পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে একটি ছোট্ট প্রতিবাদও স্ফুলিঙ্গ হয়ে উঠতে পারে। অন্যায় আচরণ ও সিস্টেমের ভিত্তি নাড়িয়ে দিতে পারে। ভারতের কর্ণাটকে হিজাব পরতে বাধা দেয়ায় শিক্ষার্থী মুসকান খানের প্রতিবাদ যেন সেই স্ফুলিঙ্গ হয়ে সারাবিশ্বে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। মোদির শাসনামলে জেগে উঠা উগ্র হিন্দু মৌলবাদের বিরুদ্ধে মুসকানের ঘুরে দাঁড়িয়ে আঙ্গুলি প্রদর্শন বিশ্বে এখন প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে উঠেছে। পাঠক ইতোমধ্যে ঘটনাটি সম্পর্কে জেনেছেন। মুসকান প্রতিদিনের মতোই বোরকা-হিজাব পরে কলেজ ক্যা¤পাসে এসেছিল। তার স্কুটি পার্ক করে যখন ক্লাসের দিকে যাচ্ছিল, তখন বেশ কিছু ব্যক্তি তাকে অনুসরণ করে। গেরুয়া রঙের স্কার্ফ পরিহিত ব্যক্তিরা ‘জয় শ্রী রাম’ শ্লোগান দিয়ে মুসকানের দিকে এগিয়ে আসে। মুসকানও ঘুরে দাঁড়ায়। তাদের দিকে ফিরে হাত তুলে ‘আল্লাহু আকবার’ বলে চিৎকার করে এগিয়ে যায়। ঘটনাটির ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে এ নিয়ে সারাবিশ্বে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। মুসকানের এই প্রতিবাদের ব্যাপক সমর্থন পাওয়া যায়। তার প্রতিবাদের পক্ষে ভারতেও মিছিল হয়। এমনকি ভারতের কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াংকা গান্ধী স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ভারতের জনগণ যার যার পছন্দমতো পোশাক পরবে। সে হিজাব পরবে নাকি অন্য পোশাক পরবে, সেটা তার নিজের অধিকার। ভারতের সংবিধান এ অধিকার দিয়েছে। মুসকান এক সাক্ষাৎকারে বলেছে, আমি আগে থেকে কিছুই জানতাম না। সবসময় যেভাবে কলেজে যাই, সেভাবেই গিয়েছিলাম। বাইরে থেকে আসা একদল লোক এসে বলল, বোরকা পরে কলেজের ভেতরে যাবে না। ভেতরে যেতে হলে বোরকা ও হিজাব খুলে যেতে হবে। যদি বোরকা পরে থাকতে চাও, তবে বাড়ি ফিরে যাও। মুসকান বলে, ভেবেছিলাম চুপচাপ চলে যাব। কিন্তু তারা শ্লোগান দিয়ে বলতে থাকে, ‘বোরকা গাড়, জয় শ্রী রাম’। তারা ছিল ৪০ জনের মতো। আমি ছিলাম একা। কারো মধ্যে আমি মনুষ্যত্ব লক্ষ্য করিনি। হঠাৎ তারা আমার কাছে এসে চিৎকার করতে লাগল। কারো কারো হাতে ছিল কমলা রঙের স্কার্ফ। আমার মুখের সামনে স্কার্ফ দোলাতে দোলাতে বলতে লাগলো, জয় শ্রী রাম, চলে যাও, বোরকা খুলে ফেলো। মুসকান বলে, আমি যখন ভয় পাই, তখন আল্লাহর নাম নেই। এ কারণে আমি ‘আল্লাহু আকবার’ বলে তাদের সামনে ছুটে যাই। মুসকানের এই ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনিই দাবানলের মতো সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। মুসকানের এই প্রতিবাদ যেমন স্ফুলিঙ্গ হয়ে উঠে, তেমনি আসামে এক মুসলমানকে হত্যা করে তার লাশের উপর এক ফটোগ্রাফের নৃত্য দৃশ্যও সারাবিশ্বে তোলপাড় সৃষ্টি করে। ভারতে কীভাবে মুসলমান নিধন, নিপীড়ন ও নির্যাতন এসব তারই প্রমাণ দিচ্ছে।
দুই.
