চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
মাওলানা এইচ এম গোলাম কিবরিয়া রাকিব
॥ দুই ॥
অভিভাবকের কর্তব্য হলো : ১. সাত বছর বয়স শুরু হলেই শিশুদের নামাজ পড়তে অভ্যস্ত করতে হবে;
২. দশ বছর বয়স শুরু হওয়ার পরও নামাজ পড়ায় শিথিলতা লক্ষ্য করলে তাদেরকে উপদেশ দিয়ে, নির্দেশ দিয়ে এবং শাসন করে নামাজে অভ্যস্ত করতে হবে; এবং ৩. মাতা-পিতার বিছানা থেকে তাদেরকে ভিন্ন বিছানায় শোয়াবে এবং ছেলে ও মেয়ের বিছানাও পরস্পর পৃথক করে দিতে হবে।
শিশুদের কোরআন শিক্ষা দেয়া : বিশেষ করে নামাজ পড়তে হলে কোরআন মাজিদের কিছু সূরা অবশ্যই মুখস্থ করতে হয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) শিশুকাল থেকে কোরআন পড়া শেখানোর নির্দেশ দিয়েছেন। হযরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত। নবী (সা.) বলেন, “তোমাদের সন্তানদের তিনটি গুণ গুণান্বিত কর-(১) তোমাদের নবীর প্রতি ভালোবাসা, (২) তাঁর পরিবার ও বংশধরের প্রতি ভালোবাসা এবং (৩) কোরআন তিলাওয়াত শিক্ষা দেয়া। কেননা কোরআনের জ্ঞান বহনকারী আল্লাহর আরশের ছায়ায় অবস্থান করবে, যেদিন তার ছায়া ব্যতীত আর কোনো ছায়া বিদ্যমান থাকবে না”।
মাতা-পিতার কামরায় প্রবেশের নিয়ম : ছেলে-মেয়েদের জ্ঞান-বুদ্ধি বাড়ার সাথে সাথে পিতা-মাতাকে অধিক সতর্ক হতে হয়, সাবধান হতে হয়। স্বামী-স্ত্রী সুলভ গোপনীয় কোনো আচরণ যেন সন্তানদের দৃষ্টিগোচর না হয় সে ব্যাপারে আরো বেশি সতর্ক থাকতে হয়। তাদের শোয়ার ঘরে ছেলেমেয়েরা প্রবেশ করতে চাইলে বিশেষভাবে তিনটি সময়ে অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করবে। আল্লাহতায়ালার বাণী :
“হে ঈমানদারগণ! তোমাদের অধীনস্থ দাস-দাসীগণ এবং তোমাদের মধ্যে যারা নাবালেগ তারা যেন তিনটি সময়ে তোমাদের কক্ষে প্রবেশ করার জন্য অনুমতি চায় : ফজরের নামাজের পূর্বে (ভোরবেলা), দুপুরে যখন তোমার তোমাদের পোশাক খুলে রাখ এবং এশার নামাজের পর। এ তিনটি হলো তোমাদের গোপনীয় সময়” (সূরা নূর : ৫৮)।
“আর তোমাদের শিশুদের জ্ঞানের উন্মেষ হলে তারাও যেন অনুমতি প্রার্থনা করে যেমন অনুমতি প্রার্থনা করে থাকে তাদের বড়োরা” (সূরা নূর : ৫৯)।
শিশুদের সাথে সদয় ব্যবহার : বিভিন্ন সময় শিশুরা আমাদের বিভিন্নরূপ সেবা দিয়ে থাকে। তাদের সাথে সদয় ব্যবহার করতে হবে। হযরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) বলেন, “আমি মদিনায় দশ বছর যাবৎ মহানবী (সা.)-এর খেদমত করেছি। তখন আমি ছিলাম বালক। সাব কাজ তিনি আমাকে দিয়ে করাতে চাইতেন আমি সেভাবে করতে পারতাম না। তিনি তাতে কখনো আমার প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করেননি। তিনি কখনো আমাকে অভিযুক্ত করেননি যে, তুমি এটা কেন করেছ অথবা কেন এটা করলে না” (আবু দাউদ)। “একদিন তিনি আমাকে তাঁর একটি প্রয়োজনে পাঠালেন। আমি পথিমধ্যে বাজারে একদল বালককে খেলাধুলায় মশগুল দেখলাম। আমিও তাদের সাথে খেলায় মেতে গেলাম। আমার ফিরে আসতে বিলম্ব হওয়ায় রাসূলুল্লাহ (সা.) আমার খোঁজে বের হলেন। পেছন দিক থেকে এসে রাসূলুল্লাহ (সা.) আমার ঘাড়ে হাত রাখলেন। আমি পেছনে ফিরে দেখলাম, তিনি হাসছেন। তিনি বললেন, হে উনাইস! তোমাকে যেখানে যেতে বলেছি সেখানে যাও। তিনি আমার ত্রুটির জন্য কখনো আমাকে অভিযুক্ত করেননি” (আবু দাউদ)।
