Inqilab Logo

শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

নীরবেই শ্রমিক ছাঁটাই

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা ডলার : গ্যাস-বিদ্যুতের সঙ্কট চট্টগ্রামে অস্তিত্বের সঙ্কটে তৈরী পোশাক শিল্প : কাজ নেই অজুহাতে কৌশলে শ্রমিক বিদায়

রফিকুল ইসলাম সেলিম | প্রকাশের সময় : ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

বিদেশি ক্রেতাদের অর্ডার নেই। ডলার সঙ্কটে কাঁচামাল নেই। উচ্চ মূল্য দিয়েও মিলছে না গ্যাস-বিদ্যুৎ। স্থবির কারখানায় উৎপাদনের চাকা। আর তাই চলছে শ্রমিক ছাঁটাই। এক দু’মাসের বেতন ধরিয়ে দিয়ে কর্মীদের বিদায় করে দেয়া হচ্ছে। চট্টগ্রামের শিল্পাঞ্চলগুলোতে এখন কান পাতলেই শোনা যায় পোশাক কারখানা শ্রমিকদের নীরব কান্না। কাজ হারিয়ে দিশেহারা শ্রমিকেরা। পরিবার পরিজন নিয়ে পড়েছেন মহাবিপাকে। বিকল্প কর্মসংস্থানে সুযোগ না পেয়ে অনেকে ফিরে যাচ্ছেন গ্রামে। চট্টগ্রামের ছোট বড় ৪২০টি চালু কারখানায় প্রায় ৫ লাখ শ্রমিক কাজ করেন। গত কয়েক মাসে শত শত শ্রমিক ছাঁটাই করা হয়েছে। যে কোন সময় বেকার হওয়ার আশঙ্কায় আছেন আরো অনেকে। জন্মভূমিতেই অস্থিত্বের সঙ্কটে পড়েছে শতভাগ রফতানিমুখি তৈরি পোশাক শিল্প। পোশাক কারখানা মালিক, শ্রমিক, বিজিএমইএ, শ্রম ও কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।

বিশ্ব অর্থনীতিতে মহামন্দা চলছে। আমেরিকা-ইউরোপের দেশগুলোতেও চলছে কৃচ্ছতা সাধন। তাদেরও ক্রয় ক্ষমতা কমছে। তাতে বিদেশের বাজারে দেশের তৈরি পোশাকের চাহিদা কমে গেছে। এরফলে রফতানি আদেশ কমে গেছে। রফতানির জন্য প্রস্তুত পোশাকও শিপমেন্ট করা যাচ্ছে না। নতুন অর্ডার না থাকায় কারখানাগুলোতে উৎপাদন কমে গেছে। দেশে চলছে গ্যাস-বিদ্যুতের নজিরবিহীন সঙ্কট। দফায় দফায় জ্বালানির দাম বাড়ানো হয়েছে। উচ্চমূল্য দিয়েও মিলছে না গ্যাস-বিদ্যুৎ।

তাতে কলকারখানার উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে। একদিকে রফতানি কমে গেছে, অন্যদিকে বেড়ে গেছে উৎপাদন খরচ। তাতে খরচ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন শিল্প কারখানার মালিকেরা। আগের তুলনায় কাজ তিন ভাগের দুই ভাগ কমে গেছে। শ্রমিকদের অনেকটা বসিয়ে রেখে বেতন-ভাতা দিতে হচ্ছে। এতে বাড়ছে ব্যাংক ঋণের দায়-দেনা। আর তাই বাধ্য হয়ে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের পথে হাঁটছেন অনেকে। তবে অনেকটা নীরবে শ্রমিকদের বিদায় করা হচ্ছে। মাসিক বেতনের সাথে অগ্রিম এক দু’মাসের বেতন ধরিয়ে দিয়ে ছাঁটাই করা হচ্ছে শ্রমিকদের।