ভারতে ইসলাম ও মুসলমান বিদ্বেষ নতুন কিছু নয়। মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে তা এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, মুসলমানদের সেখানে প্রতিনিয়ত টিকে থাকার সংগ্রাম করতে হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই উগ্র হিন্দুদের দ্বারা মুসলমানরা নিগৃহীত ও হত্যার শিকার হচ্ছে। একটি দেশের সরকার যখন রাষ্ট্রীয়ভাবে অন্য ধর্মাবলম্বী নাগরিকদের প্রতি নিপীড়নকে প্রশ্রয় দেয়, তখন তাদের দুর্দশার অন্ত থাকে না। রাষ্ট্রীয়ভাবে আইন করে যদি নির্দিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের দেশ থেকে বিতাড়নের উদ্যোগ নেয়, তখন সেসব নাগরিক রাষ্ট্রবিহীন হয়ে উদ্ভাস্তু হয়ে পড়ে। পৃথিবীতে তাদের যাওয়া এবং থাকার কোনো জায়গা থাকে না। ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদী বিজেপি ক্ষমতায় এসেই মুসলমানদের টার্গেট করে তাদের উচ্ছেদে এক ধরনের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকে উসকে দিয়েছে। তার সমর্থক বিভিন্ন উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন ভারতকে শুধু হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য নানা ছুঁতোয় মুসলমানদের ওপর আক্রমণ, হত্যা ও নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে নাগরিকত্ব আইন করে মুসলমানদের বিতাড়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে দেশটির বিভিন্ন রাজ্যে মুসলমানদের ধর্মীয় কাজে বাধা এবং উচ্ছেদ প্রক্রিয়া শুরু করেছে। অবশ্য বিজেপি’র এই উগ্রতা পুরনো। ২০০২ সালে নরেন্দ্র মোদি যখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তখন একটি ট্রেনে আগুন লাগিয়ে ৫৮ জন তীর্থ যাত্রীকে পুড়িয়ে মারা হয়। গুজব রটিয়ে দেয়া হয়, মুসলমানরা আগুন লাগিয়েছে। সে সময় পুরো গুজরাটে উগ্র হিন্দুরা মুসলমানদের ওপর হায়েনার মতো ঝাপিয়ে পড়ে। গর্ভবতী মুসলমান নারীর পেট কেটে বাচ্চা বের করে হত্যা করে, নারীদের গণধর্ষণ করে। শিশুদের পুড়িয়ে হত্যা করে। নারী-পুরুষকে বিব্রস্র করে হত্যাযজ্ঞ চালায়। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দেয়। সে সময় প্রায় ২ হাজারের বেশি মুসলমানকে হত্যা করা হয়। দাঙ্গা আহমেদাবাদসহ অন্য রাজ্যগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। আহমেদাবাদে তিন মাস ধরে চলে মুসলমানদের ওপর হত্যা ও নির্যাতন। এই দাঙ্গার পেছনে মোদির হাত ছিল বলে অভিযোগ উঠে। তখন গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনেও মোদির হাত থাকার কথা উঠে আসে। তার বিরুদ্ধে মামলাও হয়। ক্ষমতায় আসার পর ২০১৪ সালে মামলা থেকে তিনি অব্যাহতি পান। সে সময় মোদির ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দেয়। সেই মোদিই যখন জাতীয় নির্বাচন করেন, তখন মুসলমানরা ভেবেছিল, মোদি ক্ষমতায় এলে হয়তো তাদের জন্য ভালো হবে। কিন্তু তাদের সেই ধারণা ভুল প্রমাণ করে মোদি তার উগ্র হিন্দুত্ববাদী মনোভাবই বজায় রাখেন। ধর্মনিরপেক্ষ ভারতকে শুধু হিন্দুদের দেশে পরিণত করার উদ্যোগ নেন। তার দলের কোনো কোনো নেতা এমনও বক্তব্য দেন, ভারতে শুধু হিন্দুরাই থাকতে পারবে। তাদের এই ধরনের উস্কানিমূলক বক্তব্য উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের আরও বেপরোয়া করে তুলেছে। দেশটিতে মুসলমানরা তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত হয়েছে। উগ্র হিন্দুরা তো বটেই রাষ্ট্রীয়ভাবেও তাদের ধর্ম-কর্ম পালনে প্রতিনিয়ত বাধা দেয়া হচ্ছে। কোনো কোনো রাজ্যে কোরবানি দেয়া, জুমার