রাশিয়াকে বাদ দেয়া হলে আমাদের পাওনা পাওয়া নিয়ে জটিলতা তৈরি হবে। আবার রাশিয়ায় যদি জাহাজ বা বিমান পাঠানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়, তাহলে তো এখানে তৈরি করা পোশাকও তো আমরা পাঠাতে পারবো না।''

তিনি জানান, তেলের অব্যাহত দাম বৃদ্ধির কারণে তারাও চিন্তায় রয়েছেন। কারণ এর ফলে জাহাজ ভাড়া বাড়ছে। অন্যদিকে যে দামে তারা পোশাক রপ্তানির আদেশ নিয়েছেন, সেখানেও উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এসবের বাইরে বাংলাদেশের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে রাশিয়া অর্থায়ন এবং নির্মাণে সহায়তা করছে। এরই মধ্যে এই প্রকল্পের প্রথম ধাপ প্রায় সম্পন্ন হয়েছে। এই প্রকল্পে রাশিয়া থেকে নেয়া ঋণও বাংলাদেশ পরিশোধ করছে। কিন্তু রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞায় প্রকল্পের সরঞ্জাম আনা বা ঋণ পরিশোধে সমস্যা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ এ রাশিয়ার সহায়তার জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ। কিন্তু রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা দেশগুলো যেভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে, তাতে এসব প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কায় রয়েছেন বিশ্লেষকরা। যদিও এসব প্রকল্প নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়েনি। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এখন পর্যন্ত এসব প্রকল্পে রাশিয়ার সহায়তা বন্ধ করতে বাংলাদেশের ওপর কোন দেশ থেকে চাপ দেয়া হয়নি। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম কয়েকদিন আগে গণমাধ্যমকে বলেছেন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ রাশিয়ার সঙ্গে যেসব উন্নয়ন প্রকল্প ও বাণিজ্য রয়েছে, তা চলমান থাকবে। সূত্র: বিবিসি বাংলা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ইউক্রেন


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