গেল সপ্তাহে নগরীর কর্ণফুলী থানা এলাকায় বিএলপি ওয়ার্ম ফ্যাশন কারখানার একটি ইউনিট বন্ধ হয়ে গেছে। তাতে কাজ হারিয়েছেন দুই শতাধিক শ্রমিক। তার আগে নগরীর বাকলিয়া এলাকায় আরো দুটি পোশাক কারখানা বন্ধ করে দেয়া হয়। বেকার হয় ছয় শতাধিক শ্রমিক। একই দিনে ওই দুটি কারখানা বন্ধের পর শ্রমিক অসন্তোষ হয়। আর তাই কিছু কারখানা মালিক কৌশলে শ্রমিকদের ছাঁটাই করছেন।

নগরীর ষোলশহর এলাকার এক কারখানা মালিক বলেন, তার কারখানায় এখন তিন ভাগের একভাগ শ্রমিক আছে। বাকিদের বিভিন্ন কৌশলে কিছু অগ্রিম বেতন দিয়ে বিদায় করে দেয়া হয়েছে। গত কয়েক মাস ধরে কাজ নেই বললেই চলে। তাদের বসিয়ে বসিয়ে বেতন দেয়া সম্ভব নয়।

নগরীর প্রায় সবকটি কারখানার এমন চিত্র বলেও জানান তিনি। তিনি বলেন, মাসের পর মাস কাজ নেই, এটা বুঝতে পেরে শ্রমিকেরাও নীরবে বিদায় নিচ্ছে। তাছাড়া অনেক কারখানায় বেতন-ভাতাও বকেয়া পড়েছে। পোশাক শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করে বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতি। সংগঠনের উপদেষ্টা হাসান মারুফ রুমি বলেন, ঘোষণা দিয়ে ছাঁটাইয়ে বদলে নানা কৌশলে শ্রমিকদের বিদায় করছেন কারখানা মালিকেরা। এক্ষেত্রে আইন মানা হচ্ছে না। কাজ নেই- এমন অজুহাতে শ্রমিকদের কারখানা ছেড়ে যাওয়ার মতো পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে।

জানা গেছে, ব্যাংকের দায় দেনা নিয়ে ঝামেলা আর সরকারের সম্ভাব্য প্রণোদনা থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কায় কারখানা মালিকেরা আনুষ্ঠানিকভাবে লে-অফ বা কারখানা বন্ধ করছেন না। তবে নানা অজুহাতে শ্রমিক ছাঁটাই করা হচ্ছে। সামনে পবিত্র মাহে রমজান, ঈদের বেতন বোনাস নিয়ে শ্রম অসন্তোষের শঙ্কা থেকেই কারখানা মালিকেরা আগে ভাগে শ্রমিক কমিয়ে ফেলার নীতি গ্রহণ করেছেন বলেও জানা গেছে।

কারখানা বন্ধ বা লে-অফ ঘোষণা হলে তার তথ্য কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরে জানানোর নিয়ম রয়েছে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ওই দফতরে তৈরি পোশাক কারখানাসহ এক বছরে ১১টি কারখানা বন্ধের তথ্য জমা পড়েছে। আর লে-অফ ঘোষণা হয়েছে চারটিতে। পরিদর্শন অধিদফতরের উপ-মহাপরিদর্শক আব্দুল্লাহ আল সাকিব মুবাররাত বলেন, অর্থনৈতিক মন্দায় গার্মেন্টস কারখানার পাশাপাশি অন্য কারখানাও বন্ধ হচ্ছে।

শ্রম অধিদফরের কর্মকর্তারা জানান, তাদের কাছে বকেয়া পাওনা না দিয়ে ছাঁটাই করা হচ্ছে-শ্রমিকদের এমন অভিযোগ নিয়মিতই জমা পড়ছে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকেরা অভিযোগ নিয়ে আসছেন ব্যাপক হারে।

