পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বিগত কয়েক বছর ধরে গড়ে উঠা কিশোর গ্যাং সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য এক ভয়ানক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভবিষ্যত প্রজন্মের কিশোরদের গ্যাং কালচারে জড়িয়ে অপ্রতিরোধ্য ও দুর্দমনীয় হয়ে উঠা যেকোনো দেশের জন্যই উদ্বেগ ও আতংকের। এটা যে মানুষের গোড়ায় গলদ দেখা দেয়া এবং অংকুরে বিনষ্ট হওয়ার অভাবনীয় ঘটনা, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। করোনাকারণে বিগত দেড় বছরের অধিক সময় ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় কিশোরদের একটি অংশ গ্যাং কালচারের সাথে জড়িয়ে পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক অবস্থায় নিয়ে গেছে। উঠতি বয়সী কিশোরদের এভাবে বিপজ্জনক পথে ধাবিত হওয়া নিয়ে সচেতন মহল উদ্বিগ্ন। এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও অসহায়ত্ব প্রকাশ করতে দেখা গেছে। আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদের কথায় তা স্পষ্ট হয়েছে। তিনি বলেছেন, কিশোর গ্যাং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক্ষেত্রে আইনের সীমাবদ্ধতার কথাও তিনি তুলে ধরেছেন। কিশোর গ্যাং যে ধরনের ফৌজদারী অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে, তাতে তাদের গ্রেফতার করলেও বয়স বিবেচনায় যথাযথ শাস্তির আওতায় আনা যাচ্ছে না। সংশোধনাগারে পাঠিয়ে দেয়া ছাড়া আর কিছু করার থাকছে না। ফলে তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ হয়ে ওঠা ও অল্প বয়সে অনেক কিছু দেখা ও শেখার কারণে শুধু অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় তাদের কঠোর শাস্তির মুখোমুখি করা যাচ্ছে না। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলা, পাড়া, মহল্লায় যেভাবে কিশোর গ্যাং সৃষ্টি হয়েছে এবং ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে চলেছে, তাদের রুখবে কে? যদি রোখার কেউ থাকত, তাহলে একজন কিশোরের সন্ত্রাসী, মাস্তান হয়ে উঠার কোনো কারণ থাকতে পারে না। এই বয়সে তাদের যেখানে স্কুলে যাওয়া-আসা এবং পড়াশোনা নিয়েই ব্যস্ত থাকার কথা, সেখানে গ্যাং তৈরি করা বা গ্যাংয়ের সাথে জড়িয়ে পড়া মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ছাড়া আর কিছু নয়। এক্ষেত্রে গ্যাংয়ের সাথে জড়িত কিশোরের বাবা-মায়ের উদাসীনতা প্রধানত দায়ী। এরপর জনপ্রতিনিধি, সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি, অভিভাবক শ্রেণী এবং স্কুল-কলেজের শিক্ষক এ দায় এড়াতে পারে না। তারা যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করছে না বলেই কিশোররা পথভ্রষ্ট হয়ে বিপদগামী হয়ে উঠছে। যেসব কিশোর গ্যাং গড়ে উঠেছে, তাদের অপকর্মের ধরণ দেখলে আঁৎকে উঠতে হয়। খুন, ধর্ষণ, চুরি, ছিনতাই, মাদক সেবন ও কেনাবেচা, ইভটিজিং, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে মারামারিসহ হেন কোনো অপকর্ম নেই যা তারা করছে না।
দুই.
