পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
দেশে প্রতিনিয়ত অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটছে। কখনও কারখানায়, কখনও বস্তিতে, কখনও বা বন্ধ গোডাউনে। পাল্লা দিয়ে নিয়ম ভাঙা হচ্ছে। নিয়ম ভাঙ্গাই যেন দেশে নিয়মে পরিণত হয়েছে। দেশে বিল্ডিং কোড আছে, কারখানা আইন আছে। আছে শ্রম আইন। কিন্তু এসব আইনের তোয়াক্কা না করে কারখানা চালানোর ফলেই প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধবনের দুর্ঘটনা ঘটছে। প্রাণহানির সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পুরানো ঢাকার সোয়ারীঘাটের কামালবাগে রোমানা রাবার নামের জুতার কারখানায় গত বৃহস্পতিবার রাতে আগুন লেগে পাঁচজন শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। কারখানাটি আইন মেনে তৈরি হয়নি বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। যে কারখানা আইন মেনে তৈরি নয়, সেখানে আগুন লেগে মানুষ মারা যাওয়াই স্বাভাবিক। তাই এ মৃত্যুকে দুর্ঘটনা বলা যায় না। কিছু দিন আগে নারায়নগঞ্জে একটি জুস কারখানায় আগুন লেগে অর্ধশতাধিক শ্রমিক নিহত হয়। ওই কারখানাও নিয়ম মেনে তৈরি হয়নি বলে জানা যায়।
ঢাকা মহানগরীর উপকণ্ঠ আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুর এলাকায় অবস্থিত তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেড কারখানায় ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর একটি মারাত্মক অগ্নিকাণ্ড ঘটে, যাতে মোট ১১৭ জন পোশাকশ্রমিক নিহত হয় ও ২০০ জনের অধিক আহত হয়। ভয়ানক এই দুর্ঘটনায় ঐ পোশাক কারখানার নয়তলা ভবনের ছয়তলা ভস্মীভূত হয়ে যায়। সরাসরি আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা যায় ১০১ জন পোশাকশ্রমিক ও আগুন থেকে রেহাই পেতে ওপর থেকে লাফিয়ে পড়ে মৃত্যু হয় আরও বেশ কয়েক জনের। বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয় বলে ধারণা করা হয়। নয়তলা ভবনের নিচতলায় আগুন লেগে মুহূর্তেই আগুনের ধোঁয়া ও শিখা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে যায়, যার কারণে ভবনের উপরের তলার শ্রমিকরা আটকা পড়ে যান। কারখানার বৃহৎ পরিমাণে ফ্যাব্রিক এবং সুতা থাকার কারণে, আগুন দ্রুত অন্যান্য তলায় ছড়িয়ে পড়ে, যা অগ্নিনির্বাপকের কাজকে জটিল করে। পরদিন ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়। সে সময় নয় তলা ভবনের তৃতীয় তলা থেকে সবচেয়ে বেশি ৬৯টি লাশ উদ্ধার করা হয়, চতুর্থ তলায় ২১টি এবং পঞ্চম তলা থেকে ১০টি পোড়া মৃত দেহ উদ্ধার করা হয়। পরবর্তীতে জানা যায় যে, অনেক শ্রমিক ভবনের সংকীর্ণ প্রস্থানের পথ দিয়ে নিচে নামতে পারছিলেন না। প্রাণে বাঁচতে লাফিয়ে পড়ে কিছু শ্রমিক ভবনটির ছাদে উঠতে সক্ষম হয়েছিল, যাদের পরে সফলভাবে উদ্ধার করা হয়। দমকল বাহিনীর ভাষ্য মতে, কারখানাটিতে পর্যাপ্ত জরুরি প্রস্থানের ব্যবস্থা না থাকার ফলে ভবন থেকে দ্রুত নামা সম্ভবপর ছিলো না। বিশাল ভবনে তিনটি সিঁড়ি ছিল, যেগুলির সবগুলি নিচতলায় এসে মিলিত হয়। নিচতলায় আগুন লাগার কারণে এগুলি ব্যবহার করা অত্যন্ত বিপজ্জনক এবং অব্যবহারযোগ্য হয়ে উঠেছিলো।
