Inqilab Logo

রোববার ০৩ নভেম্বর ২০২৪, ১৮ কার্তিক ১৪৩১, ৩০ রবিউস সানী ১৪৪৬ হিজরি

গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় যা করা দরকার

সরদার সিরাজ | প্রকাশের সময় : ১৪ নভেম্বর, ২০২১, ১২:০৫ এএম

দেশ এক ক্রান্তিলগ্নে উপনীত। গণতন্ত্র ও সুশাসনের অভাবে শান্তি ও ঐক্য তিরোহিত প্রায়। উন্নতি কিছু হচ্ছে। কিন্তু তার সিংহভাগই জুটছে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের ভাগ্যে। তারও বেশিরভাগ অবৈধভাবে। কোটিপতি বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, ব্যাংকে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত ৯৯,৯১৮ জন, যা ২০২০ সালের মার্চে ছিল ৮২,৬২৫ জন। করোনা মহামারি কালে প্রায় সব কিছু বন্ধ থাকার সময়েও দেশে ১৭,২৯৩ জন কোটি পতি ব্যাংক আমানতকারী বেড়েছে! এর বাইরেও অনেক কোটিপতি রয়েছে। দেশে কোটিপতি বৃদ্ধির হার আলাদীনের চেরাগকেও হার মানায় করোনার মহামারির কারণে অসংখ্য মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। নতুন কর্মসংস্থানও নেই তেমন। বেকারত্ব সর্বকালের রেকর্ড করেছে। পণ্যমূল্য বেড়ে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। এভাবে দেশের মধ্যবিত্ত বিলুপ্ত হয়ে নিম্নবিত্তে পরিণত হচ্ছে। আর নিম্নবিত্ত হচ্ছে নিঃশ্ব। দেশের আয় বৈষম্য ডেঞ্জার পয়েন্ট অতিক্রম করেছে।এই সঙ্গে, সব ধরনের অপরাধ বেড়েছে। এসবের অধিকাংশই হয়েছে জবাবদিহিতা ও সুশাসন না থাকায়।

জবাবদিহিতা করবে কে? যারা জবাবদিহিতা করার মালিক, তাদেরই বেশিরভাগ অন্যভাবে নির্বাচিত। নির্বাচন ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। বিরোধী দলগুলো নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করছে না। মানুষও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে না। যে যৎসামান্য মানুষ ভোট দিতে যাচ্ছে, তারাও স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারছে না। কে বা কারা ভোট দিয়ে দিচ্ছে। দিনের ভোট আগের দিন রাতেই হওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। চলতি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনেও যা হচ্ছে তাতে প্রকৃত রাজনীতিবিদদের চেয়ে অরাজনীতিবিদরাই জনপ্রতিনিধি হচ্ছেন বেশি। জাপার চেয়ারম্যান জি এম কাদের সম্প্রতি বলেছেন, ‘দেশপ্রেমিক মানুষেরা রাজনীতির মাঠে টিকতে পারছেন না’। এদিকে নব্য রাজনীতিবিদরা দেশের চেয়ে স্বীয় স্বার্থ হাসিলেই মশগুল বেশি। তাদের অধিকাংশ অদক্ষও। কোথাও জবাবদিহিতা নেই। সে সুযোগে আমলাতন্ত্র মহাপরাক্রমশীল হয়ে উঠেছে। রাজনীতি হয়ে পড়েছে কলুষিত ও দুর্বল। নির্বাচন ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার কারণেই এই দৈনদশা সৃষ্টি হয়েছে। নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেছেন, ‘নির্বাচন এখন কতিপয় জটিল অসুখে আক্রান্ত। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় গণতন্ত্রের অবস্থা সংকটাপন্ন। একক ডাক্তারের পক্ষে তাকে বাঁচিয়ে তোলা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে মেডিকেল বোর্ড গঠনের কোনো বিকল্প নেই।’ বিশেষজ্ঞদেরও অভিমত, নির্বাচন এখন অর্থহীন আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়েছে।