খেলাধুলায় উৎসাহদান : শিশুরা সাধারণত আমোদপ্রিয়। খেলাধুলা তাদের কাছে খুবই আকর্ষণীয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) এ ব্যাপারে তাদের উৎসাহ জোগাতেন। আয়েশা (রা.) বলেন, “তুলা দিয়ে তৈরি আমার পুতুলগুলো ঘরের তাকে সাজানো ছিল। তার মধ্যে দুই পাখাবিশিষ্ট একটি ঘোড়াও ছিল। রাসূলুল্লাহ (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, এগুলো কি? আমি বললাম, আমার খেলার পুতুল। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, দুই পাখার ওটা কি? আয়েশা (রা.) বলেন, ঘোড়া। তিনি বললেন, পাখাওয়ালা এ আবার কেমন ঘোড়া! আমি বললাম, আপনি কি শোনেননি, হযরত সুলায়মান (আ.)-এর ঘোড়ার অনেকগুলো পাখা ছিল? এ কথায় রাসূলুল্লাহ (সা.) এমনভাবে হেসে দিলেন যে, আমি তাঁর সামনের পাটির দাঁতগুলো দেখতে পেলাম” (আবু দাউদ)। উল্লেখ্য যে, আয়েশা (রা)-র ছয় বছর বয়সে রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে বিবাহ করেন এবং তার নয় বছর বয়সে তাকে নিজ সংসারে তুলে নেন।
শিশুদের সালাম দেওয়া : পারস্পরিক দেখা-সাক্ষাতে সালাম বিনিময় ইসলামী সভ্যতা-সংস্কৃতি ও শিষ্টাচারের অপরিহার্য অংশ। মহান আল্লাহ বলেন : “যখন তোমাদের অভিবাদন করা হয় (সালাম দেয়া হয়) তখন তোমরাও তার চেয়ে উত্তমরূপে অভিবাদন জানাবে অথবা তার অনুরূপ” (সূরা নিসা : ৮৬)।
আনাস ইবনে মালেক (রা.) বলেন, “রাসূলুল্লাহ (সা.) খেলাধুলায় মশগুল কতিপয় বালকের নিকট এলেন এবং তাদেরকে সালাম দিলেন” (আবু দাউদ)। আনাস (রা), “আমি আবদুল্লাহ্ ইবনে উমার (রা.)-কে মকতবে পাঠরত শিশুদের সালাম দিতে দেখেছি” (আদাবুল মুফরাদ)। “আনাস (রা.) শিশুদের নিকট দিয়ে যাওয়ার সময় তাদেরকে সালাম দিয়েছেন এবং বলেছেন, নবী (সা.) ও তাদের সালাম দিতেন” ( বুখারি, মুসলিম, তিরমিজি, ইবনে মাজা)। শিশুদের সালাম দেয়া রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মহত্তম চরিত্র ও শিষ্টাচারের নিদর্শন। এতে শিশুদের সুন্নাতের ওপর আমল ও সামাজিক শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্য নিহিত আছে।
শিশুর সাথে কৃত ওয়াদা রক্ষা করা : শিশুর প্রতি যতœবান হওয়া, তাদের আদর-স্নেহ করা এবং তাদের দাবি পূর্ণ করা অভিভাবকের কর্তব্য। আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেন : “তোমার শিশুদেরকে ভালোবাস এবং তাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন কর। তাদের সাথে কোনো ওয়াদা করলে তা পূর্ণ কর। কেননা তারা তোমাদেরকেই তাদের রিজিক সরবরাহকারী মনে করে।” “তোমাদের সন্তানদের প্রতি যতœবান হও।” অর্থাৎ তাদের ব্যাপারে তোমাদের মাঝে যেন কোনো অন্যমনস্কতা ও শৈথিল্যের সৃষ্টি না হয়। অন্যের হাতে তোমরা তাদের ছেড়ে দিও না। মহানবী (সা.) শিশুদের গভীর মমতা দিয়ে ভালোবাসতেন। তিনি শিশুদের জগৎকে চিহ্নিত করেছেন বেহেশতের নিকটবর্তী একটি জগৎ হিসেবে। তাঁরা