মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় দেউলিয়া হলো যুক্তরাষ্ট্রের ২য় বৃহত্তম ব্যাংক
চলতি সপ্তাহের বুধবারও আর দশটি সাধারণ ব্যাংকের মতো বাণিজ্যিক ও আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক (এসভিপি), যা দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক ব্যাংক
দু'বছর ধরে এক তদন্ত চালিয়ে বিবিসি দেখেছে ব্ল্যাক অ্যাক্স নামে একটি নাইজেরিয়ান সংগঠন - যা এক ছাত্র আন্দোলন থেকে পরবর্তীকালে ভয়ংকর মাফিয়া গোষ্ঠীতে পরিণত হয় - তারা দেশটির রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ঢুকে পড়েছে এবং ইন্টারনেট জালিয়াতি ও হত্যার সাথেও তারা জড়িত। রিপোর্টটির তথ্য সংগ্রহ করেছেন চার্লি নর্থকোট, স্যাম জুডাহ, আর পিটার ম্যাকজব।
ড. জন স্টোন এখন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। কোন কোন দিন অধ্যাপনার কাজের পর একান্ত মুহূর্তগুলোয় এখনো তার অতীত জীবনের কথা সিনেমার ফ্ল্যাশব্যাকের মতো মনে ভেসে ওঠে। না, তাতে রক্ত বা বন্দুকের শব্দ থাকে না। বরং কানে বাজে সেই অনুনয়গুলো। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে সেই মানুষগুলোর প্রাণভিক্ষা চেয়ে কাতর অনুনয়। তার কাছে, ঈশ্বরের কাছে। "এটা যে কী বেদনাদায়ক" - কেঁপে উঠে মাথা ঝাঁকিয়ে বলেন জন স্টোন - "মৃতদের পরিবার আপনাকে অভিশাপ দেবে, সারা জীবন সেই অভিশাপ বয়ে বেড়াতে হবে।"
দক্ষিণ-পূর্ব নাইজেরিয়ার বেনিন বিশ্ববিদ্যালযে রাজনীতিবিজ্ঞান পড়ান ড. স্টোন। কিন্তু এক সময় তিনি ছিলেন "ব্ল্যাক অ্যাক্স" বা "কালো কুঠার" নামে একটি মাফিয়া-স্টাইল অপরাধী দলের একজন সিনিয়র সদস্য। এরা নাইজেরিয়ায় খুন, মানবপাচার ও ইন্টারনেট প্রতারণার সাথে সম্পর্কিত ছিল।
স্থানীয়ভাবে এই ব্ল্যাক অ্যাক্স পরিচিত হয় একটি "কাল্ট" বা অন্ধ আনুগত্যভিত্তিক দল হিসেবে। তাদের ছিল দলের সদস্য হবার গোপন অভিষেক অনুষ্ঠান। প্রত্যেককে দলের অন্য সদস্যদের প্রতি চরম আনুগত্য দেখাতে হতো।
তারা আরো কুখ্যাত ছিল তাদের ভয়ংকর সহিংসতার জন্য। তাদের শত্রুদের মৃতদেহের ছবি নিয়মিতভাবে প্রকাশ পেতো নাইজেরিয়ার সামাজিক মাধ্যমে। সেই মৃতদেহগুলো হতো বীভৎসভাবে বিকৃত, তাতে থাকতো হত্যার আগে চালানো নির্যাতনের চিহ্ন। ড. স্টোন স্বীকার করেন যে তিনি - একজন ব্ল্যাক অ্যাক্সের সদস্য হিসেবে - ওই সব নির্যাতনে অংশ নিয়েছেন। আমাদেরকে সাক্ষাৎকার দেবার সময় তিনি তার আঙুলগুলো বন্দুকের মতো করে আমাদের প্রযোজকের মাথায় ঠেকিয়ে বুঝিয়েছিলেন - তাদের কাছে হত্যার সবচেয়ে সেরা উপায় কী ছিল।
