চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
সূরা ইনশিরাহর ৭-৮নং আয়াতে মহান রাব্বুল আলামীন বলেছেন, ‘তুমি দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করো আর যখনই সময় পাও প্রতিপালকের কাছে একান্তভাবে নিমগ্ন হও।’ সূরা-আরাফের ১৩১নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘যখন ভালো সময় আসত, তখন ওরা বলত ‘এটাই আমাদের প্রাপ্য।’ আর যখন খারাপ সময় আসত তখন মুসা ও তার সঙ্গীদেরকে ওরা এ দুর্ভাগ্যের কারণ মনে করত। কিন্তু ওদের দুর্ভাগ্য যে আল্লাহ (প্রণীত নিয়মে) নির্ধারিত ছিল, সে বিষয়ে ওদের কোনো বোধোদয়ই হয়নি।’
সময় ও জীবন আল্লাহর দান। সময়ের ইতিবাচক ব্যবহারই জীবনের সফলতা। সময়ের অপচয় ও অপব্যবহার জীবনের ব্যর্থতা। সময়ের যথাযথ ব্যবহার না করা বা অপব্যবহার করার জন্য জবাবদিহি করতে হবে আল্লাহর দরবারে। মহাগ্রন্থ কোরআন কারিমে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘সময়ের শপথ! মানুষ অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত; কিন্তু তারা নয়, যারা ইমান আনে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দেয় ও ধৈর্যের উপদেশ দেয়।’ (সুরা ১০৩ আসর, আয়াত: ১-৩)।
একবার রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে প্রশ্ন করা হলো, সৌভাগ্যবান কারা? তিনি বললেন, সৌভাগ্যবান তারা, যারা দীর্ঘায়ু লাভ করেছে এবং তা নেক আমলের মাধ্যমে অতিবাহিত করেছে। পুনরায় জিজ্ঞেস করা হলো, দুর্ভাগা কারা? তিনি বললেন, দুর্ভাগা তারা যারা দীর্ঘায়ু পেয়েছে এবং তা বদ আমলে কাটিয়েছে বা আমলবিহীন অতিবাহিত করেছে। (তিরমিজি: ২৩২৯, মুসনাদে আহমাদ: ১৭৭৩৪)।
আমাদের প্রিয় মহানবী হযরত মুহম্মাদ (সা.) নিজে সময়কে গুরুত্ব দিতেন এবং তাঁর উম্মতদেরকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করতে তাকিদ দিয়েছেন। প্রতিটি মানুষকে সময়ের হিসাব কিয়ামতের দিন দিতে হবে বলে তিনি সর্তক করে দিয়েছেন। রাসূল (সা.) বলেছেন: কিয়ামতের দিন কোন বান্দা চারটি প্রশ্নের উত্তর না দেয়া পর্যন্ত সামনে যেতে পারবে না।
সেই চারটি প্রশ্ন হলো- সে তার জীবনকাল কোন কাজে ব্যয় করেছে, তার যৌবনকাল কোথায় ব্যয় করেছে, তার সম্পদ কোথা থেকে আয় করে কোথায় ব্যয় করেছে এবং তার অর্জিত জ্ঞান অনুযায়ী সে আমল করেছে কি না। এই চারটি বিষয়ই সময়ের সাথে সম্পর্কিত।
পরকালে মানুষকে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের হিসাব দিতে হবে। হাদিস শরিফে রয়েছে, ‘রোজ হাশরে শেষ বিচারের দিনে প্রতিটি মানুষ পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়া ছাড়া এক কদমও নড়তে পারবে না। তার জীবনকাল কী লক্ষ্যে কাটিয়েছে? যৌবনকাল কী কাজে ব্যয় করেছে? কোন পথে আয় করেছে? কী কাজে ব্যয় করেছে? জ্ঞান অনুযায়ী কর্ম সম্পাদন করেছে কি না?’ (তিরমিজি ৪:৬১২/২৪১৬, মিশকাত: ৫১৯৭)।)। কিন্তু মানুষ মোহের ঘোরে আচ্ছন্ন।
প্রিয় নবীজি (সা.) বলেন, ‘তোমরা পাঁচটি জিনিসকে তার বিপরীত পাঁচটি জিনিসের পূর্বে মূল্যায়ন করো ও তার সদ্ব্যবহার করো। তোমার যৌবনকে বার্ধক্যের পূর্বে, সুস্থতাকে অসুস্থতার পূর্বে, সচ্ছলতাকে দারিদ্র্যের পূর্বে, অবসরকে ব্যস্ততার পূর্বে, জীবনকে মৃত্যুর পূর্বে।’ (বায়হাকি, শোআবুল ইমান: ১০২৪৮, মুসনাদে হাকিম: ৭৮৪৬)।
