চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
মাওলানা এইচ এম গোলাম কিবরিয়া রাকিব
॥ এক ॥
মর্যাদার বিবেচনায় ইসলামে সকল মানুষ সমান, ধর্ম-বর্ণ-ভাষা-গোত্র নির্বিশেষে। পুরুষ, নারী ও শিশু সকল শ্রেণীর মানুষের জন্যই ইসলামে রয়েছে কল্যাণ, শান্তি ও মুক্তির বাণী। শৈশবকাল মানব জীবনের মূল ভিত্তি
এবং শিশুরা জাতির ভবিষ্যৎ। ইসলাম শৈশবকালের প্রতি যথাযথ গুরুত্ব আরোপ করেছে শিশুর জন্ম, তার খাদ্য, লালন-পালন, জীবনের নিরাপত্তা, শিক্ষাদীক্ষা ও স্বাস্থ্যরক্ষা ইত্যাদি বিষয় কোরআনÑহাদিসে আলোচিত হয়েছে।
ইসলামে শিশুর মৌলিক অধিকার : পিতার ঔরসে বা মায়ের গর্ভে সন্তানের আকৃতি সৃষ্টি হওয়ার পূর্ব থেকেই শরিয়তে তার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। নবীজী (সা.) বিবাহে প্রস্তাবিত মহিলার অভিভাবকদের নির্দেশ দিয়েছেন, তারা যেন ধর্মপরায়ণ ও চরিত্রবান পাত্রের সন্ধান করে, যে যথার্থভাবে পরিবার এবং স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততির প্রতি নিজ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারে। মহানবী (সা.) বলেন : “যদি তোমাদের নিকট কোনো পাত্রের প্রস্তাব আসে যার ধর্মপরায়ণতা ও চরিত্র তোমাদের পছন্দনীয়, তাহলে তোমরা তার সাথেই তোমাদের মেয়েদের বিবাহ দেবে। যদি তোমরা এ নির্দেশ পালনে ব্যর্থ হও তাহলে পৃথিবীতে সৃষ্টি হবে বিশৃঙ্খলা ও বিপর্যয়।”
পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন বংশ বা জন্মসূত্র : শিশুর বংশধারার বৈধতার লক্ষ্যে ইসলাম বিবাহের প্রচলন করেছে। সন্তান লাভের জন্য শরিয়তের বিধানমতে মুসলমান নারী-পুরুষের বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া একান্ত বাধ্যতামূলক, যাতে তার জন্মসূত্র নিয়ে কেউ কটাক্ষ করতে না পারে। দাম্পত্য বন্ধন পরিবারের মূল ভিত্তি। অজ্ঞতার যুগে সন্দেহজনক পিতৃত্ব নিয়ে কোনো কোনো হতভাগ্য শিশুকে চলতে হতো। একাধিক ব্যক্তি একটি শিশুর পিতা বলে দাবি করত। দাবির সমর্থনে তারা যুক্তিও পেশ করত।
শিশুর প্রাথমিক খাদ্য : সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুকে দুধপান করানো মাতার অপরিহার্য নৈতিক কর্তব্য। পবিত্র কোরআনে শিশুকে মায়ের দুধপানের বিষয়ে বহু নীতিমালার উল্লেখ হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন : “যে সমস্ত জননী দুধপান করানোর মেয়াদ পূর্ণ করতে চায় তারা নিজেদের সন্তানদেরকে পুরো দুই বছর দুধ পান করাবে” (সূরা বাকারা : ২৩৩)। কোরআনের নির্ধারিত সময়সীমা তথা দুই বছর পূর্ণ হওয়ার আগে কেউ চাউলে দুধ ছাড়িয়ে নিতে পারবে। তবে শর্ত থাকবে যে, এতে স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক আলোচনার পর দুধ ছাড়িয়ে নিলে দুগ্ধপায়ী শিশুর কোনো ক্ষতি হবে না এ মর্মে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনের বিধান হচ্ছে : “যদি স্বামী-স্ত্রী উভয়ে পারস্পরিক পরামর্শ ও আলোচনার ভিত্তিতে দুধ ছাড়িয়ে নিতে চায়, তাহলে সেক্ষেত্রে তাদের কারো কোনো গুনাহ না” (সূরা বাকারা : আয়াত ২৩৩)।
আল কোরআনে প্রাকৃতিক পন্থায় দুগ্ধদানের গুরুত্বের কথা এবং তা মা ও সন্তানের মধ্যে স্নেহপ্রবণতা ও অনুভূতির বন্ধন সৃষ্টি করে তা উল্লেখ করা হয়েছে। তা এমন এক মজবুত সম্পর্ক যা মায়ের অন্তরকে নিমেষের তরেও তার দুগ্ধপায়ী শিশুর চিন্তা থেকে মুক্ত করতে পারবে না।
শিশুরা বরকত ও কল্যাণ লাভের উপায় : রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেন : “যদি দুধের শিশুরা, থুরথুরে বুড়োরা এবং গৃহপালিত পশুরা তোমাদের মধ্যে না থাকত, তাহলে অচিরেই তোমাদের ওপর কঠিন শাস্তি নেমে আসত।” “সৎ সন্তান বেহেশতের ফুল।” সুতরাং শিশু সন্তান নিজের হোক বা অন্যের হোক তাদের অবজ্ঞা করা, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা মোটেও সঙ্গত নয়।
