Inqilab Logo

শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

এগিয়ে যাচ্ছে দেশ

ইঞ্জিনিয়ার আবু নোমান হাওলাদার | প্রকাশের সময় : ১৮ ডিসেম্বর, ২০২১, ১২:০৫ এএম

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় মুক্তিযুদ্ধের মহান বিজয়। সত্তরের ঐতিহাসিক নির্বাচনে জাতির রায় মেনে নিতে চায়নি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠি। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ‘যার যা আছে, তাই নিয়ে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলা’র আহ্বান জানান তিনি। ঘোষণা দেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বাঙালির বুকে স্বাধীনতার বীজমন্ত্র বোনা হয়ে যায় সেই দিনই। সেদিন থেকে আর বাঙালিকে দাবিয়ে রাখা যায়নি। আর সে কারণেই ২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইটের নামে বাঙালি নিধন শুরু হলেও রুখে দাঁড়াতে সময় নেয়নি বীর বাঙালি। ধ্বংসস্তূপ থেকে জেগে উঠে মুক্তির যুদ্ধে শামিল হয় সমগ্র জাতি।

বাঙালি জাতি যে এক উপনিবেশ থেকে আরেক উপনিবেশের শোষণে পড়েছিল, সেটা ১৯৪৭ সালেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। বাঙালিকে দাবিয়ে রাখতে চায় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠি, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ভেতর দিয়ে এটাও স্পষ্ট হয়ে যায়। অধিকার আদায়ের সংগ্রামে জাতিকে একটু একটু করে প্রস্তুত করতে হয়েছে। এক দিনে হুট করে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে নেমে যায়নি জাতি। এ জন্য দীর্ঘ সংগ্রামের ভেতর দিয়ে বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। ৭ মার্চের ভাষণের পর পরই প্রতিটি ঘরই যেন হয়ে উঠে একেকটি দুর্গ। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে কাউকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

বাঙালি জাতির কয়েক হাজার বছরের ইতিহাসে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিজয় সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত। পাঁচ হাজার বছর আগেও এ ভূখণ্ডের অধিবাসীদের বীরত্ব সম্পর্কে সমীহ করা হতো। মহাবীর আলেকজান্ডারের সঙ্গীরা এই বীর জাতির শৌর্যবীর্যের প্রশংসা করেছেন। আড়াই হাজার বছর আগে রোমান কবি ভার্জিলের কবিতায় গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের অধিবাসীদের বীরবন্দনা প্রকাশ পেয়েছে। সেই প্রাচীনকালে বাঙালি বীর বিজয় সিংহ লঙ্কা জয় করে দূর দেশেও নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের কৃতিত্ব দেখান। তারপরও বলা যায়, ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা এ ভূখণ্ডের মানুষের ইতিহাস খুব একটা সুখকর নয়। এ দেশের সম্পদ লুণ্ঠনের জন্য বিদেশি হানাদাররা বার বার আঘাত হেনেছে। বৈদেশিক আধিপত্যে এক পর্যায়ে বাঙালি তার স্বকীয় মর্যাদাও হারিয়ে ফেলেছে।

বাঙালি মুসলমানদের অগ্রণী ভূমিকায় ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলেও শুরুতেই ষড়যন্ত্রের শিকার হয় তারা। সংখ্যালঘিষ্ঠ পশ্চিম পাকিস্তানিরাই এ দেশের ভাগ্য-বিধাতা হয়ে ওঠে। শোষণ ও নির্যাতনের শিকারে পরিণত হয় বাঙালিরা।

১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয়ী হলে পাকিস্তানিরা তার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানায়। শুধু তাই নয়, তারা একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতের আঁধারে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। শুরু হয় গণহত্যা। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষিত হয় এবং শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। জাতি এ বছর একাত্তরের মহান বিজয়ের ৫০তম বার্ষিকী পালন করছে। একটি সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যাশা। বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলা গড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু দেশের শত্রুরা তাকে হত্যা করে দেশকে পিছিয়ে দিয়েছিল। আল্লাহর রহমতে তার সুযোগ্য কন্যার হাত ধরে এখন জোর কদমে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তত্ত্বাবধানে দেশের উন্নয়ন প্রকল্প একের পর এক পেখম মেলে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। চার লেন মহাসড়ক, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, পানগাঁও নৌ-টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প, গ্যাস সংকট নিরসনে এলএনজি টার্মিনাল প্রকল্প, মেট্রোরেল প্রকল্প, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্প, পায়রা সমুদ্রবন্দর, রাজধানীর চারপাশে স্যুয়ারেজ ট্যানেল নির্মাণের মতো অবকাঠামো গড়ে তোলা হচ্ছে। উন্নয়নের এ কর্মযজ্ঞে যোগ হয়েছে পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্প এবং দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার-ঘুমধুম প্রকল্প। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠনের কাজ চলছে। ইতোমধ্যে কয়েকটি অঞ্চলের কাজের উদ্বোধনও করা হয়েছে। চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দরের সক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনও বৃদ্ধি পেয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ নিরাপদ এবং পণ্য পরিবহন-খালাস সহজীকরণ করতে নেয়া আরো কিছু অবকাঠামোর সংস্কার হচ্ছে। একই সঙ্গে তথ্য-প্রযুক্তি খাতেও এগিয়েছে দেশ।