পরকালে মানুষ যে বিষয়ে সবচেয়ে অনুতপ্ত হবে তা হলো, অবসর সময়ের সদ্ব্যবহার না করা। সময়ে নেক আমল করলে বান্দার অবস্থার উন্নয়ন হবে, বদ আমল করলে তার অবনতি হবে। আমল ছাড়া সময় পার করলে, তাও তার জন্য প্রকারান্তরে ক্ষতি হিসেবেই গণ্য হবে। কারণ, মানুষের আয়ুষ্কাল প্রবহমান সময়। তা যদি সৎ কর্মে ব্যয়িত হয়, তবে নেক আমল হিসেবে গণ্য হবে; আর যদি নেক আমলবিহীন চলে যায়, তা বদ আমল হিসেবেই পরিগণিত হবে। যেহেতু নিষ্ক্রিয়তা বা অকর্মণ্যতাও একটি ক্রিয়া।
উদাসীনতা বা সময়ের প্রতি অবহেলা সম্পর্কে সাবধান করে আল্লাহ তাআলা কোরআন আজিমে বলেন: ‘প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা তোমাদিগকে মোহাচ্ছন্ন করে রাখে, যতক্ষণ না তোমরা সমাধিসমূহ দেখতে পাও (তোমাদের মৃত্যু হয়)। এটি কখনো সংগত নয়! অচিরেই তোমরা জানতে পারবে। আবারও বলি, এটি মোটেই সমীচীন নয়; তা তোমরা অনতিবিলম্বে জানতে পারবে। না, তোমাদের নিশ্চিত জ্ঞান থাকলে অবশ্যই তোমরা মোহগ্রস্ত হতে না। তোমরা (সময়ের প্রতি উদাসীন কর্মে অবহেলাকারীরা) অবশ্যই জাহান্নাম দেখবে (তাতে প্রবেশ করবে)। পুনশ্চ! অবশ্যই অতি অবশ্যই তোমরা জাহান্নাম চাক্ষুষ দেখে (তাতে প্রবেশ করে তার শাস্তি ভোগ করে) প্রত্যয় লাভ করবে। অতঃপর অবশ্যই সেদিন তোমাদিগকে প্রদত্ত সব নিয়ামত সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে।’ (সুরা ১০২ তাকাছুর, আয়াত: ১-৮)।
আমরা প্রায় সময় নানান ব্যস্ততায় ব্যতিব্যস্ত থাকি। যেকোনো উপলক্ষে অবসর যখন আসে, তা আমাদের জন্য মহামূল্যবান নিয়ামত। সময় আমাদের জীবনের এমন একটি মূলধন বা পুঁজি, যা বিনিয়োগ করলে আমরা ইহকাল ও পরকালে লাভবান ও উপকৃত হব; আর এটি হেলায় নষ্ট করলে উভয় জগতে ক্ষতিগ্রস্ত হব। সময় চলে গেলে তা আর কখনো ফিরে আসে না।
অবসরে আমরা যে আমলগুলো করতে পারি তা হলো, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ নিয়মিত যথাসময়ে আদায় করা। পাঁচ ওয়াক্ত নফল নামাজ তাহাজ্জুদ, ইশরাক, চাশত, জাওয়াল, আউওয়াবিন, সলাতুত-তাসবিহসহ অন্যান্য সুন্নত ও নফল নামাজ পড়া। অজু, গোসল ও নামাজের মাসআলা-মাসায়েল, সুরা-কিরাত ও দোয়া-কালাম ভালোভাবে জানা। বেশি বেশি কোরআন তিলাওয়াত করা। অর্থ, ব্যাখ্যাসহ কোরআন বুঝে পড়ার চেষ্টা করা। কোরআন তিলাওয়াত শেখা ও শুদ্ধ করার চেষ্টা করা। কোরআনের বিশেষ বিশেষ ফজিলতের আয়াতসমূহ ও সুরাসমূহ মুখস্থ করা, ব্যাখ্যাসহ অধ্যয়ন করা। নবীজির ভাষা, কোরআনের ভাষা ও জান্নাতের ভাষা আরবি ভাষা এই অবসরে শেখার চেষ্টা করা। প্রতিটি বাসাবাড়িতে নামাজ ও ইবাদতের জন্য বিশেষ স্থান নির্ধারণ করা।
অবসরে পারিবারিক পরিমন্ডলে নিয়মিত দ্বীনি তালিমের আয়োজন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এতে পরিবারের সদস্যরা একদিকে একঘেয়েমি থেকে যেমন মুক্তি পাবেন, অন্যদিকে নানা রকম মন্দ আকর্ষণ, আসক্তি ও হতাশা থেকেও রক্ষা পাবেন। সময়ও ভালো কাটবে, শরীর ও মন ভালো থাকবে। সময় ও কর্ম ইবাদত হিসেবে গণ্য হবে। আল্লাহর রহমত লাভ হবে। দুনিয়া ও আখিরাতে কামিয়াবি হাসিল হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।