পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
স্বল্পোন্নত বা গরিব দেশের কাতার থেকে উন্নয়নশীল দেশ বা মধ্যবিত্তের কাতারে বাংলাদেশের যাত্রা আরও এক ধাপ এগোল। বুধবার বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ বা এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের সুপারিশ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৬তম বৈঠকের ৪০তম প্লেনারি সভায় অনুমোদন পেয়েছে। এক দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের অপ্রতিরোধ্য উন্নয়ন যাত্রার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি হিসেবে দেখা হচ্ছে জাতিসংঘের এ অনুমোদনকে। এ সাফল্যের অংশীদার দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। বাংলাদেশ এর আগে ফেব্রæয়ারিতে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি সভায় দ্বিতীয়বারের মতো স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের সুপারিশ লাভ করে। একই সঙ্গে বাংলাদেশকে ২০২১ থেকে ২০২৬ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরের প্রস্তুতিকাল প্রদানের সুপারিশ করা হয়। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ এরই মধ্যে সিডিপির সুপারিশ অনুমোদন করেছে। আশা করা হচ্ছে পাঁচ বছর প্রস্তুতিকাল শেষে বাংলাদেশের উত্তরণ ২০২৬ সালে কার্যকর হবে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের সুপারিশ অনুমোদন যে পাবে এ বিষয়ে কারোরই সংশয় ছিল না। স্বাধীনতার পর দীর্ঘকাল ধরে যে দেশকে বিদ্রæপ করা হতো তলাবিহীন ঝুড়ি সে দেশের মানুষ দেখিয়ে দিয়েছে নিজেদের ভাগ্য গড়ার ব্যাপারে তারা কতটা আত্মপ্রত্যয়ী। দুই যুগের পাকিস্তানি শোষণ ও মুক্তিযুদ্ধকালের সীমাহীন ধ্বংসযজ্ঞ বাংলাদেশের ভাগ্যে গরিবি হাল নিশ্চিত করেছে। একসময় যে দেশ ছিল দুনিয়ার অন্যতম সমৃদ্ধ তারা সবচেয়ে গরিব দেশে পরিণত হয়েছে। গত এক যুগের উন্নয়নে করোনাকালেও বাংলাদেশ অন্য দেশকে ঋণ দেওয়ার মতো সামর্থ্য অর্জন করেছে। বাংলাদেশকে যারা বিদ্রæপ করত তারাও স্বীকার করছে পদ্মা মেঘনা যমুনা পাড়ের মানুষের সাফল্য।
ইতিহাসের নিরিখে বলা হয়, বাঙালির ইতিহাস বীরত্বের ইতিহাস। দুরন্ত সাহসে উজ্জীবিত এ জাতি। ২ হাজার বছর আগেও পদ্মা মেঘনা যমুনা পারের মানুষের শক্তি-সামর্থ্য ও বীরত্বের প্রশংসা করেছেন গ্রিকবীর আলেকজান্ডারের সফরসঙ্গীরা। রোমান কবি ভার্জিলের কবিতায়ও স্থান পেয়েছে গাঙ্গেয় বদ্বীপবাসীর প্রশস্তি। কিন্তু ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক এবং পাকিস্তানি জংলি শাসনে বাংলাদেশ তার স্বকীয় মর্যাদা হারাতে চলেছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন সে অপমানজনক অধ্যায়ের অবসান ঘটিয়েছে। ১৯৪৭ সালে বাঙালি প্রতারিত হয় পাকিস্তান নামের কুইনাইন গিলে। সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতেও অস্বীকৃতি জানান জিন্নাহ-লিয়াকত-নাজিমউদ্দিন-নূরুল আমিন চক্র।
বলা যায়, এ অন্যায়ের প্রতিবাদেই বোনা হয় স্বাধীনতার বীজ। প্রধানমন্ত্রীর ভাষায় বঙ্গবন্ধু ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সৃষ্ট আন্দোলনে যে স্বাধিকারের বীজ বপন করেছিলেন তাকেই সযতেœ লালনপালন করে তিনি স্বাধীন মাতৃভূমি প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের পরিণত মহিরুহে রূপান্তরিত করেন। শেখ মুজিব থেকে পরিণত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়েই ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৫৮-এর আইয়ুব খানবিরোধী আন্দোলন, ’৬৬-এর ঐতিহাসিক ছয় দফা, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচন এবং ’৭১-এর রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা পাই স্বাধীনতা। স্বাধীনতার লক্ষ্য ছিল একটি সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ তথা সোনার বাংলা। ৫০ বছরে সে লক্ষ্য অর্জিত না হলেও অর্জনের সঠিক পথেই পা দিয়েছে বাংলাদেশ। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে এ জাতির পদার্পণ ঘটেছে। উন্নত বিশ্বের সোপানে উঠতে এগিয়ে যেতে হবে আরও জোরে, নিরলসভাবে।