গণতন্ত্র বলতে যা বুঝায় তা আছে নামেমাত্র, যা শুধুমাত্র সরকারি দলের জন্য। বিরোধী দল গণতন্ত্র ভোগ করতে পারছে না। তারা মিছিল-মিটিং-সমাবেশ কিছুই করতে পারছে না। দীর্ঘদিন যাবত দেশে ছাত্র ও শ্রমিক রাজনীতি নেই। ফলে নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি হচ্ছে না। তাই রাজনীতিতে এক ধরনের শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, যা ভবিষ্যতে আরও বাড়বে। স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকারও কমেছে। সরকারের বিপক্ষে মত প্রকাশ করলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কঠোর শাস্তি নির্ঘাত। তাই সকলেই সেলফ সেন্সরশিপে যেতে বাধ্য হয়েছে। মিডিয়াগুলোও তথৈবচ। সর্বোপরি মিডিয়াগুলোর বেশিরভাগ মালিক সরকারি দলের লোকজন।তাই তাদের প্রধান কর্ম হচ্ছে, সরকারের গুণগান গাওয়া। বিরোধী মতের শক্তিশালী মিডিয়াগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যে দু’চারটা চালু আছে, তারাও সেভাবে প্রকাশ করতে পারছে না বিজ্ঞাপন ও ডিজিটাল আইনের কারণে।

দেশে সুশাসনের দৃষ্টিকটু পর্যায়ে পৌঁছেছে। সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যেসব প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব, সেগুলো বন্দি। যে যৎসামান্য ক্ষমতা তাদের আছে, তাও প্রয়োগ হচ্ছে না শতভাগ দলীয়করণের কারণে। ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্টের বৈশ্বিক আইনের শাসন সূচক-২০২১ মতে, ১৩৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১২৪তম। দক্ষিণ এশিয়ার ছয়টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ চতুর্থ। সাতটি বিষয় বিবেচনায় এটি প্রণীত হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সীমাবদ্ধতায় ১২৫তম, নিয়ন্ত্রণমূলক ক্ষমতার প্রয়োগে ১২২তম, ফৌজদারি বিচারে ১১৭তম, দেওয়ানি বিচারে ১২৯তম, দুর্নীতি না হওয়ার দিকে ১১২তম, জননিরাপত্তায় ১১১তম ও সরকারি তথ্য প্রকাশের দিকে ১০২তম। গণতন্ত্রের ঘাটতি থাকাতেই এটা হয়েছে। তাই দেশে প্রকৃত গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তা বিরোধী দলগুলোকেই করতে হবে। সরকার এটা করবে বলে মনে হয় না।

গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বিরোধী দলগুলো নানা বাধা মোকাবেলা করে কিছু কর্মকাণ্ড করছে। তাও ঘরোয়াভাবে, টিভির টক শো’তে ও বিবৃতির মাধ্যমে। কিন্তু এভাবে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হবে না। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও অবাধ ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য দরকার আন্দোলন। কিন্তু তা এখন একক কোনো দলের পক্ষে করা সম্ভব নয়। তাই এ ব্যাপারে সব বিরোধী দলের দৃঢ় ঐক্য দরকার। কিন্তু মিনিমাম কমন ইস্যু ছাড়া সর্বদলীয় ঐক্য হবে না। আর সেই মিনিমাম কমন ইস্যু হচ্ছে-গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা। সে লক্ষ্যে বাম-ডান-মধ্য ধারার চিন্তা-ভাবনা আপাতত বন্ধ রেখে ইসির নিবন্ধিত সব বিরোধী দল মিলে ‘সর্বদলীয় জোট’ গঠন করতে পারে। তাতে আ’লীগ নেতৃত্বাধীন জোটের শরীক দলগুলোও সংশ্লিষ্ট হতে পারে। কারণ, তারাও বর্তমান নির্বাচন ও সুশাসন নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। তবে সর্বদলীয় জোট হবে নির্বাচনী জোট। জোটগতভাবেই নির্বাচন ও সরকার গঠন করতে হবে। অবশ্য কেউ কেউ যুগপৎ আন্দোলনের কথা বলছেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে জাতীয় ইস্যুর চেয়ে দলীয় ইস্যুই প্রধান্য পাবে। উপরন্তু নির্বাচনে জয়ী হওয়া এবং নির্বাচনোত্তর জাতীয় দাবি বাস্তবায়ন করা দূরহ হবে। তাই এক মঞ্চ থেকে আন্দোলন করা শ্রেয়। ইসির নিবন্ধনের বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন করতে পারে। এটা তাদের নৈতিক দায়িত্ব। তারা সর্বদলীয় জোটের সাথে যুগপৎ আন্দোলনও করতে পারে।