নামাজ ও মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসব নিষিদ্ধের কথা বলা হচ্ছে। মুসলমান শাসনামলে নির্মিত মসজিদ ও বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। কখনো কখনো মুসলমানরা প্রতিবাদ করতে গেলে তাদের ওপর অকথ্য নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। এখন নতুন করে তারা মুসলমানদের পোশাক পরার ক্ষেত্রে বাধা দিচ্ছে। মুসলমানদের ওপর নিপীড়ন ও ভয়-ভীতি দেখিয়ে বিতাড়ন করার জন্য যত ধরনের উছিলা পাওয়া যায়, তার সবই উগ্র হিন্দুরা ব্যবহার করছে। মুসকান খান পরিস্থিতিতে প্রতিবাদ করেছে এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না। মুসলমানদের পিঠ কতটা দেয়ালে ঠেকে গেছে। মুসকান নিজেই বলেছে, সে অনেক আগে থেকেই হিজাব পরত। হিজাব পরেই ক্লাস করতেন। তখন কোনো সমস্যা হয়নি। নতুন করে বাধার সম্মুখীন হয়েছে। তার কথা থেকে বোঝা যায়, মাঝে মাঝে বিরতী দিয়ে উগ্র হিন্দুরা মুসলমানদের দমনে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। মুসকানের ঘটনার পর রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রীও অনেকটা উগ্র হিন্দুদের সমর্থন করে হিজাবের বিরোধিতা করেছেন। তিনি বলেছেন, ড্রেসকোড অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের ক্লাসে যেতে হবে। এতদিন এ কথা না বলে হঠাৎ হিজাবের বিরোধিতা করে তার এ বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, রাষ্ট্রীয়ভাবেই মুসলমানদের নিপীড়ন করা হচ্ছে।
তিন.
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মুসলমান হত্যা, নিপীড়ন ও নির্যাতন বহু বছর ধরেই চলছে। এর মূল কারণ হচ্ছে, ইসলামের অদম্য ও দ্রুত অগ্রযাত্রা। এতে অন্য ধর্মবলম্বী বিশেষ করে প্রভাবশালী পশ্চিমা দেশগুলো উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে। তাদের ইসলামোফোবিয়া পেয়ে বসেছে। এজন্য ইসলাম ও মুসলমানদের দমানোর জন্য তারা নিজেরাই নিজেদের ওপর হামলা চালিয়ে এর দায় মুসলমানদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ ও ঘৃণা ছড়িয়ে দেয়ার নানা এজেন্ডা নিয়ে কাজ করছে। একশ্রেণীর বিপদগামী মুসলমান দিয়ে জঙ্গী ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সৃষ্টি করে এবং হামলা চালিয়ে এক ধরনের কূটকৌশল অবলম্বন করে চলেছে। আল কায়দা থেকে শুরু করে আইএস যে, তাদের সৃষ্টি এবং মদদপুষ্ট তা এখন প্রমাণিত। এদের দমনের নামে জোট বেঁধে হামলা চালিয়ে আফগানিস্তান থেকে শুরু করে ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়ার মতো সমৃদ্ধ মুসলমান দেশ ধ্বংস করে দিয়েছে। এসব দেশের বেশিরভাগ মুসলমানকে উদ্ভাস্তুতে পরিণত করেছে। মিয়ানমার তো পুরো রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর হামলা ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে দেশছাড়া করে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, পশ্চিমা দেশগুলোতে কোনো সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটলে, তা মুসলমানরা করেছে বলে ব্যাপক প্রচারণা চালায়। পাশাপাশি সেসব দেশে বসবাসকারী মুসলমানদের নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। মুসলমান নারীদের হিজাব পরা নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোতে বিতর্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে। ফ্রান্স, জার্মানিসহ অন্যান্য দেশে হিজাব নিষিদ্ধের কথা বলা হয়েছে। এর বিরুদ্ধে সেখানের মুসলমান নারীরা প্রতিবাদ করেছে এবং করছে। ফ্রান্সে ’৮০ দশকের শেষ দিকে মুসলমান নারীদের হিজাব পরা