পত্র-পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, সারাদেশে প্রায় শতাধিক কিশোর গ্যাং রয়েছে। রাজধানীতেই রয়েছে ৬০টি। এর মধ্যে ৩৪টি সক্রিয়। এসব গ্যাংয়ে সদস্য সংখ্যা গড়ে ১৫ জন। এ হিসেবে সারাদেশে প্রায় দেড় হাজার কিশোর গ্যাংয়ের সাথে জড়িত। ১৬ কোটি মানুষের দেশে সংখ্যাটিকে নিতান্ত ক্ষুদ্র মনে হলেও এই কিশোররা যে সমাজের জন্য একেকটি ডিনামাইট হয়ে উঠছে, তা ব্যাখ্যা করে বলার অবকাশ নেই। অসংখ্য মানুষ মারার জন্য একটি ডিনামাইটই কিংবা হাজার হাজার মানুষের মিছিল-সমাবেশ পন্ড করে দিতে একটি ককটেল বিস্ফোরণ বা বন্দুকের ফাঁকা আওয়াজই যথেষ্ট। মানুষ প্রাণ বাঁচাতে দিক-বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে শুরু করে। কাজেই দেড় সহস্রাধিক কিশোর যেভাবে ভয়ংকর ও হিংস্র হয়ে উঠছে, তাতে গোটা সমাজ ব্যবস্থা এবং দেশকে অস্থিতিশীল করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। দুই দশক আগে এই গ্যাং চক্রের যখন সূত্রপাত হয়, তখন এত ব্যাপক আকার ধারণ করেনি। এর প্রতিকার না হওয়ায় ধীরে ধীরে তা মহীরুহ আকার ধারণ করেছে। এখন যেভাবে কিশোর গ্যাংয়ের বিস্তার ঘটছে, তাতে সমাজ অনিরাপদ হয়ে উঠছে। কিশোর গ্যাং চক্রের সদস্যদের বেশ-ভুষা, কথা-বার্তা ও আচারণ-আচরণ দেখে অনেকেই বিভ্রান্ত হচ্ছে। এমনকি পাড়া-মহল্লার দেয়ালে দেয়ালে গ্যাং চক্রের নাম দেখেও আঁৎকে উঠে অন্য দিকে হাঁটা শুরু করে। এই যে চলে যাওয়া বা এড়িয়ে যাওয়া, এটাই কিশোর গ্যাংয়ের শক্তির মূল উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিশোরদের দুর্বিনীত আচরণের কাছে নতি স্বীকার করছে। এসব কিশোর নিজেদের অপ্রতিরোধ্য ভাবতে শুরু করেছে এবং অপরাধের মাত্রা বৃদ্ধি করে চলেছে। তাদের একমাত্র প্রতিদ্ব›দ্বী প্রতিপক্ষ আরেক গ্যাং গ্রুপ। তাদের লক্ষ্য হয়ে উঠেছে প্রতিপক্ষকে প্রতিরোধ করে নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখা। দুঃখের বিষয়, আমরা যারা এড়িয়ে যাচ্ছি, তারা খোঁজ নিচ্ছি না, বিপদগামী এসব কিশোর কারা? তারা কোন পরিবারের সদস্য বা কারা এদের বাবা-মা? সাধারনত পাড়া-মহল্লায় যারা বসবাস করে, তাদের প্রত্যেকের সাথে প্রত্যেকের চেনা-জানা থাকে। এই পরিচিতির সূত্র ধরে যে কিশোরদের বাবা-মা ও অভিভাবকদের সাথে কথা বলার দায়িত্বটুকু কেউ পালন করছে না। সবাই অনেকটা উট পাখির মতো বালিতে মুখ গুঁজে ঝড় উপেক্ষা করে চলেছে। কিশোর গ্যাং চক্রের সাথে যারা জড়িত, পত্র-পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, তাদের বেশির ভাগই নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। পাশাপাশি রয়েছে উচ্চবিত্ত ঘরের সন্তানও। বলা হচ্ছে, এসব কিশোর প্রযুক্তি ও ভিনদেশি অপসংস্কৃতির শিকার হয়ে বিপদগামী হয়ে পড়ছে। ভিডিও গেম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, পর্ণোগ্রাফি, ভিনদেশি অশালীন সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে। এ কথা অনস্বীকার্য, তথ্য-প্রযুক্তির অগ্রযাত্রা প্রতিরোধ করা যাবে না। তা এগিয়ে যাবেই। এই এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে তার ব্যবহার-অপব্যবহারের বিষয়টির দিকে সতর্ক দৃষ্টি দেয়ার মধ্যেই এর কল্যাণ নিহিত। সমস্যা হচ্ছে, আমাদের অধিকাংশ অভিভাবক এ দিকটি খেয়াল করছে না। তারা মনে করছে, তার সন্তান প্রযুক্তির সাথে যুক্ত হচ্ছে এবং সে দারুণ পারদর্শী হয়ে উঠছে-এটা অত্যন্ত গর্বের বিষয়। তারা আত্মতুষ্টিতে ভোগে। আমার সন্তান আমার চেয়ে অনেক বেশি জানছে-বুঝছে, তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ হয়ে উঠছে তা ভেবে পুলকিত হয়। অথচ এই আনন্দিত হওয়ার মধ্য দিয়ে তারা যে