শিল্পাঞ্চল পুলিশ-৩ এর পরিচালক (পুলিশ সুপার) মোহাম্মদ সোলায়মান বলেন, বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার কারণে পোশাক কারখানায় কাজ কমে গেছে। কোথাও কোথাও শ্রমিক ছাঁটাই হচ্ছে। তবে এ নিয়ে কোনো অসন্তোষ এখনও নেই। সার্বিক পরিস্থিতি আমাদের নজরে রয়েছে।

শ্রমিক ছাঁটাইয়ের বিষয়টি সরাসরি স্বীকার না করলেও বিজিএমইএর প্রথম সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, চট্টগ্রামে ৪২০টি মতো কারখানা চালু আছে। তার মধ্যে সরাসরি পোশাক রফতানি করে এমন কারখানার সংখ্যা ১৭৮টি। বাকি কারখানাগুলো সাব কন্ট্রাক্টে কাজ করে। কিন্তু বিদেশি ক্রেতাদের অর্ডার কমে যাওয়ায় উৎপাদন অনেক কমে গেছে। কারখানাগুলো পুরোদমে চালু রাখা যাচ্ছে না। আগে যেখানে তিন শিফটে কাজ হতো এখন এক শিফটে কাজ। শ্রমিকদের বসিয়ে রেখে বেতন দেয়া সম্ভব না। দেশে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। আবার সঙ্কটও আছে। ডিজেলের দাম আগেই বাড়ানো হয়েছে। তাতে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। রফতানি কমে গেছে, আবার উৎপাদন ব্যয়ও বেড়ে যাওয়ায় কঠিন সঙ্কটে পড়েছেন মালিকেরা।

পোশাক শিল্প এখন অস্থিত্বের সঙ্কটে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ শিল্পকে বাঁচাতে হলে গ্যাস-বিদ্যুতের সরবরাহ নিশ্চিত করে দাম কমাতে হবে। সেই সাথে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা নিয়মিত রাখতে সরকারকে প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ মূল্যস্ফীতির মধ্যে যেখানে শ্রমিকদের বেতন বাড়ানো জরুরি সেখানে আমরা শ্রমিকদের চাকরিচ্যুত করতে চাই না। আমরা সঙ্কট মোকাবেলা করে টিকে থাকতে চাই।

পোশাক কারখানার মতো রফতানিমুখি অন্য শিল্প কারখানাগুলোতে উৎপাদনের চাকা স্থবির হয়ে পড়েছে। ডলার সঙ্কটে এলসি খোলা যাচ্ছে না। তাতে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমে যাচ্ছে। এতে লোকশানের মুখে পড়েছেন শিল্প মালিকেরা। বিশ^ব্যাপী মন্দার প্রভাবে চট্টগ্রাম ইপিজেডের কারখানাগুলোতেও উৎপাদন কমে এসেছে।
চট্টগ্রাম ইপিজেডের নির্বাহী পরিচালক মো. আবদুস সোবহান জানান, তবে এখনও পর্যন্ত কোনো কারখানা বন্ধ হয়নি। তিনি আরো বলেন, কাজ কমে যাওয়ায় শ্রমিকদের ওভারটাইম করতে হচ্ছে না, কোনো কোনো কারখানা নির্ধারিত সময়ের আগেই ছুটি হচ্ছে। এতে শ্রমিকের আয় কমেছে। তবে কোনো কারখানা বন্ধের মতো পরিস্থিতি হয়নি।

এমনিতে দেশে বেকারত্ব চরমে। তার উপর ব্যাপকহারে শ্রমিক কর্মচুত্য হওয়ায় দেশের সার্বিক আর্থ-সামাজিক পরিবেশে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. আবুল কালাম আযাদ। তিনি বলেন, কর্মহীন শ্রমিকেরা তাদের সংসারের ব্যয় নির্বাহ করতে গিয়ে কঠিন সঙ্কটে পড়বে। তাদের সন্তানদের পড়া লেখা বন্ধ হয়ে যাবে। বেকারের সংখ্যা বাড়লে অপরাধ প্রবণতা বাড়তে পারে। তাতে সমাজে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নীরবেই শ্রমিক ছাঁটাই

৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