Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে

প্রকাশের সময় : ১৫ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

সরকার যখন পদ্মাসেতুসহ উচ্চাভিলাষী বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে, তখন দেশের অর্থনীতির সব সূচকেই এক ধরনের মন্দা ও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিনমাসে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ, রফতানী বাণিজ্য, রেমিটেন্স প্রবাহ, উন্নয়নপ্রকল্পে ব্যয়বৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতিসহ প্রতিটি খাতেই নেতিবাচক প্রভাব দেখা যাচ্ছে। ইতিমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে চলতি অর্থবছরে ৭ শতাংশের উপর প্রবৃদ্ধির হিসাব কষলেও বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ’র পক্ষ থেকে ভিন্নমত প্রকাশ করে প্রবৃদ্ধি কমার পূর্বাভাস দেয়া হচ্ছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক এবং বিশ্বব্যাংক গ্রুপের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক প্রবণতাকে নেতিবাচক বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সর্বশেষ বিশ্বব্যাংক গ্রুপের ডুয়িং বিজনেস প্রতিবেদনেও বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত হতাশাজনক। গতবছর এই গ্রুপের ডুয়িং বিজনেস প্রতিবেদনে বিশ্বের ১৮৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৭২তম। চলতি বছর আরো দুইধাপ পিছিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান দাঁড়িয়েছে ১৭৪তম স্থানে। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র আফগানিস্তান বাংলাদেশের দুই ধাপ নিচে ১৭৭তম স্থানে আছে। এছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার সবদেশই বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উপরে অবস্থান করছে। এ ক্ষেত্রে ভুটান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভারত ও পাকিস্তানের অবস্থান বাংলাদেশের চাইতে অনেক ভাল। বিনিয়োগ উদ্যোগের ক্ষেত্রে গত একবছরে ভারত ৪ ধাপ অগ্রগতি অর্জন করেছে এবং মিয়ানমার ১০ ধাপ অগ্রগতি অর্জনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে পিছনে ফেলে ১৬৬তম অবস্থানে উঠে এসেছে।
দেশ একটি দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকায় বিনিয়োগসহ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মন্দা ভর করেছে। এরই মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ের সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের ইস্যু এফডিআই ও দেশীয় বিনিয়োগ পরিস্থিতিসহ ব্যবসায়-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করেছে। নতুন শিল্পোদ্যোক্তাদের বিনিয়োগে আস্থাশীল পরিবেশ ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে ব্যর্থতার পরিচয় ফুটে উঠেছে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক গ্রুপের ডুয়িং বিজনেস প্রতিবেদনে। শিল্পকারখানা শুরুর আগে অবকাঠামো অনুমোদন পেতে যেখানে দক্ষিণ কোরিয়ায় ২৮দিন, নেপালে ৮৬দিন, থাইল্যান্ডে ১০৩দিন, শ্রীলঙ্কায় ১১৫দিন, ভারতে ১৪৭দিন সময় লাগে, সেখানে বাংলাদেশে সময় ব্যয় হয় ২৭৮দিন। অন্যদিকে শিল্পকারখানার জন্য প্রয়োজনীয় গ্যাস-বিদ্যুত সংযোগ পেতে যেখানে ভারতে লাগে ৪৭দিন, থাইল্যান্ডে ৩৭দিন, নেপালে ৭০দিন, শ্রীলঙ্কায় ১০০দিন, পাকিস্তানে ২১৫দিন। সেখানে বাংলাদেশের নতুন শিল্পোদ্যোক্তাদের ব্যয় করতে হয় গড়ে ৪০৪দিন। ব্যবসায় নিবন্ধনসহ বিনিয়োগের আনুষ্ঠানিক অনুমোদন পেতে যেখানে নেপালে ৫দিন, থাইল্যান্ডে ৬দিন, দক্ষিণ কোরিয়ায় সাড়ে ৫দিন এবং ভারতে গড়ে সাড়ে ৪৬দিন সময় লাগে, সেখানে বাংলাদেশের নতুন শিল্পোদ্যোক্তাদের গড়ে ২৪৪দিন সময় ব্যয় করতে হয়। কিন্তু পুঁজি কারো জন্য অপেক্ষা করেনা. দীর্ঘদিন অলস বসে থাকতে পারেনা। এ কারণেই বাংলাদেশে নতুন বিনিয়োগ না হলেও দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। এভাবেই বাংলাদেশের বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনার জায়গাগুলো ক্রমে পিছিয়ে যাচ্ছে অথবা হাতছাড়া হচ্ছে।
ব্যবসায় ও বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব দেশের ব্যাংকিং সেক্টরকে সরাসরি আক্রান্ত করেছে। একদিকে হাজার হাজার কোটি টাকা অলস পড়ে আছে, অন্যদিকে কু-ঋণ ও ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ বেড়ে যাওয়ায় বিশেষত: রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকিং সেক্টরের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট তৈরী হয়েছে। গতকাল একটি দৈনিকে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে, গত জুনমাস শেষে যেখানে দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে সামগ্রিক ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের পরিমাণ ছিল ৭ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা, নতুন অর্থবছরের প্রথম ৩ মাসে তা ৩২ হাজার কোটি টাকা বেড়ে ৭ লাখ ৪৩ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। ঝকিভিত্তিক সম্পদ বেড়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে ব্যাংকগুলো মূলধনের ঘাটতিতে পড়তে শুরু করেছে। বিশেষত: রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ব্যাংকগুলো বড় বড় জালিয়াতি, ঋণখেলাফ ও ঋণে সম্পদের ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ার নেতিবাচক প্রভাব প্রাইভেট ব্যাংকগুলোতেও পড়ছে। একদিকে জননিরাপত্তা ও রাজনৈতিক সংকট ও অনিশ্চয়তা নিরসনে সরকারের আন্তরিকতা ও কার্যকর উদ্যোগের অভাব দেখা যাচ্ছে, অন্যদিকে দেশের পুঁজি বাজার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে শুরু করে ব্যাংকিং ও আর্থিক সেক্টরের প্রতিটি বিভাগই স্বেচ্ছাচারিতা, নিয়ন্ত্রণহীনতা, অস্বচ্ছতা ও লুটপাটের শিকার হচ্ছে। আমরা যখন জাতিকে আগামী দশকে একটি মধ্য আয়ের সমৃদ্ধ-ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখাচ্ছি, তখন দেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তাসহ মন্দাভাব কাটানোর কোন উদ্যোগ দেখা যাচ্ছেনা। চলমান বাস্তবতায় দেশে বিনিয়োগ বাড়ানো অসম্ভব হতে পারে। তবে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের সফর বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগের এক অভাবনীয় সম্ভাবনার দুয়ার মেলে ধরেছে। অতীতেও বিভিন্ন সময়ে চীনসহ বিভিন্ন দেশের শিল্পোদ্যোক্তারা বাংলাদেশে শত শত কোটি ডলারের বিনিয়োগ প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল। সরকার সে সব সম্ভাবনা ঠিকমত কাজে লাগাতে পারেনি। ওয়ার্ল্ডব্যাংক গ্রুপের ডুয়িং বিজনেস প্রতিবেদনে চিহ্নিত সমস্যাগুলোসহ দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংকট ও অনিশ্চয়তা দূর করতে দ্রুত উদ্যোগ নিতে সরকার ব্যর্থ হলে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ আরো পিছিয়ে পড়তে পারে। অনেক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও পিছিয়ে পড়ার এই বাস্তবতা মেনে নেয়া যায়না।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে
আরও পড়ুন