পবিত্র লাইলাতুল বরাত
![img_img-1720175346](https://old.dailyinqilab.com/resources/images/cache/169x169x3_1678112525_editorial-inq.jpg)
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
আবহমান কাল থেকে মানুষের মধ্যে জমি-জমা সংক্রান্ত বিরোধ রয়েছে। এই বিরোধকে কেন্দ্র করে সমাজে নানান ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে হতাহতের মতো ঘটনাও ঘটে। জমি-জমার বিরোধকে কেন্দ্র করে, মারামারি-হানাহানির ঘটনায়, কোর্ট-কাচারিতে মামলা-মোকদ্দমার সংখ্যা যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনি বিচার প্রক্রিয়ায় রয়েছে নানবিধ জটিলতা। এ যেন নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। ভাইয়ে-ভাইয়ে, বাবা-সন্তানে, ভাই-বোনের মধ্যকার শত্রুতা, প্রতিবেশির সঙ্গে শত্রুতাসহ নানা ধরণের শত্রুতার পিছনে এই জমি-জমার ব্যাপক ভ‚মিকা রয়েছে। অনেক সময়, নিজের কেনা জমি অন্য কেউ দখল করে মালিকানা দাবি করছে, শরিকানা জমি নিয়েও হচ্ছে পারিবরিক বিরোধ কিংবা জাল দলিল তৈরি করে জমির দখল করা হচ্ছে। আদালতে মিথ্যা মামলাও করে অনেকে।
মামলা গুলো দীর্ঘ সময় চলার থাকার কারণে আর্থিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বহু পরিবার।
সম্পত্তিকেন্দ্রিক বিরোধ নতুন নয়। সামাজিক পরিবর্তন, সমাজের উত্তরণ, পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় অনুপ্রবেশ এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলে সম্পত্তি, জমি-জমার ম‚ল্য গত কয়েক বছরে জ্যামিতিক হারে বেড়েছে। এর ফলে পরিবার থেকে শুরু করে আত্মীয়-স্বজন সব জায়গায় সম্পত্তিকেন্দ্রিক দ্ব›দ্ব আগের তুলনায় অনেক প্রকট। জমি-জমা সংক্রান্ত সংঘটিত অপরাধের সঠিক বিচার পেতেও নানাবিধ জটিলতার মুখে পড়ে অতিবাহিত হচ্ছে সুদির্ঘ সময়, যা এধনের অপরাধ কর্মকান্ডের জড়িতদের উদ্ভুদ্ধ করছে।
জমি সংক্রান্ত বিরোধের অনেক কারণের মধ্যে রয়েছে অজ্ঞতা, সুষ্ঠ বিচার না পাওয়া, আধিপত্যের প্রভাব- যেমন কাগজ আছে, দখল নাই। কারো আবার দখল আছে, কাগজ নাই। কেউ কেউ মামলার রায় পেয়েও পাচ্ছে না দখল। তাৎক্ষণিক প্রতিকারেরও ব্যবস্থা নেই। প্রতিকার পেলেও তা পেতে পার হচ্ছে যুগের পর যুগ। এমনকি মালিকানা প্রমাণে সঠিক কাগজপত্রেরও যেন কোনো ম‚ল্য নেই। অনেকের সঠিক কাগজপত্র থাকা সত্তে¡ও বেদখল হচ্ছে বসতভিটা। ফলে দ্রুতগতিতে বাড়ছে ভ‚মি-অপরাধ। ঘটছে খুন-খারাবি। ফলশ্রুতিতে বিচারাঙ্গনে বাড়ছে মামলার স্তুপ। অতিরিক্ত মামলা উদ্বিগ্ন করে তুলেছে সরকারকেও। দেশে বিদ্যমান ব্যবস্থানুযায়ী, দরিদ্র, নিরীহ ব্যক্তির জমি জবরদখল হলে তারা থানায় ছুটে যান। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেয় জমির মামলা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায় থানা। দেওয়ানি আদালতই ভ‚মি মামলার একমাত্র সমাধান হওয়ায় বিপাকে পড়তে হয় ভুক্তভুগিরা। প্রকৃতপক্ষে জমি জবর দখলের সরাসরি কোনো শাস্তি বিধান দÐবিধিতে নেই। নেই ভ‚মির প্রকৃত মালিকের প্রাথমিক নালিশ করার জায়গাও। পারিবারি হোক আর স্বার্থান্বেষী মহল হোক, মানুষের ম‚ল্যবান জমি-জমা সম্পত্তি কেড়ে নেয়ার প্রবনতা বেড়েছে। ১৮৬০ সালের ফৌজদারি দন্ডবিধিতে চুরির শাস্তি রয়েছে ৩ থেকে ১০ বছর কারাদন্ড, অর্থদন্ড। ডাকাতির শাস্তি সর্বোচ্চ ১৪ বছর কারাদন্ড, অর্থদন্ড। অথচ জমি জবর দখলের সরাসরি কোনো শাস্তি দন্ডবিধিতে নেই। ন্যায় বিচারের স্বার্থে ভ‚মির প্রকৃত মালিকের প্রাথমিক নালিশ করার কোনো প্রতিষ্ঠানও গড়ে ওঠেনি।