পদ্মা সেতু নির্মাণ, সমুদ্র সীমানা বিজয়, শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি, ফ্লাইওভার নির্মাণ, জেলেদের খাদ্য সহায়তা প্রদান, দারিদ্রতার হার নিম্ন পর্যায়ে, যুদ্ধাপরাধী ও রাজাকারদের বিচার, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, বিনামূল্যে প্রত্যেকেটি শিক্ষার্থীদের হাতে বই বিতরণ, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ, কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে স্বাস্থ্য সেবা প্রদান, বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি, দেশের রপ্তানি আয় বৃদ্ধি, মাথা পিছু আয় বৃদ্ধি, গরিব শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি, অসহায় মুক্তিযোদ্ধাদের আবাসন ব্যবস্থা, রামপাল কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ভাতা প্রদান, প্রতিটি ইউনিয়নে ডিজিটাল তথ্য সেবা কেন্দ্র, বিভিন্ন জেলায় বিনোদন কেন্দ্র নির্মাণ, বিভিন্ন জেলায় শিল্প পার্ক নির্মাণ, দেশের বিভিন্ন স্থানে ইকোনমিক জোন নির্মাণ, গ্রামীণ রাস্তা-ঘাট ও কালভার্ট নির্মাণ, মোবাইল ও ইন্টারনেট গ্রাহক বৃদ্ধি, একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, কৃষিতে সফলতা, জংগী ও সন্ত্রাস দমনে সফলতা, এশিয়া হাইওয়ে রোড প্রকল্প, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি, প্রতিবন্ধী ভাতা প্রদান, নারীর ক্ষমতায়ন, বিধবা ভাতা প্রদান, মাতৃত্বকালীন ছুটি বৃদ্ধি, বয়স্ক ভাতা প্রদান, মাতৃকালীন ভাতা প্রদান, ডিজিটাল বাংলাদেশ কার্যকর, মেট্রোরেল প্রকল্প, হাতির ঝিল প্রকল্প, এলিভেটেড একপ্রেস প্রকল্প, মাদক নিধন, ভিক্ষুক মুক্ত করণ, অসংখ্য প্রাইমারি স্কুল সরকারিকরণ শেখ হাসিনা সরকারের বড় অবদান।

অফুরন্ত সম্ভাবনার অপর নাম বাংলাদেশ। এ দেশের রয়েছে অমিত সম্ভাবনাময় ষোল কোটি মানুষের বত্রিশ কোটি হাত। ষোল কোটি মানুষ বাংলাদেশের জন্য অভিশাপ নয়, আশীর্বাদ। কেননা আবহমান কাল থেকেই এ দেশের মানুষেরা কর্মনিষ্ঠ, পরিশ্রমী। অচিরেই এ দেশ পরিণত হবে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ পোশাক, জুতা, ওষুধ, সিরামিক ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানিকারক দেশে। সৃষ্টিকর্তার অপার কৃপায় ধন্য এদেশে রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে উর্বর মাটি আর মিঠা পানি। গ্যাস ও কয়লার প্রাচুর্যের পাশাপাশি এ দেশে বছরে তিনবার ফসল উৎপাদিত হয়। ফলে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হওয়া সত্ত্বেও ইতোমধ্যেই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জিত হয়েছে, এ দেশে এখন আর কেউ না খেয়ে মরে না। কৃষিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পাশাপাশি দেশের দরিদ্র, শ্রমজীবী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠি নির্ভর প্রবাসী আয়কে পুঁজি করে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে ঘামঝরা শ্রমের ফসল পোশাকশিল্প উন্নয়নের ধারাকে করেছে আরও বেগবান। দেশে যেভাবে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে, অর্থনীতি এগিয়েছে, যেভাবে বিশ্বমন্দা ও রাজনৈতিক অস্থিরতা মোকাবিলা করেছে, তাতেই বোঝা যায় বাংলাদেশের মানুষ অপরিসীম ক্ষমতার অধিকারী।
লেখক: চেয়ারম্যান, বিবিএস ক্যাবলস ও নাহী গ্রুপ।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন