চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
যিনা হল অবিবাহিত দুইজন মানুষের মধ্যে যৌনক্রিয়া। ব্যুৎপত্তিগতভাবে যিনা হল ইসলামি বৈবাহিক নিয়ম অনুযায়ী পরস্পর অবিবাহিত একাধিক মুসলিমের মাঝে অবৈধ যৌন সম্পর্ক বিষয়ক একটি ইসলামি নিষেধাজ্ঞা। বিবাহোত্তর যৌনতা এবং বিবাহপূর্ব যৌনতা যেমন: পরকীয়া বা পারস্পারিক সম্মতিতে বিবাহিতের অবৈবাহিক যৌন সম্পর্ক, ব্যভিচার বা দুজন অবিবাহিতের পারস্পারিক সম্মতিতে যৌনসঙ্গম, পতিতাবৃত্তি বা অর্থের বিনিময়ে যৌনসঙ্গম, এবং ধর্ষণ বা জোরপূর্বক অবৈবাহিক যৌনসঙ্গম এর অন্তর্ভুক্ত। যিনা কবিরা গুনাহ যা তওবাহ ব্যাতিরেকে মাফ হয় না। কুরআন শরীফে বলা হয়েছে, ‘লা তাকরাবাল যিনা’ যার অর্থাৎ ‘তোমরা যিনার ধারে-কাছেও যেও না’।
ইসলামে যিনা একটি শাস্তিযোগ্য পাপ এবং আল্লাহর বিরুদ্ধাচারকারী একটি অপরাধ হিসেবে গণ্য। কুরআন এবং হাদিসসমূহে এটি উল্লেখিত রয়েছে। কুরআনের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, যে কোন প্রকারের যৌন ক্রিয়াকলাপ যা বৈধ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া ব্যতীত সম্পাদিত হয় সেগুলো যিনা বলে গণ্য হবে এবং তা পুরুষ ও মহিলা উভয়ের জন্য সমানভাবে শাস্তিযোগ্য। কুরআনের বেশ কয়েকটি জায়গায় যিনা সম্পর্কে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। প্রথমটি হল কুরআনের সাধারণ নিয়ম যেখানে মুসলিমদের যিনায় লিপ্ত না হতে আদেশ দেয়া হয়েছে: ‘তোমরা যিনার ধারে কাছেও যেয়ো না: কারণ এটি একটি লজ্জাজনক ও নিকৃ’ কর্ম, যা অন্যান্য নিকৃ’ কর্মের পথ খুলে দেয়’। (সূরা বনি ইস্রাঈল, আয়াত: ৩২)।
কুরআনের পর ইসলামের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উৎস হাদিসে যিনাকে সঙ্গায়িত করা হয়েছে সকল প্রকারের বিবাহবহির্ভূত যৌনসঙ্গম হিসেবে। আবূ হুরায়রা থেকে বর্ণিত সুত্রে মুহাম্মাদ (সাঃ) বলেছেন: ‘আদম সন্তানের উপর যিনার যে অংশ লিপিবদ্ধ আছে তা অবশ্যই সে প্রাপ্ত হবে। দু-চোখের যিনা হল নিষিদ্ধ যৌনতার প্রতি দৃষ্টিপাত করা, দু’কানের যিনা হল শ্রবণ করা, রসনার যিনা হল কথোপকথন করা, হাতের যিনা হল স্পর্শ করা, পায়ের যিনা হল হেঁটে যাওযা, অন্তরের যিনা হচ্ছে আকাঙ্ক্ষা ও কামনা করা। আর যৌনাঙ্গ অবশেষে তা বাস্তবায়িত করে অথবা মিথ্যা প্রতিপন্ন করে’। (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)।
কুরআনে সর্বপ্রথম সূরা নিসায় যিনার শাস্তি সম্পর্কিত সাময়িক অস্থায়ী নির্দেশনা অবতীর্ণ করা হয়। ‘আর নারীদের মধ্যে যারা ব্যভিচারিণী তাদের বিরুদ্ধে তোমাদের মধ্য থেকে চার জন পুরুষকে সাক্ষী হিসেবে তলব কর। অতঃপর যদি তারা সাক্ষ্য প্রদান করে তবে সংশ্লি’দেরকে গৃহে আবদ্ধ করে রাখ, যে পর্যন্ত মৃত্যু তাদেরকে তুলে না নেয় অথবা আল্লাহ তাদের জন্য অন্য কোন পথ নির্দেশ না করেন। তোমাদের মধ্যে যে দুজন সেই ব্যভিচারে লিপ্ত হয়, তাদেরকে শাস্তি প্রদান কর, অতঃপর তারা যদি উভয়ে তওবা করে এবং নিজেদের সংশোধন করে, তবে তাদের থেকে হাত গুটিয়ে নাও। নিশ্চই আল্লাহ তওবা কবুলকারী, দয়ালু’। (সূরা নিসা, আয়াত: ১৫-১৬)।