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকাল ৮:৪৫টায় সাভার বাসস্ট্যান্ডের পাশে রানা প্লাজা নামের একটি বহুতল ভবন ধসে পড়ে। ভবনের কয়েকটি তলা নিচে দেবে যায়। কিছু অংশ পাশের একটি ভবনের ওপর হেলে পড়ে। এ দুর্ঘটনায় এক হাজার ১৩৪ জন শ্রমিক নিহত এবং প্রায় আড়াই হাজারের মতো মানুষ আহত হয়, যা বিশ্বের ইতিহাসে তৃতীয় বৃহত্তম শিল্প দুর্ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। আজও এঘটনার সুরাহা হয়নি। হাজার হাজার আহত শ্রমিকরা এখনও তাদের প্রকৃত ক্ষতিপূরণ পায়নি।
২০১৯ সালের ২৮ মার্চ দুপুর ১টায় ঢাকার বনানীর বহুতল বাণ্যিজিক ভবন এফআর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। ২২ তলা ভবনের অষ্টম তলা থেকে আগুনের সূত্রপাত হয় ও ক্রমেই তা অন্যান্য তলায় ছড়িয়ে পড়ে। অগ্নিকাণ্ডে ২৬ জনের মৃত্যু হয় এবং ৭০ জন আহত হয়। পরে জানা যায়, ভবনটি বিল্ডিং কোড ভঙ্গ করে নির্মাণ করা হয়েছিলো এবং ভবনে যথেষ্ঠ পরিমাণে অগ্নিনির্বাপক সুবিধা ছিলো না। অথচ, বনানীর মতো অভিজাত এলাকায় ভবন নির্মাণে রাজউকের অনুমোদন ও তদারকি বাধ্যতামূলক ছিলো।
এরও আগে ২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নবাব কাটরার নিমতলি মহল্লায় একটি বড়সড় অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয়, যা নিমতলি অগ্নিকাণ্ড বা নিমতলি ট্র্যাজেডি নামে পরিচিত। এই অগ্নিকাণ্ডে ১১৯ জন মানুষ নিহত হয়। বহুমানুষ আহত হয়। তখন সরু গলিপথের কারণে সময়মত অগ্নিনির্বাপন করা যায়নি। সরকারি আইনুনাযায়ী আবাসিক এলকায় দাহ্য পদার্থ মজুত করার কোনো সুযোগ না থাকা সত্ত্বেও কী করে দিনের পর দিন নিমতলিতে অবৈধ ব্যবসা চললো তা কিন্তু আমাদের মতো সাধারণ মানুষের পক্ষে জানা সম্ভব না হলেও বিস্ফোরক দ্রব্য অধিদপ্তরের কর্তাব্যক্তিদের না জানার কথা নয়। এরপরও নিমতলিতে কেমিকেল ব্যবসা বন্ধ হয়েছে, এমন নয়।
কিছু দিন আগে ঢাকার মগবাজারে একটি ভবনে ভয়াবহ বিস্ফোরণে অন্তত ছয়জন নিহত হয়েছে। ওই ঘটনায় শতাধিক মানুষ আহত হয়েছে এবং আশে পাশের প্রায় দু’শতাধিক ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে অনেকেই। দেশে এসব দেখভাল করার জন্য আইনানুগ কর্তৃপক্ষ রয়েছে। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, তাহলে কি তারা তাদের দায়িত্ব পালনে গাফলতি করে যাচ্ছেন? নাকি সব জেনেও না জানার ভান করে বসে আছেন?
