পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ রান্নার কাজে গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করে থাকে, যা এলপিজি বা এলপি গ্যাস নামে পরিচিত। এটি মূলত দাহ্য হাইড্রোকার্বন গ্যাসের মিশ্রণ। জ্বালানি হিসেবে রান্নার কাজে, গাড়িতে ও ভবনের তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে এর ব্যবহার হয়। আগে পাইপ লাইনের মাধ্যমে গ্যাসের ব্যবহার শুধুমাত্র শহরকেন্দ্রিক থাকলেও বর্তমানে সিলিন্ডারের মাধ্যমে গ্রাম-গঞ্জসহ সারাদেশেই ব্যাপকহারে গ্যাস ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে অসতর্ক ব্যবহারের কারণে বাড়ছে দুর্ঘটনা, যা প্রায়ই মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
গ্যাস বিস্ফোরণের প্রায় প্রতি ক্ষেত্রেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নারী ও শিশু। বাসাবাড়িতে গ্যাসের ব্যবহারের ক্ষেত্রে নারীরাই এগিয়ে এবং শিশুদের অবস্থান নারীদের আশেপাশেই থাকে বলে, বেশিরভাগ দুর্ঘটনায় নারীদের পাশাপাশি শিশুরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয় ব্যাপকভাবে।
বিগত কয়েক বছরের তথ্যে গ্যাস সিলিন্ডার ও পাইপলাইন বিস্ফোরণে নারী ও শিশুর প্রাণহানির ব্যাপক সংখ্যা লক্ষ্যণীয়। পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়, মিরপুরে গ্যাস পাইপলাইনে বিস্ফোরণে নারী-শিশুসহ দগ্ধ হয় ৭ জন। মগবাজারে ভয়াবহ বিস্ফোরণে শিশুসহ নিহত হয় ৭ জন। গাজীপুরে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে মা-মেয়ের মৃত্যু হয়। হাজারীবাগে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে এক নারীর মৃত্যু হয়। লালমনিরহাটে সিলিন্ডার বিস্ফোরণে এক শিশুর মৃত্যু ও মা-বাবা দগ্ধ হয়। নারায়ণগঞ্জে গ্যাসের পাইপলাইন বিস্ফোরণ: শিশুর মৃত্যু, দগ্ধ ৩৭ জন। রূপনগরে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে এক শিশুর মৃত্যু হয়।
এলপিজি সিলিন্ডার বিস্ফোরণের মূল কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞদের গবেষণায় দেখা যায়, যেহেতু সিলিন্ডারের গ্যাস খুব বেশি চাপে তরল করে প্রবেশ করানো হয়, তাই এটির বিস্ফোরণও খুব মারাত্মক হয়। বিস্ফোরণ হলে, শক ওয়েভ ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। এ শক ওয়েভ শরীরের যে অংশে লাগে, সে অংশের ব্যাপক ক্ষতি হয়। প্রাণহানিও ঘটে। তাছাড়া সিলিন্ডার যদি লিক হয়, সেক্ষেত্রে গ্যাস ভালভ হোসপাইপ কিংবা রেগুলেটর লিক হয়ে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। নিম্নমানের বা মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার গ্যাসের চাপ রক্ষা করতে না পেরে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে। যদি আগুন বা তাপ সিলিন্ডারের সংস্পর্শে চলে আসে, সেক্ষেত্রে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। অসতর্কতা, গ্যাসের চুলার চাবি বন্ধ না করা বা চাবি লুজ থাকা ইত্যাদি যেসব কারণে গ্যাস নির্গত হয়ে জমাট বেঁধে থাকে, এ কারণেও বিষ্ফোরণ ঘটাতে পারে সহজে এবং ভয়াবহভাবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, গ্যাস লিকের সময় চুলা জ্বালাতে ম্যাচের কাঠি ধরানোর সাথে সাথেই আগুন ধরে বিস্ফোরণ ঘটে।
বিস্ফোরণ প্রতিরোধে সর্তকতা অবলম্বন করা আবশ্যক। অনুমোদিত বিক্রেতাদের কাছে থেকেই গ্যাস সিলিন্ডার কেনা উচিত। এ সাথে নিশ্চিত করতে হবে সিলিন্ডারে কোম্পানির সিল রয়েছে কি না, সিলিন্ডারটির সেফটি ক্যাপটি সুরক্ষিতভাবে লাগানো রয়েছে কি না, ভূমির সমতলে সমান ও শুষ্ক জায়গায় সিলিন্ডারটি রাখা হয়েছে কি না। গ্যাস ভর্তি অবস্থায় সিলিন্ডার টানা হেঁচড়া বা মাটিতে গড়ানো কোনোভাবেই ঠিক না। বিক্রেতা বা ডেলিভারিম্যানের কাছ থেকে সিলিন্ডারের যথাযথ ব্যবহারবিধি ও ম্যানুয়াল সম্পর্কে জেনে নেয়া উচিত। সর্বোপরি, বিস্ফোরণ রোধে বিস্ফোরক পরিদপ্তর থেকে গ্যাস সিলিন্ডারের যেসব নিরাপত্তা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, তা মেনে চলতে হবে সতর্কতার সাথে।