কিন্তু পরবর্তীতে সূরা নূরে নবায়িত নির্দেশনা অবতীর্ণ হওয়ার পর পূর্বোক্ত আয়াতের নির্দেশনা রহিত হয়ে যায়। এছড়াও, অধিকাংশ নিয়মকানুন যেগুলো যিনা, স্বামী কর্তৃক স্ত্রীর উপর বা সমাজের সদস্যগণ কর্তৃক সতী সাধ্বী নারীর উপর আরোপিত অভিযোগ সম্পর্কিত, সেগুলো সূরা নূর এ পাওয়া যায়। এই সূরাটি শুরু হয়েছে যিনার শাস্তি সম্পর্কিত বেশ কিছু বিশেষ নির্দি’ নিয়মকানুন প্রদানের মধ্য দিয়ে।
‘ব্যভিচারের দায়ে অভিযুক্ত পুরুষ ও নারী যারা, তাদের প্রত্যেককে একশত বেত্রাঘাত প্রদান কর: তাদের বিষয়ে করুণা যেন তোমাদেরকে দুর্বল না করে, এমন একটি বিষয়ে যা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত হয়েছে, যদি তোমরা আল্লাহ এবং মহাপ্রলয় দিবসের উপর বিশ্বাস রাখো: এবং বিশ্বাসীদের একদলকে তাদের শাস্তির সাক্ষী করে রাখো’। (সূরা আন-নুর, আয়াত: ২) ‘এবং যারা নিরপরাধ নারীদের উপর অভিযোগ আরোপ করে এরপর চারজন সাক্ষী উপস্থিত করতে পারে না, তাদের বেত্রাঘাত কর আঁশিটি করে, এবং এরপর কখনই তাদের কাছ থেকে কোন সাক্ষ্যপ্রমাণ গ্রহণ করো না; এবং এটি একারণে যে তারা সীমালঙ্ঘনকারী। তারা ব্যতীত যারা অনুতপ্ত হয় এবং সংশোধিত হয়, কারণ নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু’। (সূরা আন-নুর, আয়াত: ৪-৫)।
হাদিসে যিনার শাস্তির বর্ণনা এসেছে জনসম্মুখে বেত্রাঘাত এবং পাথর নিক্ষেপের মাধ্যমে মৃত্যুদন্ড হিসেবে। এটি পাওয়া যায় মূলত হাদিসের “কিতাব-আল হুদুদ” নামক সংকলিত খন্ডাংশে। উবাদা বিন আস-সামিত বর্ণনা করেন: ‘আমি আল্লাহর রাসুলকে বলতে শুনেছি: আমার কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ কর। আল্লাহ সেসব মহিলাদের জন্য আদেশ জারি করেছেন। যখন একজন অবিবাহিত পুরুষ একজন অবিবাহিত নারীর সাথে ব্যভিচার করে, তাদেরকে একশত বেত্রাঘাত এবং এক বছরের জন্য নির্বাসন পেতে হবে। আর বিবাহিত পুরুষের সাথে বিবাহিত নারীর ব্যভিচারের ক্ষেত্রে, তাদেরকে একশত বেত্রাঘাত এবং পাথর নিক্ষেপ করে মৃত্যুদন্ড প্রদান করতে হবে’। (সহীহ মুসলিম)।
ইসলামে কোন পুরুষ বা কোন নারীকে যিনার শাস্তি দেয়ার জন্য বিশ্বস্ত তথ্যপ্রমাণ উপস্থিত করা প্রয়োজন। এগুলো হল: ১. একজন মুসলিম কর্তৃক যিনার দোষ স্বীকার। তবে, উক্ত ব্যক্তি যে কোন সময়ে দোষ স্বীকারকে প্রত্যাহার করার অধিকার পাবে; উক্ত ব্যক্তি যদি দোষ স্বীকার প্রত্যাহার করে, তখন ৪ জন মুসলিম পুরুষ সাক্ষী ব্যতিরেকে তাকে আর যিনার শাস্তি দেয়া যাবে না। অথবা ২. কোন নারী যদি গর্ভবতী হয় কিন্তু বিবাহিত না হয়, অথবা ৩. নির্ভরযোগ্য ৪ জন প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিম পুরুষ প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য এবং তাদের প্রত্যেকেই একই সময়ে সঙ্গমরত অবস্থায় দেখে থাকতে হবে।
