পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
রাষ্ট্র পরিচালনায় কারা প্রাধান্য পাচ্ছে, এ নিয়ে আলোচনা দীর্ঘদিনের। তবে এ আলোচনা প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছে বর্তমান সরকারের আমলে। এমনকি সম্প্রতি বিষয়টি নিয়ে সিনিয়র রাজনৈতিক পার্লামেন্টারিয়ানরা রাষ্ট্র পরিচালনায় আমলাতন্ত্রের কাছে জানিয়ে রাজনীতিবিদদের অসহায়ত্ব ও অসন্তোষের কথা প্রকাশ করেছেন। সংসদে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। সংবিধান অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রীই ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রধানমন্ত্রী কি এখন রাজনীতিবিদ বা তার দলীয় নেতৃত্বের চেয়ে আমলাদের বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন? বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহ এ মর্মে কি পূর্বাভাস দিচ্ছে? সরকারি দল কি প্রশাসনের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলছে? পত্রিকায় দেখেছি, সরকারি নির্দেশ অমান্য করে আমলারা তাদের সম্পদের হিসাব না দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করবে বলে মন্তব্য করেছেন। পত্রিকান্তরে আরো প্রকাশ, একটি রাজনৈতিক ব্যানার অপসারণের ঘটনা নিয়ে আওয়ামী লীগ ও প্রশাসনের মধ্যে পরস্পরবিরোধী দুই ফৌজদারি মোকদ্দমা রুজু হয়। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা পুলিশ কগনিজেন্সে নিয়ে এজাহার রুজু করে আওয়ামী নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করে। আওয়ামী নেতাদের দায়ের করা মামলা এখন ইনকোয়ারি স্টেজে। আমলাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন ১৯ আগস্ট রাতে এক সভায় মিলিত হয়ে বরিশালের মেয়রকে গ্রেফতারের দাবি জানিয়ে কঠিন ও তীব্র ভাষায় বিবৃতি দেয়। অতঃপর ২৩ আগস্ট বরিশাল বিভাগীয় কমিশনারের বাসভবনে এক সভায় উভয়পক্ষের মধ্যে সমঝোতা হয় বলে মিডিয়ায় প্রকাশ করে। বিষয়টি জাতির কাছে কী মেসেজ দিয়েছে? পর্যালোচনা কী বলে?
বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় বরিশালের ঘটনাকে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন বলে মন্তব্য করেছেন। অন্যদিকে পুলিশ কর্তৃক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বেদম পিটুনির সচিত্র প্রতিবেদন মিডিয়াতে দৃশ্যমান হয়েছে।
পত্রিকা খুললেই দেখা যায়, সরকারের মেগা প্রজেক্টের মেগা চুরি চলছে। প্রতিনিয়তই প্রাক্কলিত ব্যয় বৃদ্ধি করা হচ্ছে। কিন্তু আমলাদের কোথাও কোনো দায়-দায়িত্ব বহন করতে হচ্ছে না। টেন্ডারবাজি, জবরদখল প্রভৃতি অভিযোগের পাশাপাশি সরকারি ক্যাডাররা বিরোধী দলের ওপর হামলা চালায়, তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। দৃশ্যপটে মনে হয়, আমলা ও সরকারি দল একে অপরের পরিপূরক। আর যখন আমলাদের গায়ে হাত পড়ে তখনই দৃশ্যপট পাল্টে যায়। শুরু হয় বিবৃতি ও মামলা রুজু। কে কার চেয়ে কত বড় ক্ষমতাবান সে প্রতিযোগিতাও দেশবাসীকে দেখতে হয়।
বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় ‘হক কথা’ বা ‘সত্য প্রকাশের’ সংস্কৃতি প্রায় উঠে গেছে। অন্যায়, অবিচার ও অত্যাচারের প্রশ্নে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে কিছু সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বক্তব্য রাখছেন বটে, কিন্তু সরকারি সুযোগ-সুবিধাপ্রাপ্ত বুদ্ধিজীবীরা মুখ খোলেন না। বাকি বুদ্ধিজীবীরা, যারা সরকারের মদদপুষ্ট নন, তারা থাকেন আতঙ্কে। অনেকে দেখেও দেখেন না, শোনেও শোনেন না।
বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রজেক্টের মাত্রাতিরিক্ত অপচয় ও অব্যবস্থাপনা এখন সবার কাছে দৃশ্যমান। উন্নয়ন প্রকল্প, খোঁড়াখুঁড়ি ও জনভোগান্তি দূর করতে সড়ক খনন নীতিমালা যথাযথভাবে অনুসরণ না করার পাশাপাশি নির্মাণ অব্যবস্থাপনার জন্য দায়ীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন পরিকল্পনাবিদরা। মূলকথা এই যে, হাঁকডাক যতই শোনা যাক না কেন, দুর্নীতি দমনের প্রশ্নে দুদক বা সরকার বিরোধী দলের প্রতি যতটুকু কঠোর, অনুরূপ ভূমিকা আমলাদের প্রশ্নে রাখে না, বরং আমলাদের প্রশ্নে নমনীয় ভূমিকাই দৃশ্যমান।
সরকার এখন দোটানায় পড়েছে। ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’, এ অবস্থায় আমলা বা প্রশাসনের স্বেচ্ছাচারিতার প্রশ্নে কঠোর ভূমিকা রাখতে পারছে না। বোদ্ধা মহল মনে করে, প্রশাসনকে দিয়ে দিনের ভোট রাতে করাতে প্রশাসনই সরকারের শক্ত হাতিয়ার। আগে সরকার গঠনের জন্য রাজনৈতিক দলকে নির্ভর করতে হতো দলীয় নেতাকর্মীদের ওপর। এখন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার জন্য নির্ভর করতে হয় আমলাদের ওপর এবং সে ফায়দাই আমলারা লুটে নিচ্ছে।
সরকার মনে করে, আমলারা কারসাজি ও কৌশল করে সরকারকে ক্ষমতায় রেখেছে, পুননির্বাচিত করেছে এবং ভবিষ্যতেও ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার জন্য ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং আমলাদের দিয়েই সম্ভব। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ-সংগঠনের নেতাকর্মীরা মনে করেন মিছিল, মিটিং, গলা ফাটানো স্লোগান দিয়ে সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রেখেছেন তারাই। ফলে কার চেয়ে কে বড়, এ নিয়ে আমলা না দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে একটি ঠান্ডা লড়াই দেশব্যাপী অব্যাহত রয়েছে। বিনা ভোটের সরকারকে কারা টিকিয়ে রাখছে এ প্রশ্নের জবাব কোথাও মীমাংসিত, আবার কোথাও অমীমাংসিত। এ মর্মে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রথ যাত্রা’ কবিতার কয়েকটি পঙক্তি মনে পড়ে যায়। কবি লিখেছেন, ‘পথ ভাবে আমি দেব, রথ ভাবে আমি, মূর্তি ভাবে আমি দেব- হাসে অন্তর্যামী।’
কবির ভাষায় ‘পথ’ ও ‘রথ’ নিজেকে দেবতা ভাবে। মূর্তিও নিজেকে দেবতা মনে করে। কিন্তু প্রকৃত দেবতার রহস্য তো লুকিয়েই আছে অন্যখানে। আমলারা মনে করতে পারে সরকারকে তারাই ক্ষমতায় এনেছেন। ক্ষমতাসীন দলও মনে করে সরকারকে ক্ষমতায় রাখার উৎস তারা নিজেরা। সংবিধানের অনুচ্ছেদ-৭ মোতাবেক রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। কবির ভাষায় যে অন্তর্যামীর কথা বলা হয়েছে, তিনিই তো সব ক্ষমতার মালিক। এ ক্ষেত্রে অন্তর্যামীর মতো রাষ্ট্রের মালিক জনগণের মুখ টিপে হাসা ছাড়া আর কিছু করার উপায় নেই। কারণ, ক্ষমতার দ্বন্দ্বে জনগণ এখন নিরূপায়। ভয়-আতঙ্ক জাতিকে ম্লান করে দিয়েছে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করার আগে গণমানুষকে তার নিজ ও পরিবারের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করতে হয়। ভোটাধিকার হরণের কথা বলা যাবে না, কারণ ‘মিথ্যা’ জাতিকে গ্রাস করে ফেলেছে। ভবিষ্যতে এ অরাজকতা কতটুকু গড়ায় তা-ই এখন ভাববার বিষয়। বাংলাদেশে বর্তমানে কোনো কিছুই এক সমীকরণে চলে না। বিচার-বিশ্লেষণের প্রশ্নে ক্ষেত্রবিশেষে সিদ্ধান্ত হয়। ৩১ আগস্ট মাদক মামলায় এক নায়িকাকে জামিনের প্রশ্নে ‘নারী’ ও ‘অসুস্থতা’ বিবেচনা করা হয়, যা বিএনপি চেয়ারপারসনের জামিনের প্রশ্নে বিবেচনা করা হয়নি। প্রশ্ন ওঠে, বিএনপি চেয়ারপারসন কি ‘অসুস্থ’ ও ‘নারী’ ছিলেন না? তার বয়স কি জামিন বিবেচনার জন্য যথেষ্ট ছিল না? রাষ্ট্রীয় সব সিদ্ধান্তই এখন রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বমূলক।
লেখক: রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।