বেনিন সিটিতে তিনি পরিচিত ছিলেন "বুচার" বা কসাই নামে। সেই সব দিনের বিভীষিকা এখনো ড, স্টোনকে তাড়িয়ে বেড়ায়। তিনি এখন তার সেই অতীত জীবনের জন্য গ্লানি বোধ করেন। যে দলের তিনি একদা সদস্য ছিলেন - এখন তার কঠোর সমালোচনা করেন তিনি। তার মত আরো বেশ কয়েক জন সাবেক ব্ল্যাক অ্যাক্স সদস্য আছেন - যারা নিরবতার শপথ ভেঙে বিবিসির কাছে তাদের গোপন তথ্য প্রকাশ করেছেন। আন্তর্জাতিক কোন সংবাদমাধ্যমের কাছেও এটাই তাদের প্রথম কথা বলা।
বিবিসি আফ্রিকা গত দুই বছর ধরে ব্ল্যাক অ্যাক্সের ব্যাপারে তদন্ত করছে। তারা নানা সূত্রের একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে, দলটির সদস্যদের ব্যক্তিগত কথোপকথন ও বার্তা বিনিময়ের হাজার হাজার ফাঁস করা দলিল হস্তগত করেছে। এতে দেখা যায়, ব্ল্যাক অ্যাক্স হয়ে উঠেছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ও বিপজ্জনক সংগঠিত অপরাধীচক্র। আফ্রিকা, ইউরোপ, এশিয়া ও উত্তর আমেরিকার সাধারণ মানুষের মধ্যেই মিশে আছে ব্ল্যাক অ্যাক্সের লোকেরা। হয়তো আপনার ইনবক্সে তাদের পাঠানো ইমেইলও আছে।
এ অনুসন্ধান শুরু হয়েছিল একটি হত্যার হুমকি থেকে। বিবিসির একজন সাংবাদিককে ২০১৮ সালে হত্যার হুমকি দিয়ে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছিল। একজন মোটরবাইক চালক সেই রিপোর্টারের গাড়ির উইন্ডস্ক্রিনে চিঠিটি আটকে দিয়ে যায়। এর কয়েক সপ্তাহ আগেই এই সাংবাদিক নাইজেরিয়ায় অবৈধ আফিমজাত নেশার দ্রব্যের ব্যবসা নিয়ে একটি প্রতিবেদনের ওপর কাজ করছিলেন। তিনি ব্ল্যাক অ্যাক্সের কয়েকজন সদস্যের সাথে মুখোমুখি সাক্ষাৎও করেছিলেন। এর পরই আসে সেই চিঠি।
এর কিছুদিন পর আসে দ্বিতীয় আরেকটি চিঠি। এটি পৌঁছে দেয়া হয় রিপোর্টারের পরিবারের হাতে। তার মানে, কেউ তাকে অনুসরণ করছিল এবং তার বাড়ির ঠিকানা ওরা জেনে গেছে। প্রশ্ন ছিল এই হুমকি কি ব্ল্যাক অ্যাক্সই পাঠিয়েছে? কত শক্তিশালী এরা? তাদের নেতাই বা কে? তারই অনুসন্ধানে নেমে আমাদের একজন লোকের সাথে পরিচয় হয়। তিনি দাবি করলেন, তিনি ব্ল্যাক অ্যাক্সের হাজার হাজার দলিলপত্র হ্যাক করেছেন, যাতে ওই গ্যাংয়ের শত শত সদস্যের ব্যক্তিগত যোগাযোগের তথ্য আছে।
এতে ২০০৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রায় ১০ বছরের তথ্য আছে - আছে হত্যাকাণ্ড এবং মাদক চোরাচালান সম্পর্কে কথাবার্তার বিবরণ। বহু ইমেইলে আছে ইন্টারনেট জালিয়াতির মাধ্যমে বহু অর্থ আয়ের বিস্তারিত বর্ণনা। এসব বার্তায় পরিকল্পনা করা হচ্ছে কিভাবে এ কর্মকাণ্ডকে সারা বিশ্বব্যাপি সম্প্রসারিত করা যায়। এখান থেকে বেরিয়ে আসে চারটি মহাদেশজুড়ে ব্ল্যাক অ্যাক্সের অপরাধমূলক তৎপরতার বিবরণ।
এই হ্যাকের যিনি উৎস - তিনি দাবি করছেন, ব্ল্যাক অ্যাক্স তাকে খুন করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।