সর্বদলীয় জোট গঠিত হলেই যে আন্দোলন সফল হবে তা নয়। আন্দোলন সফল হওয়ার জন্য গণমানুষের সম্পৃক্ততা দরকার। গণমানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণের প্রতিশ্রুতি না থাকলে মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আন্দোলনে সম্পৃক্ত হবে না।দেশবাসীর প্রধান আকাক্সক্ষা হচ্ছে-গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা। এটা সংবিধানেও আছে। সর্বোপরি এটা মহান স্বাধীনতার চেতনাসমূহেরও অন্যতম। তা সত্ত্বেও এটা আজও বাস্তবায়িত হয়নি। মানুষ গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশী। তাই এটা বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। উপরন্তু শুধু প্রতিশ্রুতি দিলেই হবে না, তা কতদিনের মধ্যে বাস্তবায়িত হবে তা ঘোষণা করতে হবে। কারণ, এ দেশের মানুষ প্রতিশ্রুতি আর আশ্বাস শুনে আসছে স্বাধীনতার পর থেকেই। সে সব প্রতিশ্রুতির অধিকাংশই বাস্তবায়িত হয়নি! তাই মানুষ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের নির্দিষ্ট দিনক্ষণ জানতে চায়। এবং তা ৬ মাসের অধিক নয়। এসব প্রতিশ্রুতি পেলেই মানুষ আন্দোলনে সম্পৃক্ত হবে।

গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার স্থায়ী পথ হচ্ছে, সাংবিধানিক সব প্রতিষ্ঠানকে পূর্ণ স্বাধীন ও স্বাবলম্বী করে সরকারের হস্তক্ষেপমুক্ত করা। উপরন্তু প্রতিটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব সচিবালয় ও প্রয়োজনীয় লোকবল থাকা অত্যাবশ্যক। তার মাধ্যমেই স্বীয় কর্মীব্যবস্থাপনা চলবে। প্রধান ও তার সহযোগীরা নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন মহামান্য রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে। প্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবদিহিতাও করবেন রাষ্ট্রপতিই। কমিশনের প্রধান ও তার সহযোগীদের নিয়োগের জন্য প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক বিধান করতে হবে। উপরন্তু প্রতিষ্ঠানভিত্তিক সংসদীয় কমিটি থাকবে। সে কমিটি গঠিত হতে পারে ৭ সদস্য বিশিষ্ট, যার মধ্যে সরকারি দলের ৩ জন, বিরোধী দলের ২ জন ও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মধ্য থেকে ২ জন। বিধানের ভিত্তিতে কমিটি কমিশন গঠনের প্রস্তাব করবে। তার প্রেক্ষিতে মহামান্য রাষ্ট্রপতি কমিশন গঠন করবেন। একই ভাবে প্রধান বিচারপতি ও উচ্চ আদালতের বিচারপতিগণও নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন। নিম্ন আদালতের বিচারকগণ নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন এবং কর্মী ব্যবস্থাপনা হবে স্বীয় সচিবালয়ের মাধ্যমে। ন্যায়পালও প্রতিষ্ঠা করতে হবে একই পদ্ধতিতে। এভাবে বিচার বিভাগ ও কমিশনগুলো গঠিত হলে তা সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য, আস্থাশীল ও মর্যাদাপূর্ণ হবে। কমিশন স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারবে।মানুষের আকাক্সক্ষা পূরণ হবে। সর্বোপরি প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য সৃষ্টি হবে। অপরদিকে, স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলোকেও স্বাধীন ও স্বাবলম্বী করে সব কর্মের কেন্দ্রবিন্দু করতে হবে। আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য স্বাধীন ব্যাংক কমিশন, পুলিশ কমিশন নদী, নালা, খাল-বিল, জলাশয়, হাওর রক্ষার জন্য পানি কমিশন গঠন করতে হবে। উপরন্তু প্রশাসনকে দলীয়মুক্তকরণ ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ সব কালো আইন এবং স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে দলীয় প্রতীকের বিধান বাতিল করতে হবে। এটা হলে এবং এমপিদের উন্নয়নকর্ম থেকে সরিয়ে নেওয়া হলেই ব্যবসায়ী ও দুর্বৃত্তরা রাজনীতি থেকে সরে পড়বে। জাতীয় রাজনীতি কলুষমুক্ত হবে।রাজনীতি রাজনীতিবিদদের হাতে চলে আসবে। মেধা বানরা রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন