Inqilab Logo

মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

হিজাব নিষিদ্ধ করা নিয়ে বিক্ষোভ যেভাবে ছড়িয়ে পড়লো সারা ভারতে

অনলাইন ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১২:৫০ পিএম

ভারতের কর্নাটক রাজ্যে হাইস্কুল ও কলেজে মুসলিম মেযেদের হিজাব পরে ক্লাসে আসা নিষিদ্ধ করা, আর এ নিয়ে গেরুয়া স্কার্ফ-ধারী হিন্দুত্ববাদীদের সাথে সংঘাতকে কেন্দ্র করে হঠাৎ সারা দেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে।

কর্নাটক রাজ্যের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে বিক্ষোভ, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কোলকাতা শহরেও বুধবার শত শত শিক্ষার্থী হিজাব নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদে মিছিল করেছে। এরই মধ্যে অনলাইনে ভাইরাল হয়েছে একটি ভিডিও - যাতে দেখা যাচ্ছে কর্নাটক রাজ্যের এক কলেজে কালো বোরকা আর হিজাব পরা এক মুসলিম ছাত্রীকে 'জয় শ্রীরাম' বলে শ্লোগান দিয়ে হয়রানি করছে গেরুয়া কাপড়-ধারী একদল হিন্দুত্ববাদী তরুণ, আর ছাত্রীটিও তাদের পাল্টা জবাব দিচ্ছেন 'আল্লাহু আকবর' শ্লোগান দিয়ে।

নানা প্ল্যাটফর্মে ব্যাপকভাবে শেয়ার হওয়া ভিডিওটি শুধু টুইটারেই ২০ লাখেরও বেশিবার দেখা হয়েছে, এ নিয়ে মন্তব্য, লাইক আর শেয়ারের সংখ্যা অগণিত। এ নিয়ে তুমুল বিতর্কে যোগ দিয়েছেন রাজনীতিবিদরা, কথা হচ্ছে ভারতের বাইরেও - মালালা ইউসুফজাইএর মত নারী অধিকারকর্মীও এ নিয়ে টুইট করেছেন। বিবিসি হিন্দির সংবাদদাতা ইমরান কুরেশি জানাচ্ছেন, ঘটনার শুরু হয় কর্নাটক রাজ্যের কুন্ডাপুর সরকারি পিইউ কলেজ থেকে।

এই কলেজটির ছয়জন মুসলিম ছাত্রী অভিযোগ করেন যে তাদেরকে কয়েক সপ্তাহ ধরে ক্লাস করতে দেয়া হচ্ছে না - কারণ তারা ছাত্রীদের নির্দিষ্ট ইউনিফর্ম ছাড়াও মাথায় হিজাব পরবেন বলে দাবি জানাচ্ছিলেন। এই ছয় ছাত্রীর একজন আলমাস এ এইচ বিবিসিকে বলেন, তোদের কয়েকজন পুরুষ শিক্ষক আছেন, তাই তাদের সামনে মাথার চুল-ঢাকা পোশাক পরা দরকার - এবং এ কারণেই তারা হিজাব পরছেন।

সরকারি কলেজটির কর্তৃপক্ষ অবশ্য বলছে, তারা শুধু ক্লাসে হিজার না পরতে বলেছেন, ক্লাসের বাইরে কলেজ ক্যাম্পাসে ছাত্রীদের হিজাব পরতে কোন বাধা নেই। উদুপি জেলার এ কলেজের হিজাব-পরা একদল ছাত্রীকে ঢুকতে না দিয়ে গেট বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে - গত সপ্তাহে এমন এক ঘটনার ভিডিও ও ছবি ইন্টারনেটে ভাইরাল হয়। এর পর কর্নাটক রাজ্যের অন্যান্য হাইস্কুল ও কলেজেও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। কিছু কলেজে হিন্দু ছাত্ররা গেরুয়া শাল বা স্কার্ফ পরে ক্লাসে আসতে শুরু করে। হিন্দু ছাত্র ও ছাত্রীরা তাদেরই সহপাঠীদের হিজাব পরার বিরুদ্ধে মিছিল বের করে।

কর্নাটক রাজ্যের কয়েকটি শহর থেকে বেশ কিছু সহিংসতার খবর পাওয়া গেছে। ভাইরাল ভিডিওর আলোচিত ছাত্রীটির নাম বিবি মুসকান খান। ভিডিওর শুরুতে তাকে দেখা যায় তিনি নিজে মোটরবাইক চালিয়ে মান্ডিয়া জেলায় পিইএস কলেজ ক্যাম্পাসে ঢুকছেন। মোটরবাইকটি পার্কিং এ রেখে কলেজ ভবনের দিকে যাবার সময় গেরুয়া স্কার্ফধারী একদল তরুণ তার উদ্দেশ্যে 'জয় শ্রীরাম' শ্লোগান দিতে থাকে। তখন মুসকানও পাল্টা 'আল্লাহু আকবর' বলে শ্লোগান দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকেন। কয়েক মুহূর্ত পরই কলেজের কয়েকজন শিক্ষককে এসে পরিস্থিতি সামাল দেবার চেষ্টা করতে দেখা যায়।

টুইটারে এই ভিডিও নিয়ে জয়@জয়দাস বলে একজন মন্তব্য করেন "আজকের দিনের সবচেয়ে শক্তিশালী ছবি এটি। একেই বলে সাহস।" তেহসিন পুনেওয়ালা নামে একজন টুইট করেন, "আমার মেয়ে হিজাব বা বিকিনি -যাই পরতে চায়, এটা তার ইচ্ছা। ...বিজেপি 'চয়েস' কথাটা বোঝে না কেন? ট্র্যাশমাউথ নামে আরেকজন অবশ্য মন্তব্য করেন, "স্কুলের ইউনিফর্ম থাকে। এটা চয়েসের ব্যাপার নয়।"

মঙ্গলবার এ নিয়ে টুইট করেন পাকিস্তানে মেয়েদের স্কুলে যাবার অধিকারের কথা বলার কারণে তালেবানের হাতে গুলিবিদ্ধ হবার পরও বেঁচে যাওয়া মালালা ইউসুফজাই। নোবেলজয়ী মালালা মন্তব্য করেন, "হিজাবের কারণে মেয়েদের স্কুলে যেতে না দেয়াটা ভয়াবহ ব্যাপার। মেয়েরা কম বা বেশি যতটুকুই কাপড় পরুক - তাদের পণ্য হিসেবে দেখাটা চলছেই। ভারতের নেতাদের অবশ্যই মুসলিম মেয়েদের মার্জিনালাইজ করা বন্ধ করতে হবে।" ভারতের বিরোধীদল কংগ্রেসের প্রিয়াংকা গান্ধী টুইট করেন, "বিকিনি হোক, ঘোমটা হোক, জিন্স হোক আর হিজাবই হোক, মেয়েরা কি পরবে তা ঠিক করার অধিকার তাদেরই। এই অধিকার ভারতের সংবিধানে সংরক্ষিত। নারীদের হয়রানি করা বন্ধ করুন।''

রাজ্যের কয়েকটি কলেজ মুসলিম ছাত্রীদের হিজাব পরাকে তাদের ইউনিফর্ম নীতিবিরুদ্ধ বলে ক্লাসের ভেতর হিজাব পরা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। উদুপির এক কলেজে হিজাব পরা কিছু ছাত্রীকে প্রথমে ক্যাম্পসে ঢুকতে দেয়া হয়নি - পরে ঢুকতে দেয়াহলেও তাদেরকে কোন ক্লাসে অংশ না নিয়ে আলাদা একটি কক্ষে বসে থাকতে বলা হয়। কলেজ কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে ক্ষোভ-সমালোচনা এবং প্রতিবাদ বৃদ্ধি পেলে রাজ্যের কর্তৃপক্ষ তিন দিনের জন্য সব হাইস্কুল এবং কলেজ বন্ধ করে দেয়।

কর্নাটক রাজ্যের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে মুসলিম মেয়েদের হিজার পরা নিয়ে বেশ কিছুকাল ধরেই সমস্যা চলছিল। কয়েকজন মুসলিম নারীর পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে ওই রাজ্যের হাইকোর্টে দুটি আবেদন করা হয়। বুধবার আদালত প্রধান বিচারপতিকে অনুরোধ করে যেন তিনি এ বিষয়টির নিষ্পত্তি করার জন্য একটি বৃহত্তর বেঞ্চ গঠন করেন। মঙ্গলবার এ সংক্রান্ত একটি মামলার শুনানী শুরু হবার কিছু আগে শুরু হয় সহিংসতা।

কিছু শহর থেকে ইটপাটকেল ছোঁড়া এবং অগ্নিসংযোগের খবর পাওয়া যায়। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ কিছু এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করেছে। শিভামোগা জেলায় একদল ছাত্রকে তাদের কলেজে একটি গেরুয়া পতাকা উত্তোলন করতে দেখা যায়। এর পর রাজ্য সরকার ঘটনাটির তদন্ত করার কথা ঘোষণা করে। রাজ্যের কিছু কিছু জায়গায় পাথর নিক্ষেপকারী প্রতিবাদকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ লাঠিচার্জ করেছে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বাসবরাজ বোম্মাই শান্তি ও সৌহার্দ্য বজায় রাখার জন্য আবেদন করেছেন।