তিনি আমাদের কাছে আসল নাম প্রকাশ করলেন না। তার একটি ছদ্মনাম দেয়া হলো - উচে টোবিয়াস। টোবিয়াসকে অনলাইনে পাঠানো হত্যার হুমকিগুলোর একটিতে বলা হচ্ছে - "আমরা তোমাকে খুঁজে বের করবোই।" "তোমার মাথার খুলি ভেদ করবে একটি কুড়াল। আমি তোমার রক্ত চাটবো, তোমার চোখ চুষে খাব।" বিবিসি মাসের পর মাস ধরে টোবিয়াসের এসব দলিলপত্র পরীক্ষা করেছে। তাতে যেসব লোকের নাম দেখা গেছে, তাদের ব্যাপারে তথ্য যাচাই করে দেখা গেছে, দলিলপত্রে উল্লেখ করা অনেক অপরাধই সত্যি সত্যি ঘটেছে। কিছু দলিল এতই ভয়াবহ যে তা প্রকাশের উপযুক্ত নয়।
ব্ল্যাক অ্যাক্সের লোকেরা সাম্প্রতিকতম হত্যাকাণ্ডের ছবি শেয়ার করার জন্য পাসওয়ার্ড-দিয়ে-সুরক্ষিত ওয়েবসাইটের চ্যাট-গ্রুপের গোপন ফোরাম ব্যবহার করে। একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে একটি ছোট ঘরের মেঝেতে একটি লোক পড়ে আছে। ছবির শিরোনাম - "হিট"। লোকটির মাথায় চারটি ক্ষত, তার সাদা টি-শার্টটির চারপাশে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। তার পিঠে লাল রঙ দিয়ে একটি বুট জুতোর ছাপ দেয়া।
নাইজেরিয়ার ভেতরে আরো কিছু কাল্ট গ্রুপ আছে - তাদের নামগুলো হলো - দি আই, দ্য বাকানিয়ার্স, দ্য পাইরেটস এবং দ্য মাফাইটস। এদের সাথে প্রাধান্য বিস্তারের লড়াই চালাচ্ছে ব্ল্যাক এ্যাক্স। পশ্চিম আফ্রিকার পিজিন ভাষায় পাঠানো বার্তা অনুবাদ করে বিবিসি দেখেছে - ব্ল্যাক অ্যাক্সের লোকেরা হিসেব রাখছে যে কতো জন প্রতিদ্বন্দ্বীকে এ পর্যন্ত তারা হত্যা করেছে। প্রতিটি অঞ্চলের হত্যার হিসেব রাখা হচ্ছে - ঠিক ফুটবল খেলার গোলের হিসেবের মত। "বেনিনের যুদ্ধে স্কোর এখন ১৫-২" - বলা হচ্ছে একটি পোস্টে। আরেকটির ভাষ্য - "আনাম্ব্রা প্রদেশে 'হিট' হয়েছে। স্কোর হলো ব্ল্যাক অ্যাক্স ৪ - বাকানিয়ার্স ২।"
এই অপরাধচক্রের আয়ের প্রধান উৎস হলো ইন্টারনেট জালিয়াতি। বিবিসির পাওয়া দলিলপত্রে দেখা যাচ্ছে সেখানে অসংখ্য ব্যাংক ট্রান্সফার, রশিদ, ইমেইল ইত্যাদি আছে যাতে দেখা যায় কিভাবে ব্ল্যাক অ্যাক্স সদস্যরা সারা পৃথিবী জুড়ে অনলাইনে প্রতারণার জন্য একযোগে কাজ করছে। সদস্যরা এ জন্য বিভিন্ন ফরম্যাট শেয়ার করে । এতে থাকে কীভাবে জালিয়াতি করতে হয় তার ব্লুপ্রিন্ট। এটা হতে পারে প্রেমের ফাঁদ পেতে, সম্পত্তির উত্তরাধিকার বা বাড়ি-জমি কেনা বা ব্যবসার ক্ষেত্রে জালিয়াতি।
এসব ঘটনার শিকার যারা হন - তাদের আইনজীবী, বা হিসাবরক্ষকদের ইমেইল এ্যাকাউন্ট জাল করে বিভিন্ন লেনদেনের অর্থ হাতিয়ে নেয় এই অপরাধীরা। এসব কোন ছোটখাটো অংকের জালিয়াতি নয় বা কোন একজনের কাজও নয়। এগুলো জোটবদ্ধ ও সংগঠিতভাবে অত্যন্ত লোভনীয় অংকের আর্থিক প্রতারণার ব্যাপার। অনেক সময়ই এ কাজে জড়িত থাকে বিভিন্ন মহাদেশে জড়িত থাকা লোকজনের নেটওয়ার্ক।