সন্তানকে কত ভয়াবহ বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, তা একবারও চিন্তা করছে না। এটা ভাবছে না, তথ্য-প্রযুক্তির ভয়াবহ দিক রয়েছে। ভয়ংকর বিভিন্ন বিষয় মূহুর্তেই সামনে এসে হাজির হয়। পর্ণোগ্রাফি থেকে শুরু করে ত্রাস সৃষ্টিকারি বিভিন্ন উপকরণ মুহূর্তে চলে আসে। নিষিদ্ধ এসব বিষয় শিশু-কিশোরের মনে কৌতূহল সৃষ্টি করে এবং তা দ্বারা প্রভাবিত হয়। কিশোর গ্যাংয়ের সাথে যারা জড়িত তাদের অধিকাংশই প্রযুক্তির এই অপব্যবহারে উৎসাহী হয়ে অপরাধ প্রবণ হয়ে উঠেছে। ফ্যান্টাসিতে ভুগে বা হিরোইজমে আসক্ত হয়ে, নিজেকে পাওয়ারফুল ভাবা থেকেই গ্যাংয়ের সাথে জড়িয়ে পড়ছে বা গ্যাং তৈরি করছে। যারা তাদের এই হিরোইজমকে অস্বীকার করে, তাদেরকে বশ্যতা স্বীকার করতে আক্রমণ করছে। এক অপরাধ থেকে আরেক অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এ ধারাবাহিকতায় খুন, ধর্ষণ, মাদক, ছিনতাইয়ের মতো ভয়ানক ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে। তাদের অভিভাবকদের অনেকে হয়তো জানেনই না, তার সন্তান কত ভয়াবহ অপরাধ কর্মে জড়িয়ে পড়েছে। অনেকে হয়তো ছেলের এমন অপকর্মের বাহাদুরিতে মনে মনে খুশি হয় কিংবা তার সঙ্গে শামিল হয়। সন্তানের এই অপরাধ কর্ম সম্পর্কে জ্ঞাত-অজ্ঞাত উভয় শ্রেণীর অভিভাবকই যে নিজেদের এবং সমাজকে বিপদে ফেলছে, তা বুঝছে না বা বুঝতে চাইছে না। কুপথে সন্তানের চলে যাওয়ার যন্ত্রণা কি, তার অসংখ্য নজির চোখের সামনে থাকলেও তা আমলে নিচ্ছে না।
তিন.
প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই কিছু না কিছু পাশবিক মানসিকতা থাকে। এই মানসিকতা নিয়ন্ত্রণ ও দমন করেই আদিকাল থেকেই মানুষ সভ্যতার দিকে ধাবিত হয়েছে এবং সভ্য হয়ে উঠেছে। এখন দেখা যাচ্ছে, যতই আধুনিক হচ্ছে, পাশবিকতা এবং কৃপ্রবৃত্তিরও ভয়ংকর প্রকাশ ঘটছে। তা নাহলে, যে কিশোরের বাস্তব জীবনের অনেক কিছুই বোঝার মতো জ্ঞান অর্জিত হয়নি বা তার সে জ্ঞান অর্জনের প্রাথমিক পর্যায়, সে কেন পশুবত আচরণ করবে? খুন, ধর্ষণের মতো ঘটনায় কেন জড়াবে? মাদক সেবন, কেনাবেচাতে কেন আসক্ত হবে? বুঝতে অসুবিধা হয় না, এসব কিশোরের অভিভাবকরাও নিজেদের সভ্যতার কথা ভুলে সন্তানদের সভ্য করে তুলতে ব্যর্থ হচ্ছে। শুধু কিশোর গ্যাংয়ের সাথে জড়িতরাই নয়, তরুণ, যুবক, বয়স্কসহ প্রায় সব শ্রেণীর কিছু মানুষ খুন, ধর্ষণ, চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, মাদক চোরাচালানসহ হেন কোনো অপরাধ নেই যাতে জাড়াচ্ছে না। দেশব্যাপী অপরাধের যে কুপ্রবাহের জোয়ার বইছে, তার রাস টেনে ধরার তেমন কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ানোর কথা, সেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরই অনেক সদস্যই ভয়ংকর সব অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। রক্ষকই যদি ভক্ষক হয়ে উঠে, তাহলে দুর্বৃত্তের উল্লাসে মেতে উঠাই স্বাভাবিক। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একশ্রেণীর সদস্য কীভাবে অপরাধ কর্মে জড়িয়ে পড়েছে, তার একটি পরিসংখ্যান দিলে বোঝা যাবে। পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, প্রতি বছর গড়ে প্রায় দুই হাজার পুলিশ সদস্যকে বিভিন্ন অপরাধে শাস্তি গেয়া হয়। এর মধ্যে কনস্টেবল থেকে শুরু করে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাও রয়েছে। শাস্তির মধ্যে লঘু দন্ড, সতর্ক করা থেকে শুরু করে চাকুরিচ্যুতি রয়েছে। একটি দেশে যদি হাজার হাজার পুলিশ সদস্য অপরাধে জড়িয়ে পড়ে, তবে সে দেশে কি মানুষ নিরাপদে বসবাস করতে পারে? পুলিশ কর্তৃপক্ষ অনেকটা আত্মতৃপ্তি নিয়ে বলছে, এখন পুলিশের কেউই অপরাধ করে পার পাচ্ছে