ভাষায় : “শিশুরা হচ্ছে বেহেশতের পতঙ্গ (প্রজাপতি) তুল্য।” নবীজী (সা.) কখনো শিশুদের ক্রন্দন শুনতে পেলে নামাজ সংক্ষিপ্ত করে দিতেন এবং বলতেন, “আমি চাই না যে, তার মায়ের কষ্ট হোক।” তিনি বলেনÑ “যে ব্যক্তি আমাদের ছোটদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করে না আর বড়দের অধিকার সম্পর্কে সচেতন নয়, সে আমাদের মধ্যে শামিল নয়।” ইবাদতের অভ্যস্ত করার প্রশিক্ষণদান : সময়মতো শিশুদেরকে নামাজ শিক্ষা দেয়ার প্রতি অভিভাবকদের হাদিস শরিফে তাগিদ দেয়া হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন : “তোমাদের সন্তানেরা যখন সাত বছরে উপনীতে হয় তখন তাদেরকে নামাজ পড়ার নির্দেশ দাও। আর দশ বছর বয়স হলে তাদেরকে নামাজের জন্য শাসন কর ও তাদের বিছানা পৃথক করে দাও” (আবু দাউদ)।
ভদ্রতা ও নৈতিকতা শিক্ষা দেয়া : শিশু সন্তানদের ভদ্রতা ও শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়ার প্রতি মনোযোগী হওয়া পিতা-মাতার অপরিহার্য কর্তব্য। এ কর্তব্যকে ইসলাম অত্যধিক গুরুত্ব দান করে। রাসলুল্লাহ (সা) বলেন : “নিজেদের সন্তানদের স্নেহ কর এবং তাদের ভালো ব্যবহার শিখাও।” “সন্তানদের সদাচার শিক্ষা দেয়া দান-খযরাতের চেয়েও উত্তম।” “(আখেরাতে) ওজনদ-ে উত্তম চরিত্র-নৈতিকতার চেয়ে অধিক ওজনদার আর কোনো কিছু হবে না” (আবু দাউদ)।
কন্যা সন্তানকে অগ্রাধিকার দান : মহানবী (সা.) বহু স্থানে ছেলে ও মেয়ের মধ্যে পার্থক্য করতে এবং মেয়েদের ওপর ছেলেদের অহেতুক প্রাধান্য দিতে নিষেধ করেছেন। এভাবে তিনি মেয়েদের জীবনের অনুভূতিকে উচ্চাসন দান করেছেন এবং তাদের মধ্যে সৃষ্টি করেছেন জীবনের মূল্যবোধ। তিনি বলেন : “তোমাদের সন্তানদের মধ্যে উত্তম সন্তান হচ্ছে মেয়েরা।” ফাতিমা (রা)-র জন্মের সুসংবাদ কারো চেহারায় এক ধরনের বিষণœতার ভাব বিরাজ করছিল। মহানবী (সা.) তাদের উদ্দেশ করে বললেন, “তোমাদের কি হলো? তোমরা এত বিষণœ কেন? সে তো জান্নাতের এক পুষ্পবিশেষ, আমি এর সুগন্ধি পাচ্ছি। তার রিজিকের দায়িত্ব তো আল্লাহর হাতে।” তিনি ঘোষণা করেছেন : “যে ব্যক্তি বাজারে গিয়ে উপহার সামগ্রী খরিদ করে তার সন্তানদের জন্য বহন করে বাড়ি নিয়ে এলো, তার এ কাজ দুর্ভিক্ষপীড়িত লোকদের কাছে সাহায্য সামগ্রী বহন করে নিয়ে যাওয়ার মতো মর্যাদাপূর্ণ। লোক যেন ছেলে সন্তানের আগে মেয়েদের উপহার সামগ্রী দান করে।”
কন্যা সন্তানের পিতা-মাতা সৌভাগ্যশালী : আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তি তিনটি কন্যা সন্তান অথবা বোনকে লালন-পালন করবে, তার জন্য জান্নাত অপরিহার্য। জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর রাসূল! দুটি লালন-পালন করলেও। প্রশ্ন করা হলো, একটি করলে? তিনি উত্তর দিলেন, একটিকে করলেও।” রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন : “যে ব্যক্তি দুটি কন্যা সন্তান লালন-পালন ও ভরণ-পোষণ করেছে তার জন্য বেহেশত অবধারিত।” “তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি উত্তম, যার প্রথম সন্তান মেয়ে।”
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।