ফাঁস হওয়া ইমেইলগুলো থেকে আমরা ক্যালিফোর্নিয়ার একজন লোকের ঘটনা পেয়েছি - যাকে ২০১০ সালে সম্ভবত ব্ল্যাক এ্যাক্সেরই একটি দল টার্গেট করেছিল। তারা ইতালি ও নাইজেরিয়া থেকে তাকে ফাঁদে ফেলে এবং মোট ৩০ লাখ ডলার হাতিয়ে নেয়। ব্ল্যাক অ্যাক্স সদস্যরা তাদের শিকারদের বলে "মুগু" বা "মায়ে" - একটা স্থানীয় শব্দ, যার মানে হলো ইডিয়ট বা আহাম্মক। তারা লোকজনকে ঠকানোর সময় ভুয়া নাম-পরিচয় এবং জাল বা চুরি-করা পাসপোর্ট ব্যবহার করে।
মনে করা হয়, ব্ল্যাক অ্যাক্স সদস্যরা তাদের সাইবার অপরাধচক্র থেকে শত শত কোটি ডলার পরিমাণ অর্থ আয় করে। কানাডার কর্তৃপক্ষ ২০১৭ সালে ব্ল্যাক অ্যাক্সের সাথে জড়িত একটি অর্থ পাচারের নেটওয়ার্ক ভেঙে দেয় - যা তাদের মতে ৫০০ কোটি ডলার হাতিয়েছে। ব্ল্যাক অ্যাক্সের এরকম কতগুলো চক্র পৃথিবীতে কাজ করছে কেউ জানে না।
ফাঁস হওয়া দলিল থেকে দেখা যায়, নাইজেরিয়া, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, উপসাগরীয় দেশগুলো এবং আরো বেশকিছু দেশগুলো থেকে তাদের সদস্যরা পরস্পরের সাথে যোগাযোগ রাখছে। এসব উপাত্ত হ্যাকিংয়ের উৎস যে ব্যক্তিটি - তিনি বলছেন, এ চক্র সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে, এবং তাদের সদস্য সংখ্যা ৩০,০০০-এরও বেশি। বিশেষ যত্নের সাথে তাদের বৈশ্বিক কার্যক্রম গড়ে তোলা হয়েছে। বিভিন্ন ভৌগলিক এলাকাকে একাধিক 'জোনে' ভাগ করা হয়েছে, আছে তার স্থানীয় প্রধান। এই প্রধানরা তাদের অধীন লোকদের কাছ থেকে সদস্য চাঁদার মত অর্থ সংগ্রহ করে - যা পাঠানো হয় তাদের কেন্দ্র নাইজেরিয়ার বেনিন সিটিতে।
টোবিয়াস বলছেন, "এটা কোন ছোট ক্লাব নয়, এক অকল্পনীয় রকমের বড় অপরাধী প্রতিষ্ঠান যা ছড়িয়ে আছে ইউরোপ, আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা এবং এশিয়ায়।" টোবিয়াসের এই মূল্যায়নের সাথে আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর প্রাপ্ত তথ্য মিলে যায়। অন্তত ১২০ জন বিশেষজ্ঞের বিশ্লেষণের ওপর ভিত্তি করে ২০২১ সালে যে 'অর্গানাইজড ক্রাইম ইনডেক্স' তৈরি হয়েছে তাতে দেখা যায় আফ্রিকা মহাদেশে সংগঠিত অপরাধ সবচেয়ে বেশি আছে নাইজেরিয়ায়, এবং এ নেটওয়ার্কগুলো বিদেশেও ছড়াচ্ছে।
ইতালিতে ব্ল্যাক অ্যাক্সের ক্রমবর্ধমান তৎপরতা মোকাবিলা করতে পুরোনো মাফিয়া সংক্রান্ত আইনগুলো পুনরুজ্জীবিত করা হচ্ছে। সেখানে ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে ৩০ জন সন্দেহভাজন ব্ল্যাক এ্যাক্স সদস্যকে গ্রেফতার করা হয় - মানবপাচার, দেহব্যবসা ও ইন্টারনেট জালিয়াতির অভিযোগে। যুক্তরাষ্ট্রও এ ক্ষেত্রে আক্রমণাত্মক নীতি নিয়েছে। এফবিআই ২০১৯ ও ২০২১ সালে ব্ল্যাক অ্যাক্সের বিরুদ্ধে যেসব অভিযান চালায় তাতে ইন্টারনেট জালিয়াতির দায়ে ৩৫ ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করা হয়। এ বছর সেপ্টেম্বর ও ডিসেম্বরে আরেকটি আন্তর্জাতিক অভিযান চালিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আরো ৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়।