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। অর্জিত হয় ঐতিহাসিক বিজয়। এককভাবে আওয়ামী লীগই লাভ করে তিন চতুর্থাংশের বেশি আসন। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি দ্বিতীয়বারের মতো দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন তিনি। গঠিত হয় মহাজোট সরকার। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন দেশে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা এবং শেখ হাসিনা তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার নেন। ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সকল দলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে রেকর্ড সৃষ্টি করে তিনি চতুর্থ বারের মতো দেশ পরিচালনার সুযোগ পেয়েছেন। তার গৃহীত পদক্ষেপে দেশবাসী আজ তার সুফল পাচ্ছে। অমিত সম্ভাবনার দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে।
এক বর্ণাঢ্য সংগ্রামমুখর জীবন শেখ হাসিনার। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস তিনি গৃহবন্দি থেকেছেন। সামরিক স্বৈরশাসনামলেও বেশ কয়েকবার তাকে কারানির্যাতন ভোগ ও গৃহবন্দি থাকতে হয়েছে। বারবার তার জীবনের ওপর ঝুঁকি এসেছে। অন্তত ১৯ বার তাকে হত্যার অপচেষ্টা করা হয়েছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়েও তিনি অসীম সাহসে তার লক্ষ্য অর্জনে থেকেছেন অবিচল।
সহজ সারল্যে ভরা তার ব্যক্তিগত জীবন। মেধা-মনন, কঠোর পরিশ্রম, সাহস, ধৈর্য, দেশপ্রেম ও ত্যাগের আদর্শে গড়ে উঠেছে তার আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। পোশাকে-আশাকে, জীবনযাত্রায় কোথাও বিলাসিতা বা কৃত্রিমতার কোনো ছাপ নেই। নিষ্ঠাবান ধার্মিক তিনি। নিয়মিত ফজরের নামাজ ও কোরআন তেলওয়াতের মাধ্যমে তার দিনের সূচনা ঘটে। পবিত্র হজব্রত পালন করেছেন কয়েকবার।
মিয়ানমার সরকারের ভয়াবহ নির্যাতনে আশ্রয়হীন ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়ে তাদের অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা ও চিকিৎসা নিশ্চিত করে ‘বিশ্ব মানবতার বিবেক’ হিসেবে প্রশংসিত হয়েছেন তিনি। জাতিসংঘের চলতি অধিবেশনে বিশ্ব নেতারা তার এই মানবিক দৃষ্টান্তের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। নিখাদ দেশপ্রেম, দূরদর্শিতা, দৃঢ়চেতা মানসিকতা ও মানবিক গুণাবলি তাকে আসীন করেছে বিশ্ব নেতৃত্বের আসনে। একবিংশ শতাব্দীর অভিযাত্রায় দিন বদলের মাধ্যমে আধুনিক বাংলাদেশ গড়ার সুনিপুণ কারিগর শেখ হাসিনা।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে স্বপ্ন দেখতেন সেই স্বপ্ন আজ বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ করেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশংসা করে বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা নেতৃবৃন্দৃ ও গণমাধ্যম নানা উপাধি দিয়েছেন।
শেখ হাসিনা বার বার বুলেট ও গ্রেনেডের মুখ থেকে বেঁচে ফেরা বহ্নিশিখা। তিনি তার জীবন বাংলার মেহনতি দুঃখী মানুষের কল্যাণে উৎসর্গ করেছেন। রাজনীতির মাধ্যমে মানুষের কল্যাণই তার রাজনীতির দর্শন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনককে হত্যার পর ১৯৮১ সালের শুরুতে দলের দায়িত্ব নিয়ে দলকে শুধু চারবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়ই আনেননি, দেশকেও এগিয়ে নিয়েছেন অনেক দূর। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে যেমন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ তেমনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি উদার গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি তিনি। তার দক্ষ নেতৃত্বে দেশ সব দিক দিয়ে এগিয়ে গেছে।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, উপদেষ্টা, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি আর কে চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, সদস্য এফবিসিসিআই এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে ২ ও ৩ নং সেক্টরের রাজনৈতিক উপদেষ্টা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।