নারায়নগঞ্জের অগ্নিকান্ড আরেক নিমতলি বা তাজরিন গার্মেন্টস ট্রাজেডি মানুষের পোড়া লাশের সারি আর স্বজনদের আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠে। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এই কারখানার ভেতর থেকে পর্যন্ত ৫২ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানান, কারখানা ভবনের উপরের তলায় প্লাস্টিকসহ দাহ্য পদার্থ থাকায় ১৮টি ইউনিট দিয়েও আগুন নেভাতে বেগ পেতে হয়।
দমকল কর্মকর্তারা জানান, কারখানার ভবনের উপরের তলাগুলোয় প্লাস্টিকসহ বিপুল পরিমাণ দাহ্য পদার্থের মজুত ছিল। ভবন থেকে ছাদে ওঠা এবং বের হওয়ার দরজা ছিল তালাবদ্ধ। কেন কর্মরত শ্রমিককে কারখানা থেকে বের হতে দেয়া হয়নি। কেন ফ্লোরে তালা বদ্ধ করে রাখা হলো তা জানা যায়নি।
প্রায় সকল অগ্নিকান্ডের ক্ষেত্রেই কারখানার গেট তালাবদ্ধ করে রাখা হয়, কিন্তু কেন, তা বোধগম্য নয়। দেশে কারখানা আইন বিদ্যমান। কারখানা পরিদর্শক আছে। এসব কারখানা দেখভাল করার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষও রয়েছে। অথচ, দেশে এখনও অনেক কারখানা আবাসিক ভবনে বা বাসা বাড়িতে তাদের উৎপাদন কার্য পরিচালনা করে চলেছে। কারখানা আইনানুসারে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সকল অগ্নিকাণ্ডের পরম্পরা প্রায় এক ও অভিন্ন। পর্যাপ্ত বহিঃনির্গমন পথের অভাব, ভবনের মূল গেটে তালা, অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রপাতির অনুপস্থিতি, হেলথ্ ও হাইজিনের অপর্যাপ্ততা ইত্যাদি। অথচ, দেশের বিদ্যামান আইনের সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে সহজেই এমন দুর্ঘটনা রোধ করা যায়। আইন রয়েছে, কিন্তু সঠিক প্রয়োগ নেই। তদারকি করার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষ ও বিধানাবলী রয়েছে, কিন্তু কার্যকর তদারকি নেই। অগ্নিনির্বাপক অধিদপ্তর রয়েছে, কিন্তু তার যেন উপস্থিতি নেই। বিল্ডিং কোড রয়েছে, কিন্তু মানার বালাই নেই। বিস্ফোরক দ্রব্য অধিদপ্তরও এইসঙ্গে রয়েছে। তাহলে এতসব কর্তৃপক্ষের চোখ ফাঁকি দিয়ে দিনের পর দিন কীভাবে অনিয়ম করা সম্ভব, সেটাই আজ বড় প্রশ্ন। প্রতিটি বড় ঘটনার পরেই একাধিক তদন্ত কমিটি গঠিত হয়, মামলা হয়, নিহত ও আহত অসহায় শ্রমিক পরিবারকে নামমাত্র আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়। কিন্তু অপকর্মের সাথে জড়িত রাঘববোয়ালরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। দেশে কার্যকর কারখানা আইনানুযায়ী এমন ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে উৎপাদনমুখী শিল্পের অনুমোদন পাওয়ার কথা নয়। তাহলে কীভাবে, কার মদদে এসব কারখানার মালিকরা আইন কানুনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দেশে বিদেশে দেশের ভাবমর্যাদাকে ক্ষুণ্ন করছে। আর কত শ্রমিক আগুনে পুড়ে মারা গেলে দেশে শ্রমিক স্বার্থ সুরক্ষা নিশ্চিত হবে, সেটাই আজ বড় প্রশ্ন। আর তদন্ত কমিটি নয়। কথার ফুলঝুরি নয়। কারখানা আইন ও শ্রম আইনের নিরপেক্ষ প্রয়োগই এমনতর ভয়াবহ দুর্ঘটনা রোধের উপায়।
লেখক: প্রফেসর, আইবিএ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।