সরকার যে পরিস্থিতি মোকাবেলায় আগে থেকে ব্যবস্থা নেয়নি, সেজন্যে অনেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় সমালোচনা করছেন। অধিকারকর্মীরা বলছেন, হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপি-শাসিত রাজ্যটিতে সংখ্যালঘু মুসলিমদের ক্রমাগত যে হয়রানি হচ্ছে - এটি তারই সবশেষ দৃষ্টান্ত। বিবিসির সংবাদদাতা ইমরান কুরেশি জানাচ্ছেন, এ ঘটনাটি যে উদুপি জেলায় ঘটছে তা-ও গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি কর্নাটক রাজ্যের সাম্প্রদায়িকভাবে স্পর্শকাতর উপকুলীয় এলাকার একটি জায়গা।

অনেকে বলেন, এটি হচ্ছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দক্ষিণপন্থী দল বিজেপি-র একটি শক্ত ঘাঁটি, এবং হিন্দু-জাতীয়তাবাদী রাজনীতির একটি ল্যাবরেটরি। কর্নাটক রাজ্যেও এখন বিজেপি ক্ষমতায়। এই এলাকাতে বেশ কিছুকাল ধরে হিন্দুত্ববাদী কর্মীদের তৎপরতা এবং ঘৃণাসূচক বক্তব্যের কারণে ধর্মীয় বিভক্তি গভীর হয়েছে। এর ফলে আবার সংখ্যালঘু নেতৃত্বাধীন কিছু গোষ্ঠীর উত্থান হয়েছে - যারা ধর্মীয় স্বাধীনতার ব্যাপারে তাদের অধিকারের ব্যাপারে উচ্চকণ্ঠ।

ইমরান কুরেশি জানাচ্ছেন, এই কলেজ-হিজাব ইস্যুটি আরো জটিল হয়েছে এর সাথে "ক্যাম্পাস ফ্রন্ট অব ইন্ডিয়া" বা সিএফআই জড়িত হবার কারণে। এই সিএফআই হচ্ছে একটি উগ্র ইসলামপন্থী গোষ্ঠী পপুলার ফ্রন্ট অব ইন্ডিয়া বা পিএফআইএর ছাত্র সংগঠন। ক্লাসে হিজাব পরার জন্য দাবি-জানানো ছাত্রীদের একজন আলমাস বলছেন, তিনি সিএফআইএর সদস্য নন - কিন্তু তার কলেজ যখন হিজাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় তখন তিনি সিএফআইয়ের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন। মিজ আলমাস আরো বলেন, কলেজের প্রথম বর্ষেই তারা হিজাব পরতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তখন তাদের বলা হয়েছিল যে তাদের অভিভাবকরা একটি ফরমে সই করেছেন - যাতে এ ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আছে।

কলেজটির অধ্যক্ষ রুদ্র গৌড়া বলেন, স্কুলে প্রায় ৭০ জন মুসলিম শিক্ষার্ধী আছে তারা ইউনিফর্মের নিয়ম মেনে চলছে, এবং তার ভাষায় "শুধু ৬ জন মেয়ে উদ্দেশ্যমূলকভাবে সমস্যা সৃষ্টি করছে।"

তিনি বলছেন, শিক্ষার্থীর মুখ দেখতে পাওয়াটা শিক্ষকের জন্য প্রয়োজনীয়। কিন্তু মিজ আলমাস বলেন, ফরমটিতে শুধু কলেজ ইউনিফর্ম পরার বাধ্যবাধকতার কথা আছে, হিজাবের ব্যাপারে তাতে কিছু বলা নেই। কলেজ কর্তৃপক্ষ বলছে, ক্যাম্পাসে হিজাব ও গেরুয়া স্কার্ফ দুটোই নিষিদ্ধ হওয়া উচিত। রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী নাগেশ বিসি এ অবস্থানকে সমর্থন করেন। তিনি বলছেন, এর পেছনে রাজনীতি আছে। তার মতে "আগামী বছর এ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন আছে, একারণেই এসব ঘটছে।"

২০১৮ সালে প্রতিবেশী কেরালা রাজ্যে দুজন মুসলিম ছাত্রী হিজাব ও লম্বা হাতাওয়ালা জামা পরার আবেদন করলে তাদের স্কুল তা প্রত্যাখ্যান করে। এ ব্যাপারে একটি আদালতে মামলা হলে বিচারপতি এ. মুহাম্মদ মুশতাক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধিকারের পক্ষে রায় দেন। কর্নাটকে এর আগে অন্য আরেক ঘটনায় একটি সরকারি কলেজ তাদের ক্যাম্পাসে মুসলিম ছাত্রীদের হিজাব এবং হিন্দু প্রতীক গেরুয়া স্কার্ফ - দুটিকেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

সিএফআইয়ের একজন নেতা মাসুদ মান্না বলছেন, তাদেরকে কলেজের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে হিজাবকে অনুমোদন দিলে আরেক দল গেরুয়া শাল পরার দাবি তুলবে। কিন্তু এ নিয়ে কলেজ কর্মকর্তা, সরকারের প্রতিনিধি ও বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে একাধিকবার আলোচনা হলেও বিষয়টির নিষ্পত্তি হয়নি। সূত্র: বিবিসি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভারত


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