আরবি ভাষায়, যিনা-আল-জিবর শব্দটি ধর্ষণ অর্থে ব্যবহৃত হয়। ইসলাম ধর্ষণ বা বলপূর্বক যৌন হয়রানিকে অনুমোদন করে না। এ সম্পর্কে সুনানে আবু দাউদে মুহাম্মাদ (সাঃ) এর সময়কালের একটি ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। মুহাম্মদ (সাঃ) এর যুগে জনৈক মহিলা সালাত আদায়ের জন্য গমনকালে পথিমধ্যে তার সাথে একজন পুরুষের দেখা হলে, সে ব্যক্তি জোরপূর্বক তাকে ধর্ষণ করে। সে মহিলা চিৎকার দিলে, তার পাশ দিয়ে গমনকালে জনৈক ব্যক্তি এর কারণ জানতে চায়। তখন সে মহিলা বলে অমুক ব্যক্তি আমার সাথে এরূপ অপকর্ম করেছে। পরে তার পাশ দিয়ে মুহাজিরদের একটি দল গমনকালে সে মহিলা তাদের বলে অমুক ব্যক্তি আমার সাথে এরূপ কাজ করেছে। তারপর তারা গিয়ে এক ব্যক্তিকে ধরে আনে, যার সম্পর্কে তাদের ধারণা ছিল যে, সে-ই এরূপ করেছে।
এরপর তারা সে ব্যক্তিকে উক্ত মহিলার কাছে উপস্থিত করলে, সেও বলে, হ্যাঁ। এই ব্যক্তিই এ অপকর্ম করেছে। তখন তাঁরা সে ব্যক্তিকে রাসুলুল্লাহ এর নিকট নিয়ে যায়। মুহাম্মদ (সাঃ) যখন সে ব্যক্তির উপর শরীআতের নির্দেশ জারী করার মনস্থ করেন, তখন মহিলার সাথে অপকর্মকারী ব্যক্তি দাঁড়িয়ে যায় এবং বলে, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি এই অপকর্ম করেছি। তখন নবী মুহাম্মাদ সে মহিলাকে বলেন, তুমি চলে যাও, আল্লাহ তোমার অপরাধ মাফ করে দিয়েছেন। এরপর তিনি ভুলভাবে ধরে আনা লোকটির সাথে উত্তম ব্যবহার করেন এবং ধর্ষক ব্যক্তিটির জন্য বলেন, একে পাথর মেরে হত্যা কর। মুহাম্মদ (সাঃ) আরও বলেন, লোকটি এমন তওবা করেছে যে, সমস্ত মদীনাবাসী এরূপ তওবা করলে, তা কবূল হতো।
হাদিসের বিবৃতি অনুযায়ী অধিকাংশ আইনবিদের বক্তব্য হল, ধর্ষকের শাস্তি হল মৃত্যুদন্ড। তবে কিছু আধুনিক আইনবিদ মনে করেন, ধর্ষকের শাস্তি একজন যিনাকারীর মতই, অর্থাৎ ধর্ষক বিবাহিত হলে তার শাস্তি মৃত্যুদন্ড এবং অবিবাহিত হলে তাকে একশত বেত্রাঘাত প্রদান এবং এক বছরের জন্য নির্বাসন দিতে হবে এবং উভয় ক্ষেত্রেই শাস্তি জনসম্মুখে প্রদান করতে হবে। ধর্ষিতাকে কোন প্রকার শাস্তি দেয়া হবে না, কারণ ধর্ষিতারা সাধারণত প্রতিরোধ ক্ষমতার দিক থেকে দুর্বল হয়ে থাকেন।
পতিতাবৃত্তিও ইসলামে নিষিদ্ধ। কুরআনে বলা হয়েছে, ‘আর শুধু পার্থিব জীবনে তোমরা কিছু স্বার্থ লাভ করার উদ্দেশ্যে তোমাদের দাসীদেরকে পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করো না, যদি তারা সতীত্ব বজায় রাখতে চায়।’ কোন মুসলিম যদি এ কাজে সম্পৃক্ত হয় তবে তার শাস্তি ব্যভিচারের অনুরুপ, তা হল অবিবাহিতের জন্য একশত বেত্রাঘাত ও একবছরের নির্বাসন এবং বিবাহিতের জন্য একশত বেত্রাঘাত ও মৃত্যুদন্ড। পূর্বে আরবে পতিতাবৃত্তির প্রচলন ছিল। ইসলাম আগমনের পর নবী মুহাম্মাদ সকল স্তরে পতিতাবৃত্তিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। আবদুল্লাহ বিন আব্বাস বর্নিত: মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন, ‘ইসলামে কোন পতিতাবৃত্তি নেই। কেউ যদি ইসলাম-পূর্ব সময়ের পতিতাবৃত্তির চর্চা করে থাকে, তাহলে তা হতে আগত সন্তান মালিকের সম্পত্তি হবে। যে ব্যক্তি বৈধ বিয়ে বা মালিকানা ছাড়া কাউকে সন্তান দাবি করে, তার কোন উত্তরাধিকারীও থাকবে না, এবং সে কারও উত্তরাধিকারও পাবে না’। (সুনানে আবু দাউদ)।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।