পেশী শক্তিতে বলিয়ান পক্ষ আদালতের কার্যক্রম না থাকার সুযোগে অসহায়দের জমি-জমা থেকে উচ্ছেদ করে দিচ্ছে।
জানা যায়, সারা দেশের আদালতগুলোতে ফৌজদারিসহ নানা অপরাধে যত মামলা আছে, তার ৮০ শতাংশই ভুমি নিয়ে। খুন-খারাবির মতো ভয়ানক ঘটনাও ঘটছে ভ‚মি নিয়ে দ্বন্দ্বের কারণে। ফলে দীর্ঘদিনে এই মামলার জটও এখন মহাজটে পরিণত হয়েছে। প্রথা অনুযায়ী, ভ‚মি মালিকানার পক্ষে তিনটি বিষয় আবশ্যক। (১) দলিল (২) দাখিলা এবং (৩) দখলস্বত্ত¡। এ অনুযায়ী, দলিল এবং দাখিলা সত্তে¡ও কেবলমাত্র দখল না থাকলে তা, চতুর, ক্ষমতাধর ভ‚মিদস্যুই পাবে মালিকানা। কখনো কখনো অন্যায়-অবিচারের শিকার দখচ্যুত ভ‚মি মালিক ভ‚মি-প্রশাসনের কোনো পরিষেবাই পাচ্ছেন না। আইনি ফাঁক- ফোঁকড়ে সারাদেশে ভ‚মিদস্যুরা পরিকল্পিতভাবে জাল কাগজ তৈরি, ত্রাস সৃষ্টির মাধ্যমে জমি জবরদখল করছে। এদের অধিকাংশই রাজনৈতিক মদদপুষ্ট। তারা মানছে না গ্রাম আদালতের সালিশ। চলে যাচ্ছে দেওয়ানি আদালতে। দখলদারিত্বের পক্ষে ‘স্থিতি আদেশ’ এনে দখলস্বত্ব বজায় রেখে ভোগ করছে সুবিধা। বিদ্যমান ব্যবস্থানুযায়ী, দরিদ্র, নিরীহ ব্যক্তির জমি জবরদখল হলে থানায় ছুটে যান। থানা বলে দেন, এটি জমি জমার বিষয়। দেওয়ানি মামলা। বর্তমানে সারাদেশে বিচারাধীন দেওয়ানি মামলার সংখ্যা ১৪ লাখের উপরে। বিভিন্ন তথ্যে উঠে এসেছে, এর মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে ১৩ হাজার ১৯৯টি এবং হাইকোর্টে ৯৫ হাজার ৬২৪টি দেওয়ানি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। বাকি ১৩ লাখ ২১ হাজার ৩৮টি মামলাই বিচারাধীন রয়েছে অধিনস্ত আদালতগুলোতে।
জমি কিংবা বসতভিটার সীমানা সংক্রান্ত জটিলতা নিয়ে দেশে বিরোধ, দুর্বলে সম্পত্তি জবর-দখল, সরকারী খাস জমি, পুকুর, খাল, নদ-নদী ও জলাশয় দখল করে দোকানপাট ও মার্কেট নির্মান, জোর প‚র্বক উচ্ছেদ করা, ভয়-ভীতি প্রদর্শন করা, অন্যের সীমানার ওপর বাড়ি-ঘর নির্মান করাসহ সমাজে জুলুম-নির্যাতন ও দখল বেদখলের ঘটনা অহরহই ঘটছে। ভ‚মি দস্যুতার ভয়াবহ প্রভাব সমাজ, পরিবার ও পরিবেশকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। ভ‚মি দস্যুতার কবলে পড়ে, অনেকে গৃহহীন হয়ে পড়েছেন। জাল-দলিল তৈরী করে কিংবা ভ‚য়া আম-মোক্তার সেজে জমি ক্রয়-বিক্রয় করার মতো ঘটনা অহরহই ঘটছে। যারা এ ধরনের প্রতারণার সাথে সম্পৃক্ত থাকবে কিয়ামতের দিন তাদেরকে শাস্তি ভোগ করতে হবে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, হযরত মুহম্মদ (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘জুলুম’ কিয়ামতের দিন অন্ধকার রূপ ধারণ করবে। ( বোখারি:২২৮৫)।
মামলার পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রতিনিয়ত উচ্চ আদালত থেকে নিম্ন আদালত পর্যন্ত বিচারাধীন সব ধরনের মামলার সংখ্যা বেড়ে চলেছে। মামলার সংখ্যা যত বাড়ছে, তত বাড়ছে বিচার প্রার্থীদের দুর্ভোগ। সম্প্রতি সরকার নানাবিধ সমস্যা সমাধানের লক্ষে ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে এ সকল জমি জমা সংক্রান্ত বিষয়াদি সহজ করতে জনগণের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে। খাজনা, পর্চা, দাখিলা, নামজারিতে নিয়ে এসেছে সচ্ছতা, যা প্রসংশনীয় ।
লেখকঃ সাংবাদিক।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।