না। প্রশ্ন হচ্ছে, পুলিশ কেন অপরাধে জড়াবে? তাদের কেন শাস্তি পেতে হবে? তাদের দায়িত্বই তো অপরাধ ও অপরাধীদের দমন করে জনসেবা করা। এই যে হাজার হাজার পুলিশ সদস্যকে শাস্তি দেয়া হয়, সেটা কি বাহিনীটির সম্মান ক্ষুন্ন করছে না? সমাজ বিশ্লেষকরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে শুরু করে দেশের সর্বত্র যে ভয়াবহ নৈতিক অবক্ষয় চলছে, তা রোধ করতে না পারলে আগামী বছরগুলোতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরও ভয়াবহ অবনতি ঘটবে। তখন সমাজে শান্তিতে বসবাস করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। আত্মরক্ষার্থে সাধারণ মানুষও একে অপরের প্রতি আক্রমণাত্মক এবং প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে উঠবে। গত পাঁচ বছরে মানুষের মধ্যে এ প্রবণতা লক্ষ্যণীয় হয়ে উঠেছে। এ প্রবণতার মূল কারণ, অপরাধ দমনে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা না থাকা, পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং নীতি-নৈতিকতা থেকে মানুষের দূরে সরে যাওয়া বা উপেক্ষা করে চলা। অধিকাংশ মানুষের সুকুমারবৃত্তি লোভ-লালসা ও ক্রোধের আড়ালে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। চোখের সামনে অন্যায় ঘটতে দেখেও প্রতিবাদের পরিবর্তে না দেখার ভান করছে। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের যে হাজার বছরের ঐতিহ্য, তা হারিয়ে যাচ্ছে। সিনিয়র-জুনিয়রের আচরণের মধ্যে যে ধরনের ব্যবধান এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থাকা প্রয়োজন, তা প্রায় বিলুপ্তির পথে। পরিবারের অভিভাকরা সন্তানের প্রতি উদাসীন হয়ে যাচ্ছে। তাদের অধিকাংশই সন্তান কি করছে, কোথায় যাচ্ছে, কার সাথে মিশছে, মোবাইলে, ফেসবুকে কাদের সাথে চ্যাট করছে, এ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। এমনকি সন্তান ও পরিবারের অন্যান্য সদস্য নিয়ে একবেলা একসঙ্গে খেতেও বসছে না। অভিভাবকদের এই উদাসীনতা ও প্রশ্রয় থেকেই সামাজিক অস্থিরতার সৃষ্টি হচ্ছে। পরিবারের অভিভাবকের কাছে যদি জুনিয়র সদস্যদের জবাবদিহিতা না থাকে, তবে পরিবার ও সমাজ কোনভাবেই স্থির থাকতে পারে না। তারা সন্ত্রাসী, মাস্তানি, চাঁদাবাজি, ইভটিজিং থেকে শুরু করে খুন-খারাবির মতো ভয়াবহ অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। যার ফলাফল কিশোর গ্যাং। পারিবারিক শাসন-বারণ এবং ধর্মীয় রীতি-নীতির বিষয়টি যে পরিবারের অভিভাবকরা জানে না, তা নয়। তারা নিশ্চয়ই জানে। মূল বিষয়টি হচ্ছে, তারা আমলে নিচ্ছে না। শুধু পরিবারের অভিভাবকই নয়, সমাজে যাদের প্রভাব বিস্তার করার সক্ষমতা রয়েছে, তাদের সামাজিক দায়িত্ব পালনের অবহেলাও সমাজকে বিশৃঙ্খল করে দিচ্ছে। সমাজ বিজ্ঞানীরা বলেছেন, সমাজে বর্তমানে যে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে তার সঙ্গে পরিবারগুলো তাল মেলাতে পারছে না। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিরাজ করছে অসম প্রতিযোগিতা। ধনী হওয়ার স্বপ্নে বিভোর একটি শ্রেণী তাদের মূল্যবোধ হারাচ্ছে। এ অবস্থার জন্য রাষ্ট্রের উদাসীনতা দায়ী। ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় খোলামেলা অনুষ্ঠান ও নিষিদ্ধ সম্পর্কের দেশি-বিদেশি বাংলা সিরিয়াল আমাদের পারিবারিক বন্ধন শিথিল করে দিচ্ছে। মানুষের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি করছে। মানুষ তার লক্ষ্যে স্থির থাকতে পারছে না। সামাজিক সম্পর্কে ভাঙন দেখা দিচ্ছে। নিজ নিজ ক্ষেত্রে যে দায়িত্ব পালন করার কথা, তারা তা পালন করছে না। ফলশ্রুতিতে কিশোর গ্যাংয়ের মতো নতুন অপরাধী চক্র সৃষ্টি হচ্ছে।
চার.