গ্যাস লিকের ঘটনার মতো ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে আতঙ্কিত না হয়ে ঠান্ডা মাথায় পরিস্থিতির মোকাবিলা করা অত্যন্ত জরুরি। গ্যাস লিক হয়েছে বা হচ্ছে বোঝা গেলে লাইট, ধূপকাঠি, মোমবাতি ইত্যাদি বন্ধ করে দেয়া ও নিভিয়ে ফেলা উচিত। সিলিন্ডার কানেকশন বন্ধ করে সেখানে সেফটি ক্যাপ লাগাতে হবে সতর্কতার সাথে। গ্যাস লিকের ফলে গ্যাসের গন্ধ পেলে ঘরের সব জানালা ও দরজা খুলে দিতে হবে, ফ্যানগুলো বন্ধ করে দিতে হবে। ঘটনার তীব্রতা দেখা দিলে দেরি না করে ফায়ার সার্ভিস ও পার্শ্ববর্তী থানার সাথে যোগাযোগ করতে হবে। নতুবা ৯৯৯ জরুরি নাম্বারটি ব্যবহার করে সাহায্য চাইতে হবে।
বিভিন্ন সময় পাইপলাইনে গ্যাসের বিস্ফোরণের কারণ নিয়ে বিভিন্ন সংস্থা ও নগর চিন্তাবিদগণের যেসব বক্তব্য, গণমাধ্যমে উঠে এসেছে তাতে দেখা যায়, অবৈধ সংযোগ ব্যবহারকারীদের অসচেতনতা, গ্যাস কোম্পানির কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর অসততার কারণে এসব ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটেছে। বিশিষ্ট নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলামের মতে, পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও নিয়ন্ত্রণ সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতার অভাবই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রধান বাধা। অবৈধ গ্যাস সংযোগ বন্ধের পাশাপাশি লাইনের নিয়মিত পরীক্ষা অবশ্যই করতে হবে। নইলে এরকম দুর্ঘটনা এবং জান-মালের ক্ষতি হতেই থাকবে। দীর্ঘ দিন ধরে নগর-পরিকল্পনার সঙ্গে সম্পৃক্ত মো. নুরুল্লাহর মতে, এ শহরের মহাপরিকল্পনার কোন ক্ষেত্র সিটি করপোরেশনের আওতাভুক্ত এবং কোন ক্ষেত্র রাজউকের, তা অনেক ক্ষেত্রেই প্রশ্নবিদ্ধ। চরম সমন্বয়হীনতা, খোঁড়াখুঁড়ি করার কারণেও অনেক সময় লাইনে লিকেজ হয়। সঠিকভাবে তদারকি না করায় দুর্ঘটনাগুলো ঘটে।
এটি স্পষ্ট হচ্ছে যে, সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয়, সঠিক পরিচর্যা, জনসচেতনতা ও সর্তকতা অবলম্বন করে সিলিন্ডার গ্যাস, পাইপলাইনে গ্যাসের যথাযথ ব্যবহার দুর্ঘটনামুক্ত করে সকলের ব্যবহারের ক্ষেত্রে আস্থা অর্জন করা সম্ভব।
সরকার সারাদেশে সিলিন্ডার ব্যবহারের ক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক পরিবেশ তৈরি করেছে, ফলে নারীদের সময় অপচয় রোধ হয়েছে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ তৈরি হয়েছে, স্বল্প সময়ে অনেক রান্নার আয়োজনে সুবিধা তৈরি হয়েছে। আগে লাকড়ি ব্যবহারের কারণে চুলায় আগুন তৈরির উপকরণ সংগ্রহে রাখার জন্য একটা নির্দিষ্ট শুষ্ক স্থানে এসব উপকরণ স্তূপ করে রাখা হতো। গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারের পর এটার প্রয়োজন এখন আর হচ্ছে না বললেই চলে। গ্যাস ব্যবহারের ফলে এখন একটা খোলামেলা পরিবেশ তৈরি হয়েছে। নারীরা এখন সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন। মফস্বল ও গ্রাম-গঞ্জেও আধুনিকতার ছোঁয়া এখন লক্ষ্যণীয়। এটা জনগণের জন্য এক আশীর্বাদ। সতর্কতার সাথে নিয়ম মেনে সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করলে মফস্বল-গ্রামসহ সারা বাংলার নারী-শিশুরা যেমন দুর্ঘটনার হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারবে, তেমনি নিরাপদ সমাজ বিনির্মাণে নারীর অবস্থানও আরও সুসংহত ও সমৃদ্ধ হবে।
লেখক: সহকারী তথ্য অফিসার, পিআইডি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।