সাবেক এফবিআই বিশেষ এজেন্ট এবং সাইবার ক্রাইম বিশেষজ্ঞ স্কট অগেনবাউম বলছিলেন, "সাইবার অপরাধ এখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে এবং লক্ষ লক্ষ কোটি ডলারের শিল্পে পরিণত হয়েছে।" অগেনবাউম বলছিলেন, তিনি তার কর্মজীবনে শত শত ব্ল্যাক অ্যাক্সের শিকার হওয়া লোক দেখেছেন। বহু মানুষের জীবন ধ্বংস হয়েছে, বহু কোম্পানি দেউলিয়া হয়েছে, অনেকে সারা জীবনের সঞ্চয় হারিয়েছে এদের জন্য।
তবে ব্ল্যাক অ্যাক্সের অপরাধ সাম্রাজ্য যতই বৈশ্বিক হোক - তার শিকড় কিন্তু নাইজেরিয়াতেই। ইডো প্রদেশের বেনিন শহরে ৪০ বছর আগে এই গোষ্ঠীটি প্রতিষ্ঠিত হয় বেশিরভাগ সদস্যই এই অঞ্চল থেকে আসা। হয়তো এর আন্তর্জাতিক প্রসারের ক্ষেত্রেও এটি ভূমিকা রেখেছে। জাতিসংঘের শরণার্থী সংক্রান্ত কমিশনার বলেন, যে নাইজেরিয়ানরা বিদেশে অভিবাসী হয় তার ৭০ শতাংশই ইডো রাজ্য থেকে যায়।
জানা যায়, তাদের অবৈধ যাত্রা ও পাচারের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে ব্ল্যাক অ্যাক্স। বেনিন সিটি, উত্তর আফ্রিকা ও দক্ষিণ ইতালিতে তাদের ঘাঁটিগুলো এজন্য ব্যবহৃত হয়। নাইজেরিয়ায় যেসব তরুণরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আন্ডারগ্রাজুয়েট ছাত্র এবং বয়স ১৬ থেকে ২৩-এর মধ্যে - তারাই ব্ল্যাক অ্যাক্সের প্রাথমিক রিক্রুট। তাদেরকে সদস্য হিসেবে অভিষিক্ত হবার জন্য এক বিশেষ গোপন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় - যা অত্যন্ত পাশবিক। একে বলা হয় ব্যামিং।
ব্ল্যাক অ্যাক্সের গোপন ফোরামে ২০১৬ সালের এক পোস্টে একজন সদস্য লিখেছে - "আমি বুঝিনি যে সেদিন আমাকে ব্যাম করা হবে।" তার ধারণা ছিল তাকে কোন বিশেষ পার্টিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেখানে একদল লোক তার জন্য অপেক্ষা করছিল। তারা তাকে উলঙ্গ করে এবং কাদার মধ্যে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়তে বাধ্য করে। তার পর তারা বাঁশ দিয়ে তাকে পেটাতে থাকে এবং তাকে প্রায় অজ্ঞান করে ফেলে।
একজন চিৎকার করে বলছিল, তারা তার মেয়েবন্ধুকে ধর্ষণ করবে, এবং তার পর তাকেও আবার তার বান্ধবীকে ধর্ষণ করতে হবে। "আমার মনে হচ্ছিল সেদিনই আমি মারা যাবো" - সে পোস্টে লিখেছে। তাকে পেটানো শেষ হবার পর শুরু হয় অনুষ্ঠানের অন্যান্য 'ঐতিহ্যগত' করণীয়। তাকে যারা পিটিয়েছে - তাদের সবার দু'পায়ের মাঝখান দিয়ে তাকে হামাগুড়ি দিতে বাধ্য করা হয়। তারপর তার নিজের বুড়ো আঙুল কেটে সেই রক্ত পান করানো হয়। খাওয়ানো হয় 'কোলা' নামে পশ্চিম আফ্রিকার এক বিশেষ ধরনের ক্যাফেইন সমৃদ্ধ বাদাম। এরপর গান ও হর্ষধ্বনির মধ্যে তাকে আলিঙ্গন করে সেই লোকেরা - যারা একটু আগেই তাকে নির্যাতন করছিল। এভাবেই "আই অ্যাক্সম্যান" হিসেবে তার "পুনর্জন্ম" ঘটলো।