পারিবারিক, সামাজিক নীতি-নৈতিকতা, মূল্যবোধ, ধর্মীয় অনুশাসন-এসব কোন আইনের মাধ্যমে হয়নি। জীবনকে সুশৃঙ্খল ও সুপথে পরিচালিত করার লক্ষ্যেই মানুষ এসব গুণাবলী ধারণ করেছে। তা নাহলে, মানুষ সেই আদিম যুগেই পড়ে থাকত, আজকের সভ্যযুগে বসবাস করতে পারত না। আইনের মাধ্যমে অপরাধীকে শাস্তি দিয়ে হয়তো সাময়িক দৃষ্টান্ত স্থাপন ও সতর্ক করা সম্ভব, তবে তা স্থায়ী কোনো সমাধান নয়। এজন্য পরিবার ও সমাজের অভিভাবকদের মূল দায়িত্ব পালন করতে হয়। পরিবার ঠিক থাকলে সমাজে তার প্রতিফলন ঘটে। পরিবারের বাবা-মা ও অভিভাবক শ্রেণীর আচার-আচরণ, শাসন-বারণের প্রভাব সন্তানদের ওপর পড়ে। তারাই তাদের কাছে অনুসরণীয়। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হলেই সন্তান বিপথে ধাবিত হয়। ফলে পরিবারের বাবা-মা ও বড়দের তাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে সঠিকভাবে গড়ে তুলতে সচেতন হতে হবে। তাদের সামনে পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয়মূল্যবোধের চেতনাগুলো তুলে ধরতে হবে। পাড়া-মহল্লায় অভিভাবকশ্রেণীকে সভ্যতা, নীতি-নৈতিকতা ও শাসন-বারণের রীতি সুদৃঢ় রাখতে সক্রিয় হতে হবে। অপকর্মে লিপ্তদের পরিবারের অভিভাবকের সাথে কথা বলতে হবে। স্কুল, কলেজ ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-ছাত্রীদের পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয়মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখতে শিক্ষকদের মোটিভেশনাল ভূমিকা রাখা অপরিহার্য। জুম্মার নামাজের সময় মসজিদের ইমামদের এ ব্যাপারে নিয়মিত বয়ান দেয়া উচিত। আমাদের প্রত্যেককে স্ব স্ব অবস্থান থেকে পারিবারিক ও সামাজিক রীতি-নীতি এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের বিষয়টি অটুট রাখতে হবে। আধুনিকতা ও অপসংস্কৃতির গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিলে সন্তানদের কি ভয়াবহ পরিস্থিতি হয়, তা আমরা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। যেসব বাবা-মা’র সন্তান কিশোর গ্যাংয়ের সাথে জড়িয়েছে তাদের সতর্ক ও সচেতন হওয়া জরুরি। তাদের সন্তানদের বখে যাওয়া দেখে অন্য বাবা-মাদেরও নিজ সন্তানের প্রতি নজর দিতে হবে। অন্যদিকে, সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে এবং কিশোর গ্যাং রুখতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সাথে আলাপ-আলোচনা করা প্রয়োজন। তাদের শুধু অপরাধ বা অপরাধীদের ধরণ নিয়ে গবেষণা করলে চলবে না। পারিবারিক ও সামাজিক পরিবর্তন কিভাবে হচ্ছে, কোন দিকে ধাবিত, এসব বিষয় নিয়েও গবেষণা করতে হবে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।