চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
মানবজীবনে সুন্দর ব্যবহারের গুরুত্ব অপরিসীম। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’আলা মানুষকে সুন্দর ও উত্তম কথা বলার নির্দেশ দিয়েছেন। ‘তোমরা মানুষের সঙ্গে উত্তম ও সুন্দর কথা বলো।’ (সূরা বাকারা : ৮৩) রাসূল (সাঃ) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে যার আচার-ব্যবহার সুন্দর, সে আমার সবচেয়ে বেশি প্রিয় এবং আমার সবচেয়ে কাছে থাকবে।’ (সুনানে তিরমিজি)। যুগে যুগে নবী-রাসূলগণ অন্ধকারে নিমজ্জিত, পথহারা, দিশেহারা মানুষদেরকে আলোর পথ দেখাতে সক্ষম হয়েছিলেন সুন্দর আচরণের মাধ্যমে। আজকের দিনে এসেও মানুষকে সত্য সুন্দর কল্যাণের পথে আনার ক্ষেত্রে উত্তম ব্যবহার একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসাবে ভূমিকা পালন করছে।
সুন্দর আচরণ কাকে বলে : সুন্দর ব্যবহার সুন্দরভাবে কথা বলা সুন্দর মনের পরিচয় বহন করে। সুন্দর আচরণ বলতে আমরা বুঝি কারও সাথে সুন্দর করে কথা বলা, দেখা হলে সালাম দেয়া, কুশলাদি জিজ্ঞেস করা, কর্কশ ও কঠিন ভাষায় কথা না বলা, ঝগড়া-ফাসাদে লিপ্ত না হওয়া, ধমক বা রাগের সুরে কথা না বলা, গিবত বা পরনিন্দা না করা, অপমান-অপদস্থ না করা, উচ্চ আওয়াজে কথা না বলা, গম্ভীর বা কালো মুখে কথা না বলা, সর্বদা হাসিমুখে কথা বলা, অন্যের সুখে সুখী হওয়া এবং অন্যের দুঃখে দুঃখী হওয়া, বিপদে দেখা করে সহানুভূতি ও সহমর্মিতা প্রকাশ করা সুন্দর আচরণের অন্তর্ভুক্ত। প্রকৃতপক্ষে মানুষের ভালো-মন্দ পরিচয় নির্ভর করে সুন্দর আচরণের ওপর। সুন্দর আচরণের মাধ্যমে ভালো পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব।
সুন্দর আচরণের গুরুত্ব : ইসলামে সুন্দর আচরণের ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। একজন মানুষের জীবনে সুন্দর আচরণ ও সৌজন্যবোধ শিক্ষা ও অনুসরণ করার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
আল-কুরআনের দৃষ্টিতে সুন্দর আচরণ : পবিত্র আল-কুরআনে সুন্দর আচরণের ব্যাপারে অনেক আয়াত রয়েছে। আল্লাহর নবীও ছিলেন সুন্দর আচরণের মূর্তপ্রতীক। নিন্মে সুন্দর আচরণ সম্পের্কে কিছু আয়াত উল্লেখ করা হলো : আল্লাহ্ বলেন, আল্লাহর রহমতেই আপনি তাদের জন্য কোমল হৃদয় হয়েছেন, পক্ষান্তরে আপনি যদি রূঢ় ও কঠিন হৃদয় হতেন, তাহলে তারা আপনার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। কাজেই আপনি তাদের ক্ষমা করে দিন এবং তাদের জন্য মাগফিরাত কামনা করুন। (সূরা আল-ইমরান : ১৫৯)। আল্লাহ্ বলেন, মুমিনদের জন্য আপনি আপনার ডানা অবনমিত করুন অর্থাৎ কোমল আচরণ করুন। (সূরা হিজর : ৮৮)। আল্লাহ্ বলেন, কেউ যখন তোমাকে সৌজন্যমূলক সম্ভাষণ জানাবে প্রতি-উত্তরে তুমি তাকে তার চাইতে সুন্দর ধরনের সম্ভাষণ জানাও, কিংবা অন্তত ততটুকুই জানাও। (সূরা নিসা ৮৬)।
আল্লাহ্ বলেন, তোমরা আল্লাহ্ ছাড়া কারও উপাসনা করবে না, পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, এতিম ও দরিদ্রদের সাথে সদ্ব্যবহার তথা সুন্দর আচরণ করবে এবং মানুষকে সুন্দর কথা বলবে। (সূরা বাকারা : ৮৩)। মহান আল্লাহ্ বলেন, তোমরা তোমাদের পিতা-মাতা, নিকটাত্মীয়, এতিম, দরিদ্র, প্রতিবেশী, সঙ্গী-সাথী, পথিক এবং যারা তোমাদের অধিকারে এসেছে, সবার সাথে সুন্দর আচরণ কর। (সূরা নিসা : ৩৬)। আল-কুরআনে ইরশাদ হচ্ছ, পৃথিবীতে দম্ভভরে পদচারণা করো না। নিশ্চয় তুমি তো ভূপৃষ্ঠকে কখনোই বিদীর্ণ করতে পারবে না এবং উচ্চতায় তুমি কখনোই পর্বত সমান হতে পারবে না। এসবের মধ্যে যেগুলো মন্দ কাজ সেগুলো তোমার পালনকর্তার কাছে অপছন্দনীয়। (সূরা বনি ইসরাইল : ৩৭-৩৮)। স্বয়ং রাসূল (সাঃ) ছিলেন উত্তম নৈতিক চরিত্রের সর্বোত্তম মডেল। আল্লাহ্ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই আপনি উত্তম নৈতিক চরিত্রের ওপর প্রতিষ্ঠিত।’ (সূরা আল-কালাম : ৪)। মহান আল্লাহ্ বলেন, ‘রহমান-এর বান্দা তারাই, যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং তাদের সাথে যখন মূর্খরা কথা বলতে থাকে, তখন তারা বলে, সালাম।’ (সূরা আল-ফুরকান : ৬৩)।