শিশুর কানে আজান দেয়া : কন্যা সন্তান বা পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করার পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তার ডান কানে আজান ও বাম কানে ইকামত দিতে হবে। আবু রাফে (রা.) বলেন, “হযরত ফাতেমা ও আলী (রা.)-এর পুত্র হাসান (রা.) জন্মগ্রহণ করার পর রাসূলুল্লাহ (সা.) তার কানে আজান দিয়েছেন।” হযরত হাসান ইবনে আলী (রা.) বলেন, মহানবী (সা.) বলেছেন, কোনো পরিবারে শিশু সন্তান জন্মগ্রহণ করলে তার ডান কানে আজান এবং বাম কানে ইকামত দিলে সে মৃগীরোগে আক্রান্ত হয় না” (বায়হাকি ও ইবনুস সুন্নী)। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, “হযরত হাসান (রা.) জন্মগ্রহণ করার পর রাসূলুল্লাহ (সা.) তার ডান কানে আজান এবং বাম কানে ইকামত দিয়েছেন”।
শিশুর নামকরণ, মাথা কামানো ও আকীকা করা : শিশুর জন্মের সপ্তম দিন তার একটি সুন্দর ও অর্থপূর্ণ নাম রাখতে হবে, মাথার চুল কামাতে হবে, সামর্থ্য থাকলে ওই চুলের ওজনের সমপরিমাণ সোনা বা রূপা দান-খয়রাত করতে হবে আকীকা হবে। হযরত সামুরা ইবন জুনদুব (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “প্রত্যেক শিশু তার আকীকার সাথে বন্ধক থাকে। অতএব তার জন্মের সপ্তম দিন তার পক্ষ থেকে পশু জবেহ করতে হবে, তার মাথার চুল কামাতে হবে এবং তার নাম রাখতে হবে” (সুনান আবু দাউদ)। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, “রাসূলুল্লাহ (সা.) হাসান ও হুসাইন (রা.)-এর আকীকায় একটি করে ভেড়া জবেহ করেন” (সুনান আবু দাউদ)। ছেলে বা মেয়ে উভয়ের আকীকায় এক বা একাধিক ছাগল-ভেড়া-মেষ জবেহ করে আকীকা করা যেতে পারে এবং তা একাধিকবারও করা যেতে পারে। রাসূলুল্লাহ (সা.) হাসান-হুসাইন (রা.) Ñএর জন্য দুবার আকীকা করেছেন। “রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কন্যা ফাতেমা (রা.) তাঁর পুত্র-কন্যা হাসান, হুসাইন, জয়নব ও উম্মে কুলসুম-এর মাথার চুল ওজন করে তার সমপরিমাণ রূপা দান-খয়রাত করেছেন” (মুওয়াত্তা ইমাম মালেক, কিতাবুল আকীকা)। “কিয়ামতের দিন তোমাদেরকে তোমাদের নিজ নিজ নামে ও তোমাদের মাতা-পিতা নামে ডাকা হবে। অতএব তোমরা নিজেদের উত্তম নাম রাখো” (আবু দাউদ)।
খতনা করানো : পুরুষাঙ্গের অগ্রভাগের চামড়া কেটে ফেলাকে খতনা বলে। এটা নবী-রাসূলগণের স্থায়ী সুন্নাত। আবু আইউব আনসারী (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, “চারটি বিষয় নবী-রাসূলগণের সুন্নাত : খতনা করা, আতর ব্যবহার করা, মেসওয়াক (দাতন) করা এবং বিবাহ করা” (মুসনাদ আহমাদ)। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, “স্বভাবসুলভ ধর্ম বা অভ্যাস পাঁচটি : খতনা করা, গুপ্তাঙ্গের লোম কামানো, মোচ কাটা, নখ কাটা এবং বগলের নিচের লোম তুলে ফেলা” (বুখারি ও মুসলিম)। হযরত শাদ্দাদ ইবন আওস (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, “পুরুষ লোকের জন্য খতনা করা সুন্নাত” (মুসানদ আহমাদ)।
শিশুদের শিক্ষার সূচনা : শিশুরা কথা বলতে শুরু করলে প্রথমেই তাদের লেখাপড়ার সূচনা করতে হবে আল্লাহর নামে। আল্লাহতায়ালা বলেন, “পড়ো তোমার প্রভুর নামে, যিনি তোমায় সৃষ্টি করেছেন” (সূরা আলাক : ১)।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেন, “তোমরা সর্বপ্রথম তোমাদের শিশুদের কলেমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ (আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই) শিক্ষা দাও” (আল-মুসতাদরাক লিল-হাকেম)। শিশুরা হচ্ছে জীবনের আশার ফসল, চোখ জুড়ানো ধন, উম্মাতের প্রস্ফুটিতব্য ফুল। মানবতার ভবিষ্যৎ তার ওপর নির্ভরশীল এবং জাতির অস্তিত্ব ও মর্যাদাকে সংরক্ষিত রাখার মাধ্যম। আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেন : “তোমাদের সন্তানদের শিক্ষা-প্রশিক্ষণ ও জ্ঞান দান কর। কেননা তারা তোমাদের পরবর্তী যুগের জন্য সৃষ্ট।” তাই ইসলাম এদের প্রশিক্ষণের ব্যাপারে গুরুত্ব দিয়েছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।