ব্ল্যাক অ্যাক্সে যে লোকে যোগ দেয় তার অনেক কারণ আছে। কিছু লোককে জোর করে সদস্য করা হয়, তবে অন্যরা স্বেচ্ছায় যোগ দেয়। জোর করে সদস্য করা হয়েছে এমন লোকেদেরও এ গোষ্ঠীর প্রতি আনুগত্য অত্যন্ত দৃঢ়। মাকোকো শহরের একটি বস্তিতে এরকম একটি দলের সাথে আমাদের কথা হলে তারা বলেন - তারা করোফো নামের অদৃশ্য দেবতার উপাসক এবং ব্ল্যাক অ্যাক্সের সদস্য হতে পেরে গর্বিত। একজন সদস্য বলেছেন একটি প্রতিদ্বন্দ্বী অপরাধী চক্র তার বাবাকে হত্যার পর তিনি ব্ল্যাক অ্যাক্সে যোগ দিয়েছেন।
একজন বলেছেন "গোপনীয়তা, শৃঙ্খলা আর ভ্রাতৃত্ব" হচ্ছে তাদের মূলমন্ত্র। তার কথায়, তিনি যে অর্থ আয় করেন - তা তার ভাষায় ব্যাংকে কাজ করলে তিনি যা পেতেন, তার চেয়ে বেশি। বেনিন সিটিতে লোকের গ্যাংয়ে যোগদান ঠেকাতে কাজ করেন কার্টিস ওগবেবর। তার কথায় - "একবার এ গোষ্ঠীর সদস্য হলে কেউ তার গায়ে হাত দিতে পারবে না, তারাই তাকে রক্ষা করবে।"
ড. স্টোন বলেন, নাইজেরিয়ায় বেকারত্বের হার পৃথিবীর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এ কারণে অনেকে ব্ল্যাক অ্যাক্সে যোগ দেয় নেটওয়ার্ক তৈরির জন্য, যাতে সে সুরক্ষা পায় এবং তার ব্যবসায়িক যোগাযোগ তৈরি হয়। স্টোন দাবি করেন, সব ব্ল্যাক অ্যাক্স সদস্যই অপরাধী নয়। নাইজেরিয়ার সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী, শিক্ষাজগৎ, এমনকি ধর্মযাজকদের মধ্যেও তাদের সদস্য আছে - বলেন তিনি। এই গ্রুপটির জন্ম একটি ছাত্র সংগঠন থেকে - যার নাম নিও ব্ল্যাক মুভমেন্ট ইন আফ্রিকা বা এনবিএম।
বেনিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭০ সালে সৃষ্ট এই এনবিএমের প্রতীক ছিল একটি কালো কুঠার - যা শিকল কাটছে। এর অনুপ্রেরণা ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী সংগ্রাম। এনবিএমের অস্তিত্ব এখনো আছে, এবং তারা একটি নিবন্ধিত কোম্পানি যাদের সারা বিশ্বে ৩০ লাখ সদস্য আছে বলে দাবি করা হয়, এবং তারা নাইজেরিয়া ও অন্যান্য দেশে দাতব্য কাজ করে থাকে। এনবিএমের নেতারা দাবি করেন, ব্ল্যাক অ্যাক্স হচ্ছে একটি দলছুট দুর্বৃত্ত চক্র। প্রকাশ্যে তারা এই নামের সাথে তাদের কোন সংশ্রব না রাখার ওপর জোর দেয় এবং জোর দিয়ে বলে থাকে যে এনবিএম সবরকম অপরাধমূলক তৎপরতার বিরোধী।