নিয়ে প্রথম বিতর্ক শুরু হয়। দেশটি ধর্মনিরপেক্ষ হওয়ায় কোনো বিশেষ ধর্মের পোশাক পরা যাবে না, এমন যুক্তিতে কিছু মানুষ এ বিতর্কের সূচনা করে। ফরাসী প্রেসিডেন্ট জ্যাঁক শিরাক স্কুলে হিজাব নিষিদ্ধ করে সংসদে আইন পাশ করেন। আইন ঠেকাতে ‘আমার পছন্দ’ ব্যানার নিয়ে প্যারিসে মুসলমান নারীরা ব্যাপক বিক্ষোভ ও সমাবেশ করে। ফ্রান্স সরকার ২০০৪ সালে সব সরকারি স্কুলে হিজাব এবং অন্যান্য ধর্মীয় পরিচয় বহনকারী বিষয় নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে বহু মুসলিম মেয়ের স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। মুসলিম কিশোরীদের শিক্ষাজীবনে নেমে আসে অন্ধকার। নানাভাবে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ ও প্রশ্নবাণে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে মুসলিম নারীদের দৈনন্দিন জীবন। ফরাসী সংসদে এই পদক্ষেপ গ্রহণের প্রস্তাব উত্থাপন করেছিল সেসময় ক্ষমতাসীন মধ্য-ডানপন্থী দল। তাদের যুক্তি ছিল, স্কুলের ভেতর ধর্মকে আনা যাবে না। সংসদ স্কুল ছাত্রীদের হিজাব পরা নিষিদ্ধ করার পক্ষে ভোট দেয়ার পর মুসলিম ছাত্রীরা বলেছিল, তাদের কাছে পড়ার বই আর হিজাব দুটোই তাদের পরিচয়ের অংশ। অনেক কিশোরী বলেছিল, হিজাব তাদের শরীরের অবিচ্ছেদ্য অংশ, তাদের ব্যক্তিসত্ত্বার অংশ। স্কুলে ঢোকার পর সেটা খুলতে বাধ্য করা তাদের ব্যক্তিসত্ত্বার অপমান। ফ্রান্সে বর্তমানে ৫০ লাখের বেশি মুসলমান নাগরিক। এ সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে দেশটির সরকারের উদ্বেগ বেড়েছে। এ নিয়ে ২০২০ সালে বর্তমান প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁ উদ্বেগও প্রকাশ করে বলেন, ফ্রান্সের ঐক্যের প্রধান বন্ধনই হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা। যারা ধর্মের নামে সেখানে ফাটল ধরাতে চায় তাদের বিরুদ্ধে লড়তে হবে। ইসলামি স্কুলগুলোর ওপর নজরদারি বাড়ানো হবে। তার এ বক্তব্য সে সময় ব্যাপক সমালোচিত হয়। অনেকে তার এ বক্তব্যকে ইসলামবিদ্বেষ হিসেবে অভিহিত করেন। মুসলমানদের নিয়ে ফ্রান্স সরকারের এ উদ্বেগের মূল কারণ হচ্ছে, ইসলামের অব্যাহত অগ্রযাত্রা। শুধু ফ্রান্স নয়, জার্মানিসহ ইউরোপের অন্যদেশগুলোতেও মুসলমানের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ব্যাপক সংখ্যক মানুষ অন্য ধর্ম থেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছে। এটা দেশগুলোর জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক জরিপে বলা হয়েছে, বর্তমান বিশ্বে অন্য ধর্ম থেকে ইসলাম ধর্মে দিক্ষিত হওয়ার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল ধর্মের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে ইসলাম। যেখানে বিশ্ব জনসংখ্যার তুলনায় খ্রিস্টান জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৩৮ শতাংশ, সেখানে মুসলমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৮৪। ২০৬০ সালে বিশ্বে মুসলমান জনসংখ্যা ৩০০ কোটি হবে। মুসলমানরা হবে দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতি। ইসলাম ও মুসলমানদের এই ক্রমবর্ধমান সম্প্রসারণ বিশ্বের অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের কাছে ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা ভীত হয়ে পড়ছে। এ কারণে, ইসলাম ও মুসলমানের অগ্রযাত্রা রুখতে তারা নানাভাবে অপবাদ দিয়ে ঘৃণা, বিদ্বেষ ও বাধা সৃষ্টি করছে। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, এতকিছু সত্ত্বেও ইসলামের অগ্রযাত্রা আরও গতি পেয়েছে। পরাশক্তির দেশগুলো খোঁড়া যুক্তি দেখিয়ে ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়াকে ধ্বংস স্তুপে পরিণত এবং দেশগুলোর জনগণকে উদ্বাস্তুতে পরিণত করলেও তারা এখন ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এটাও পশ্চিমা বিশ্বের জন্য হিতে বিপরীত হয়ে উঠেছে। দেশগুলোতে এখন মুসলমানদের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, ইসলামের অগ্রযাত্রা থামাতে পশ্চিমা বিশ্ব থেকে শুরু করে অন্যান্য দেশ যত বাধা দিচ্ছে, ইসলামের গুরুত্ব ও জীবনধারার প্রতি অন্য ধর্মাবলম্বীদের আগ্রহ তত বাড়ছে এবং তারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছে। পিউ রিসার্চ সেন্টারের জরিপ অনুযায়ী, ইসলাম ধর্মে কনভার্ট বা দিক্ষিত হওয়ার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত পত্রিকা নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর ৩০ হাজার মানুষ অন্য ধর্ম ত্যাগ করে মুসলমান হচ্ছে। দেশটির জনসংখ্যার শতকরা ২৫ ভাগ হচ্ছে ধর্মান্তরিত মুসলমান। জার্মানিতে প্রতি বছর বহু মানুষ মুসলমান হচ্ছে। বিগত কয়েক বছরে এক লাখের বেশি জার্মান নাগরিক মুসলমান হয়েছে। জার্মানিতে এখন ‘বিয়িং জার্মান: বিকামিং মুসলিম’ বা ‘জার্মানি হিসেবে মুসলমান হও’ শ্লোগানটি বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডেও প্রতি বছর বহু মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছে। ভারতেও দিন দিন মুসলমানের সংখ্যা বাড়ছে। বর্তমানে দেশটিতে প্রায় ২৫ কোটি মুসলমান বসবাস করছে। মুসলমানের এই সংখ্যা বৃদ্ধিই উগ্র হিন্দুত্ববাদী ও ক্ষমতাসীন বিজেপি’র জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ কারণে দমন, পীড়ন, দাঙ্গা, হত্যা ও নানা ধরনের বাধা দিয়ে মুসলমানদের অগ্রযাত্রা থামিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা তারা চালিয়ে যাচ্ছে। সর্বশেষ হিজাব পরতে বাধা দেয়ার মাধ্যমে তাদের উগ্রতার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে।
চার.
মুসকান খানের হিজাব পরতে বাধা দেয়া ও ফ্রান্সসহ অন্যান্য দেশে মুসলমান নারীদের হিজাব পরা নিষিদ্ধ করা, ইসলামের দ্রুত সম্প্রসারণ এবং মুসলমান হওয়ার গতি নিয়ে এই নিবন্ধে সংক্ষিপ্ত পরিসরে আলোচনা করতে চেষ্টা করেছি। নিবন্ধটি শেষ করব হিজাব পরা নিয়ে একটি ছোট্ট ঘটনা দিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন, মুসলিম নারী ড. ডালিয়া মুজাহিদ। তিনি সবসময় হিজাব ও শালীন পোশাক পরতেন এবং সাংবাদিকের সামনে হাজির হতেন। এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এই পোশাক পরে হাজির হলে সাংবাদিকরা বিস্মিত হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে এমন ধারণা বদ্ধমূল ছিল, হিজাব হচ্ছে অনগ্রসরতা, মুর্খতা ও সেকেলে ধ্যান-ধারণার প্রতীক। তারা ড. ডালিয়া মুজাহিদের উদ্দেশ্যে গভীর বিস্ময়ে মন্তব্য করেছিলেন, আপনার বেশ-ভূষা ও পোশাক-পরিচ্ছদের মধ্যে আপনার উচ্চ শিক্ষা ও জ্ঞানের গভীরতা প্রকাশ পাচ্ছে না। ড. ডালিয়া মুজাহিদ সাংবাদিকদের মন্তব্যের জবাবে বলেছিলেন, ‘আদিম যুগে মানুষ ছিল প্রায় নগ্ন। শিক্ষা ও জ্ঞান চর্চার উন্নতির সাথে সাথে পোশাক পরিধান করে সভ্যতার উচ্চ শিখরে আরোহণ করতে থাকে। আমি যে পোশাক পরিধান করেছি, তা শিক্ষা ও চিন্তাশীলতায় উন্নতি ও সভ্যতার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। নগ্নতা ও উলঙ্গপনাই যদি উন্নত শিক্ষা ও সভ্যতার চিহ্ন হতো, তাহলে বনের পশুরাই হতো পৃথিবীর সবচেয়ে সুসভ্য ও সুশিক্ষিত।’
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।