হাদিসের দৃষ্টিতে সুন্দর আচরণ : পবিত্র কুরআনের পাশাপাশি হাদিসেও সবার সাথে সুন্দর আচরণ করতে এবং দয়া, সহানুভূতি ও কোমলভাবে কথা বলতে বলা হয়েছে। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, প্রিয়নবী (সা) এরশাদ করেছেন, উত্তম কথা বা ভালো কথাও একটি সাদকা। (বুখারি ও মুসলিম)। প্রিয়নবী (সা) এরশাদ করেছেন, সদকা বা দান-খয়রাত মানুষকে শোচনীয় মৃত্যু হতে রক্ষা করে আর সুন্দর আচরণ আয়ুবর্ধক হয়। সুন্দর আচরণকারীকে আল্লাহ্ ভালোবাসেন। রাসূল (সা) বলেন, আল্লাহ্ কোমল ব্যবহার করেন, তাই সব ব্যাপারে তিনি কোমল আচরণ পছন্দ করেন। (বুখারি ও মুসলিম)। যে ব্যক্তি সুন্দর আচরণ থেকে বঞ্চিত সে কল্যাণ থেকেও সম্পূর্ণ রূপে বঞ্চিত। (মুসলিম)।
রাসূল (সা) বলেন, মুমিন হয় উত্তম চরিত্রের অধিকারী। অর্থাৎ সে বদমেজাজি, বিদ্বেষভাবাপন্ন ও মানুষের সাথে রুক্ষ আচরণকারী হয় না। এটা মুমিনের শান নয়। মুসলমান তো অন্যের সাথে নম্র আচরণ করবে, রুক্ষ আচরণ করবে না। রাসুল (সা) বলেছেন, ‘সুন্দর আচরণই নেক আমল।’ (সহিহ মুসলিম)। রাসূল (সা) আরও বলেছেন, ‘যার আচার-ব্যবহার সুন্দর, আমি তার জন্য জান্নাতে একটি বাড়ির নিশ্চয়তা প্রদান করছি।’ (আবু দাউদ)। নবী করীম (সা) এরশাদ করেছেন, ‘তোমার ভাইয়ের সাথে মুচকি হাসির বিনিময় করাও সদকার সওয়াব হয়ে যায়।’ (তিরমিজি)। তিনি এরশাদ করেন, ‘সর্বোত্তম ঈমানদার হচ্ছে ঐ লোক যার চরিত্র সর্বোত্তম। আর তোমাদের মধ্যে সে লোকগুলো সর্বোত্তম যারা তাদের স্ত্রী-পরিবারের প্রতি উত্তম আচরণে অভ্যস্ত।’ (আহমদ/তিরমিজি)। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ‘নেক আমল তো হচ্ছে উত্তম চরিত্র।’ (মুসলিম)
রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ‘উত্তম নৈতিক চরিত্র ও আচার-ব্যবহারের ন্যায় নেকির পাল্লা ভারী করতে আর দ্বিতীয় কোনো আমল নেই। আর আল্লাহ্ অশ্রাব্য গালমন্দ ও কটুকথা বলে এমন ব্যক্তিকে খুবই ঘৃণা করেন।’ (তিরমিজি/আবু দাউদ)। আয়িশাহ (রা) হতে বর্ণিত, নবী (সা) বলেন, নিশ্চয় আল্লাহ হলেন নম্র ও দয়ার্দ্র, তিনি প্রতিটি কাজে নম্রতা ও দয়ার্দ্রতা প্রদর্শন পছন্দ করেন। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ৩৬৮৯)। আবু হুরাইরাহ (রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, মুমিন ব্যক্তি সরল ও ভদ্র প্রকৃতির হয়ে থাকে, কিন্তু পাপি ব্যক্তি ধোঁকাবাজ ও নির্লজ্জ হয়। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং ৪৭৯০)।
উত্তম আচরণ উন্নত ব্যক্তিত্বের পরিচায়ক : ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। মানবজীবনের এমন কোন দিক নেই যা নিয়ে ইসলাম আলোচনা করেনি। ইসলামের সেই আলোচিত বিষয়গুলোর মধ্যে মানুষের সাথে ভালো কথা বলা এবং সুন্দর আচরণ করা অন্যতম একটি। ভালো কথা, ভালো ব্যবহার, সুন্দর আচরণ যাই বলি না কেন, এগুলো হচ্ছে একটি শিল্প। সুন্দর আচরণের মাধ্যমেই একজন ব্যক্তির সার্বিক পরিচয় ফুটে ওঠে, তার উন্নত ব্যক্তিত্বের প্রমাণ মেলে। সুন্দর আচরণের মাধ্যমেই একজন ব্যক্তি কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন করতে সক্ষম হন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।