এনবিএমের বর্তমান সভাপতি ওলোরোগুন এসে কাকোর ২০২১ সালে এক সাক্ষাৎকারে বিবিসিকে বলেন, এনবিএম ব্ল্যাক অ্যাক্স নয়। এটি এমন এক সংগঠন যারা বিশ্বে মহত্ব প্রচার করতে চায়। এনবিএমের আইনজীবীরা বলেছেন, ব্ল্যাক অ্যাক্সের কেউ এনবিএমের সদস্য এমন তথ্য পাওয়া গেলে তাকে সাথে সাথে বহিষ্কার করা হয়, এবং তারা অপরাধের ব্যাপারে শূন্য সহিংসতা দেখিয়ে থাকেন। তবে আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগকারীরা একে ভিন্ন চোখে দেখেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ ২০১৮ সালে বলেছে, "এনবিএম একটি অপরাধমূলক সংগঠন এবং ব্ল্যাক অ্যাক্সের অংশ"। কানাডার কর্তৃপক্ষ বলেছে এ দুটি "একই সংগঠন।" বিবিসি যেসব দলিল দেখেছে তাতেও কিছু ব্ল্যাক অ্যাক্স সদস্যের সাথে এনবিএম কর্পোরেশনের সম্পর্ক দেখা যায়। এই ব্যক্তিদের সাথে বিবিসি যোগাযোগ করলে তারা অভিযোগের কোন জবাব দেননি।
এসব তথ্য প্রমাণ এনবিএমের নেতৃত্বকে দিলে তারা জানান, তারা বিষয়টি তদন্ত করবে, এবং কেউ তাদের আচরণবিধি লংঘন করলে তাকে বহিষ্কার করা হবে। ড. স্টোন নিজে বলছেন, ব্ল্যাক অ্যাক্স ও এনবিএম আড়ালে একই সংগঠন। তিনি তার অভিজ্ঞতা থেকেই এ কথা বলছেন - কারণ তিনি নিজে ব্ল্যাক অ্যাক্সের সদস্য থাকার সময় বেনিন সিটির এনবিএমেরও একজন চেয়ারম্যান ছিলেন। টোবিয়াসও বলছেন, ব্ল্যাক অ্যাক্সের গোপন সম্প্রসারণের পেছনে এনবিএমের গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা ছিল।
এনবিএম নামে কাজ করে এমন সংগঠন এখন যুক্তরাজ্য ও কানাডা সহ বিভিন্ন দেশে নিবন্ধিত। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ও ইউটিউবে তাদের সাথে সম্পর্কিত অন্তত ৫০টি অ্যাকাউন্ট আছে। কোন কোনটির অনুসারী লক্ষাধিক। তাদের কয়েকটিতে ব্ল্যাক অ্যাক্সের মতই কুঠার চিহ্নিত ইমোজি বা কুড়াল ও বন্দুক হাতে লোকজনের ছবি দেখা যায়। কখনো দেখা যায় শ্লোগান - "আই অ্যাক্সম্যান।"
মি. ওগবেবর বলেন, নাইজেরিয়ার রাজনীতিবিদরা ব্ল্যাক অ্যাক্সের সদস্যদের ব্যালট বাক্স পাহারা দিতে, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের ভীতি প্রদর্শন করতে, এবং ভোট দেবার জন্য লোকজনের ওপর জোর খাটাতে ব্যবহার করেন। "তাদের নির্বাচনের সময় অর্থ ও অস্ত্র দেয়া হয়। পরে তাদের রাজনৈতিক নিয়োগ দেবার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়।"
ইডো প্রদেশের সরকারের একজন সাবেক সদস্য টনি কাবাকা বিবিসিকে বলেছেন, ক্ষমতার কেন্দ্রগুলোতে ব্ল্যাক অ্যাক্সের সদস্যদের উপস্থিতি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। বিবিসিকে মি. কাবাকা বলেন, তিনি সরকারি দায়িত্ব ছাড়ার পর বহু হত্যাপ্রচেষ্টা থেকে প্রাণে বেঁচে গেছেন। তার প্রাসাদোপম বাড়ির দেয়াল ও গেটে এখনো অসংখ্য বুলেটের চিহ্ন আছে। তিনি বলেন, তিনি সরকারের ভেতরকার ব্ল্যাক অ্যাক্সের লোকদেরকে চিহ্নিত করতে সক্ষম। "অধিকাংশ এমনকি প্রায় সবাই এর সাথে জড়িত" - বলেন তিনি। ব্ল্যাক অ্যাক্সের সাথে যোগাযোগের অভিযোগ আমরা ইডো প্রদেশের সরকারের কাছে পাঠিয়েছি। তবে তারা এর কোন উত্তর দেননি। সূত্র: বিবিসি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।